আদর্শ হিন্দু-হোটেল – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

রাণাঘাটের রেল-বাজারে বেচু চক্কত্তির হোটেল যে রাণাঘাটের আদি ও অকৃত্রিম হিন্দু-হোটেল এ-কথা হোটেলের সামনে বড় বড় অক্ষরে লেখা না থাকিলেও অনেকেই জানে। কয়েক বছরের মধ্যে রাণাঘাট রেলবাজারের অসম্ভব রকমের উন্নতি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হোটেলটির অবস্থা ফিরিয়া যায়। আজ দশ বৎসরের মধ্যে হোটেলের পাকা বাড়ী হইয়াছে, চারজন রসুয়ে-বামুনে রান্না করিতে করিতে হিমশিম খাইয়া যায়, এমন খদ্দেরের ভিড়।

বেচু চক্কত্তি (বয়স পঞ্চাশের ওপর, না-ফর্সা না-কালো দোহারা চেহারা, মাথায় কাঁচা পাকা চুল) হোটেলের সামনের ঘরে একটা তক্তপোশে কাঠের হাত-বাক্সের ওপর কনুয়ের ভয় দিয়া বসিয়া আছে। বেলা দশটা। বনগাঁ লাইনের ট্রেন এইমাত্র আসিয়া দাঁড়াইয়াছে। কিছু কিছু প্যাসেঞ্জার বাহিরের গেট দিয়া রাস্তায় পড়িতে শুরু হইয়াছে।

বেচু চক্কত্তির হোটেলের চাকর মতি রাস্তার ধারে দাঁড়াইয়া হাঁকিতেছে–এই দিকে আসুন বাবু, গরম ভাত তৈরি, মাছের ঝোল, ডাল, তরকারী ভাত–হিন্দু-হোটেল বাবু–

দুইজন লোক বক্তৃতায় ভুলিয়া পাশের যদু বাঁড়ুয্যের হোটেলের লোকের সাদর আমন্ত্রণ উপেক্ষা করিয়া বেচু চক্কত্তির হোটেলেই ঢুকিল।

–এই যে, বোঁচকা এখানে রাখুন। দাঁড়ান বাবু, টিকিট নিতে হবে এখানে–কোন ক্লাসে খাবেন? ফাস্ট ক্লাস না সেকেন্ ক্লাস–ফাস্ট ক্লাসে পাঁচ আনা, সেকেন ক্লাসে তিন আনা–

এ হোটেলের নিয়ম, পয়সা দিয়া বেচু চক্কত্তির নিকট হইতে টিকিট (এক টুকরা সাদা কাগজে-নম্বর ও শ্রেণী লেখা) কিনিয়া ভিতরে যাইতে হইবে। সেখানে একজন রসুয়ে বামুন বসিয়া আছে, খদ্দেরের টিকিট লইয়া তাহাকে নিদিষ্ট স্থানে বসাইয়া দিবার জন্য। খাইবার জায়গা দরমার বেড়া দিয়া দুই ভাগ করা। এক দিকে ফাস্ট ক্লাস, অন্য দিকে সেকেন, ক্লাস। খদ্দের খাইয়া চলিয়া গেলে এই সব টিকিট বেচু চক্কত্তির কাছে জমা দেওয়া হইবে– সেগুলি দেখিয়া তহবিল মিলানো ও উদ্বৃত্ত ভাত তরকারীর পরিমাণ তদারক হইবে, রসুয়ে বামুনেরা চুরি করতে না পারে।

চাকর ভিতরে আসিয়া বলিল–মোটে চার জন লোক খদ্দের। দু’জন ওদের ওখানে গেল।

বেচু চক্কত্তি বলিল–যাক্‌ গে। তুই আর একটু এগিয়ে যা–শান্তিপুর আসবার সময় হ’ল। এই গাড়ীতে দু-পাঁচটা খদ্দের থাকেই। আর ভেতরে বামুনকে বলে আয়, শান্তিপুর আসবার আগে যেন আর ভাত না চড়ায়। এক ডেকচিতে এখন চলুক।

এমন সময় হোটেলের ঝি পদ্ম ঘরে ঢুকিয়া বলিল–পয়সা দেও বাবু, দই নে আসি।

বেচু বলিল–দই কি হবে?

পদ্ম হাসিয়া বলিল–একজন ফাস্টো কেলাসে খাবে। আমায় বলে পাঠিয়েছে। দই চাই, পাকা কলা চাই–

বেচু বলিল–কে বল তো? খদ্দের?

–খদ্দের তো বটেই। পয়সা দিয়ে খাবে। এমনি না। আমার ভাইপো আসবে দেশ থেকে এই শান্তিপুরের গাড়ীতে।

–না–না–তাকে পয়সা দিতে হবে না। সে ছেলেমানুষ, দু-এক দিনের জন্যে আসবে–তার কাছ থেকে পয়সা কিসের? দইয়ের পয়সা নিয়ে যা–

বেচু একথা কখনো কাহাকেও বলে না, কিন্তু পদ্ম ঝিয়ের সম্বন্ধে অন্য কথা। পদ্ম ঝি এ হোটেলে যা বলে তাই হয়। তাহার উপর কথা বলিবার কেহ নাই। সেজন্য দুষ্ট লোকে নানারকম মন্দ কথা বলে। কিন্তু সে-সব কথায় কান দিতে গেলে চলে না।

শান্তিপুরের গাড়ী আসিবার শব্দ পাওয়া গেল।

হোটেলের চাকর খদ্দের আনিতে স্টেশনে যাইতেছিল, বেচু চক্কত্তি বলিল–খদ্দের বেশী করে আনতে না পারলে আর তোমায় রাখা হবেনা মনে রেখো–আমার খরচা না পোষালে মিথ্যে চাকর রাখতে যাই কেন? গেল হপ্তাতে তুমি মোটে তেইশটা খদ্দের এনেছ–তাতে হোটেল চলে?

পদ্ম ঝি বলিল–তোমায় পই-পই করে বলে হার মেনে গেলাম; তিন আনা বাড়িয়ে চোদ্দ পয়সা করো, আর ফাস্টো কেলাস-টেলাস তুলে দ্যাও। ক’টা খদ্দের হয় ফাস্টো কেলাসে? যদু বাঁড়ুয্যের হোটেলে রেট কমিয়েছে–শুনে–

বেচু বলিল–চুপ চুপ, একটু আস্তে আস্তে বল না। কারও কানে কথা গেলে এখুনি—

এমন সময় দু’জন খদ্দের সঙ্গে করিয়া মতি চাকর ফিরিয়া আসিল।

বেচু বলিল–আসুন বাবু, পুঁটুলি এখানে রাখুন। কোন কেলাসে খাবেন বাবুরা? পাঁচ আনা আর তিন আনা–

একজন বলিল–তোমার সেই বামুন ঠাকুরটি আছে তো? তার হাতের রান্না খেতেই এলাম। আমরা সে-বার খেয়ে গিয়ে আর ভুলতে পারি নে। মাংস হবে?

–না বাবু, মাংস তো রান্না নেই–তবে যদি অর্ডার দেন তো ওবেলা—

লোকটি বলিল–আমরা মোকদ্দমা করতে এসেছি কিনা, যদি জিতি পোড়ামা আর সিদ্বেশ্বরীর ইচ্ছেয়–তবে হোটেলে আমাদের আজ থাকতেই হবে। কাল উকীলের বাড়ী কাজ আছে–তা হলে আজ ওবেলা তিন সের মাংস চাই–কিন্তু সেই বামুন ঠাকুরকে দিয়ে রান্না করানো চাই। নইলে আমরা অন্য জায়গায় যাব।

ইহারা টিকিট কিনিয়া খাইবার ঘরে ঢুকিলে পদ্ম ঝি বলিল–পোড়ারমুখো মিনসে আবার শুনতে না পায়। কি যে ওর রান্নার সুখ্যাত করে লোকে, তা বলতে পারি নে–কি এমন মরণ রান্নার!

বেচু বলিল–টিকিটগুলো নিয়ে আয় তো ভেতর থেকে। এ-বেলার হিসেবটা মিটিয়ে রাখি। আর এখন তো গাড়ী নেই–আবার সেই একটায় মুড়োগাছা লোকাল–

পদ্ম বলিল–কেন আসাম মেল–

–আসাম মেলে আর তেমন খদ্দের আসছে কই? আগে আগে আসাম মেলে আটটা দশটা খদ্দের ফি দিন পাওয়া যেত–কি যে হয়েছে বাজারের অবস্থা–

পদ্ম ঝি ভিতরে গিয়া রসুয়ে-বামুনের নিকট হইতে টিকিট আনিয়া বলিল–শোনো মজা, ফাস্টো কেলাসের ডাল যা ছিল সব সাবাড়। হাজারি ঠাকুরের কাণ্ড! ইদিকে এই খদ্দের বাবু গিয়ে তাকে একেবারে স্বগ্‌গে তুলে দিচ্ছে, তুমি হেনো রাঁধো, তুমি তেমন রাঁধো বলে–যত অনাছিষ্টি কাণ্ড, যা দেখতে পারি নে তাই। এখন ডালের কি করবে বলো–

–ডাল কতটা আছে দেখলি?

–লবডঙ্কা। আর মেরেকেটে তিন জনের মত হবে—

–ক’জনের মত ডাল দিইছিলি?

–দশ জনের মত মুগের ডাল আলাদা ফাস্টো কেলাসের মুড়িঘণ্টের জন্যে দিইছি-সেকেন কেলাসে ত্রিশ জনের মুসুরি-খেঁসারি মিশেল ডাল–

–হাজারি ঠাকুরকে ডেকে দে—

পদ্ম ঝি হাজারি ঠাকুরকে সঙ্গে করিয়াই আনিল।

লোকটার বয়স পঁয়তাল্লিশ-ছে’চল্লিশ, একহারা চেহারা, রং কালো। দেখিলে মন হয় লোকটা নিপাট ভালমানুষ।

বেচু চক্কত্তি বলিল–হাজারি ঠাকুর, ডাল কম হ’ল কি করে?

হাজারি ঠাকুর বলিল–তা কি করে বলবো বাবু? রোজ যেমন ডাল খদ্দেরদের দিই, তার বেশী তো দিই নি। কম হলে আমি কি করবো বলুন।

পদ্ম ঝি ঝঙ্কার দিয়া বলিল–তোমার হাড়ে হাড়ে বদমাইশি ঠাকুর। আমি পষ্ট দেখেছি তুমি ওই খদ্দের বাবুদের মুখে রান্নার সুখ্যাতি শুনে তাদের পাতে উড়কি উড়কি মুড়িঘণ্ট ঢালছো। পয়সা-কড়িও দিয়েছে বোধ হয় বকশিশ–

হাজারি বলিল–বকশিশ এ হোটেলে কত পাই দেখছো তো পদ্মদিদি। একটা বিড়ি খেতে কেউ দ্যায়–আজ পাঁচ বছর এখানে আছি? তুমি কেবল বকশিশ পেতে দ্যাখো আমাকে।

পদ্ম বলিল–তুমি মুখে-মুখে তককো ক’রো না বলে দিচ্ছি। পদ্ম ঝি কাউকে ভয় করে কথা বলবার মেয়ে নয়। ফাস্টো কেলাসের বাবুরা পুজোর সময় তোমায় গেঞ্জি কিনে দেয় নি?

–ইস-ভারী গেঞ্জি একটা কিনে দিয়েছিল বুঝি, পুরনো গেঞ্জি–

বেচু চক্কত্তি বলিল–যাও যাও, ঠাকুর, বাজে কথা নিয়ে বকো না। বেশী খদ্দের আসে, ডালের দাম তোমার মাইনে থেকে কাটা যাবে।

–কেন বাবু আমার কি দোষ হ’ল এতে। পদ্মদিদি আট জনের ডাল মেপে দিয়েছে, তাতে খেয়েছে এগারো জন–

পদ্ম এবার হাজারি ঠাকুরের সামনে আসিয়া হাত-মুখ নাড়িয়া চোখ পাকাইয়া বলিল–আট জনের ডাল মেপে দিইছি–নচ্ছার, বদমাইশ, গাঁজাখোর কোথাকার–দশ জনের দশের অর্ধেক পাঁচ পোয়া ডাল তোমায় দিই নি বের করে?

হাজারি ঠাকুর আর প্রতিবাদ করিতে বোধ হয় সাহস পাইল না।

পদ্ম ঝি অত অল্পে বোধ হয় ছাড়িত না–কিন্তু ইতিমধ্যে খদ্দেররা আসিয়া পড়াতে সে কথা বন্ধ করিয়া চলিয়া গেল। হাজারি ঠাকুরও ভিতরে গেল।

বেলা প্রায় আড়াইটা।

আসাম মেল অনেকক্ষণ আসিয়া চলিয়া গিয়াছে।

হাজারি ঠাকুর একা খাওয়ার ঘরে খাইতে বসিল। বড় ডেকচিতে দুটিখানি মাত্র ভাত ও কড়ায় একটুখানি ঘাঁটা তরকারি পড়িয়া আছে। ডাল, মাছ যাহা ছিল, পদ্ম ঝিকে তাহার বড় থালায় বাড়িয়া দিতে হইয়াছে–সে রোজ বেলা দেড়টার সময় রান্নাঘরের উদ্বৃত্ত ও ডাল তরকারি মাছ নিজের বাসায় লইয়া যায়–রসুয়ে-বামুনদের জন্যে কিছু থাকুক আর না থাকুক।

অন্য রসুয়ে-বামুনটা উড়িয়া। তার নাম রতন ঠাকুর। সে হোটেলে বসিয়া খায় না– তাহারও বাসা নিকটে। সেও ভাত-তরকারি লইয়া যায়।

হাজারির এখানে কেহ নাই। সে হোটেলেই থাকে, হোটেলেই খায়। রোজই তার ভাগ্যে এই রকম। বেলা আড়াইটা পর্যন্ত খালি পেটে খাটিয়া দুটি কড়কড়ে ভাত, কোনোদিন সামান্য একটু ডাল, কোনোদিন তাও না–ইহাই তাহার বরাদ্দ। ডেকচিতে বেশী ভাত থাকিলে পদ্ম ঝি বলিবে–অত ভাত খাবে কে? ও তো তিন জনের খোরাক–আমার থালায় আর দুটো বেশী করে ভাত বেড়ে দিও।

হাজারি ঠাকুর খাইতে বসিয়া রোজ ভাবে–আর দুটো ভাত থাকলে ভাল হোত, না-হয় তেঁতুল দিয়ে খেতাম। পদ্মটা কি সোজা বদমাইশ মাগী-পেট ভরে যে কেউ খায়-তাও তার সহ্যি হয় না। যদু বাঁড়ুয্যের হোটেলে বেলা এগারোটার সময় রাঁধুনি-বামুন একথালা ভাত খেয়ে নেয়, আমাদের এখানে তা হবার জো আছে? বাব্বা, যেমন কর্তা, তেমনি গিন্নি (পদ্ম ঝিকে মনে মনে গিন্নি বলিয়া হাজারি ঠাকুর খুব আমোদ উপভোগ করিল–মুখ ফুটিয়া যাহা বলা যায় না, মনে মনে তাহা বলিয়াও সুথ।)।

খাওয়ার পরে মাত্র আড়াই ঘণ্টা ছুটি।

আবার ঠিক বেলা পাঁচটায় উনুনে ডেকচি চাপাইতে হইবে।

.

রতন ঠাকুর এই সময়টা বাসায় গিয়া ঘুমোয়, কিন্তু হাজারি ঠাকুর চূর্ণী নদীর ধারের ঠাকুর বাড়ীতে, কিংবা রাধাবল্লভ-তলায় নাটমন্দিরে একা বসিয়া কাটায়।

না ঘুমাইয়া একা বসিয়া কাটাইবার মানে আছে।

হাজারি ঠাকুরের এই সময়টা হইতেছে ভাবিবার সময়। এ সময় ছাড়া আর নির্জনে ভাবিবার অবসর পাওয়া যায় না। সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত রান্নার কাজে ব্যস্ত থাকিতে হয়, রাত এগারটা পর্যন্ত খদ্দেরদের পরিবেশন, রাত বারোটা পর্যন্ত নিজেদের খাওয়া-দাওয়া, তার পর কর্তার কাছে চাল-ডালের হিসাব মিটানো। রাত একটার এদিকে শুইবার অবসর পাওয়া যায় না, দু-দণ্ড একা বসিয়া ভাবিবার সময় কই?

চূর্ণী নদীর ধারের জায়গাটি বেশ ভাল লাগে।

ও-পারে শান্তিপুর যাইবার কাঁচা সড়ক। খেয়া নৌকায় লোকজন পারাপার হইতেছে। গ্রামের বাঁশবন, শিমুল গাছ, মাঠ, কলাই ক্ষেত, গাবতেরেণ্ডার বেড়া-ঘেরা গৃহস্থ-বাড়ী।

হাজারি ঠাকুর একটা বিড়ি ধরাইয়া ভাবিতে আরম্ভ করিল।

আজ পাঁচ বছর হইয়া গেল বেচু চক্কত্তির হোটেলে।

প্রথম যেদিন রাণাঘাট আসিয়া হোটেলে ঢোকে, সে-কথা আজও মনে হয়। গাংনাপুর হইতে রাণাঘাট আসিয়া সে প্রথমেই গেল বেচু চক্কত্তির হোটেলে কাজের সন্ধানে।

কর্তা সামনেই বসিয়া ছিলেন। বলিলেন–কি চাই?

হাজারি বলিল–আজ্ঞে বাবু, রসুয়ে-বামুনের কাজ করি। কাজের চেষ্টায় ঘুরছি, বাবুর হোটেলে কাজ আছে?

–তোমার নাম কি?

–আজ্ঞে, হাজারি দেবশর্মা, উপাধি চক্রবর্তী।

এই ভাবে নাম বলিতে হাজারির পিতাঠাকুর তাহাকে শিখাইয়া দিয়াছিলেন।

–বাড়ী কোথায়?

–গাংনাপুর ইস্টিশানে নেমে যেতে হয় এঁড়োশোলা গ্রামে।

–রাঁধতে জানো?

বাবু একদিন রাঁধিয়ে দেখুন! মাংস মাছ, যা দেবেন সব পারবো।

–আচ্ছা, তিন দিন এমনি রাঁধতে হবে–তার পর সাত টাকা মাইনে দেবো আর খেতে পাবে। রাজি থাকো আজই কাজে লেগে যাও।

সেই হইতে আজ পর্যন্ত সাত টাকার এক পয়সা মাহিনা বাড়ে নাই। অথচ খদ্দের বাবুর সকলেই তাহার রান্নার সুখ্যাতি করে, যদিচ পদ্ম ঝিয়ের মুখে একটা সুখ্যাতির কথাও সে কখনো শোনে নাই, ভালো কথা তো দূরের কথা, পদ্ম ঝি তাহাকে আঁশবঁটি পাতিয়া পারে তো কোটে। গরীব লোক, এ বাজারে চাকুরি ছাড়িয়া দিয়া যাইবেই বা কোথায়? যাক, তাহার জন্য সে তত ভাবে না। তাহার মনে একটা বড় আশা আছে, ভগবান তাহা যদি পূর্ণ করেন কোনদিন–তবে তাহার সকল খেদ দূর হইয়া যায়।

হোটেলের কাজ সে খুব ভাল শিখিয়া লইয়াছে। সে নিজে একটা হোটেল খুলিবে।

হোটেলের বাহিরে লেখা থাকিবে–

হাজারি চক্রবর্ত্তীর হিন্দু-হোটেল রাণাঘাট ভদ্রলোকদের সস্তায় আহার ও বিশ্রামের স্থান। আসুন! দেখুন!! পরীক্ষা করুন!!!

কর্তার মত তাকিয়া ঠেস দিয়া বসিয়া টিকিট বিক্রয় করিবে। রাঁধুনী-বামুন ও ঝি ‘বাবু’ বলিয়া ডাকিবে। সে নিজে বাজারে গিয়া মাছ তরকারী কিনিয়া আনিবে, এ হোটেলের মত ঝিয়ের উপর সব ভার ফেলিয়া দিয়া রাখিবে না। খদ্দেরদের ভাল জিনিস খাওয়াইয়া খুশী করিয়া পয়সা লইবে। সে এই কয় বছরে বুঝিয়া দেখিল, লোকে ভাল জিনিস, ভাল রান্না খাইতে পাইলে দু-পয়সা বেশী রেট দিতেও আপত্তি করে না।

এ হোটেলের মত জুয়াচুরি সে করিবে না, মুসুরি ডালের সঙ্গে কম দামের খেসারি ডাল চালাইবে না, বাজারের কানা পোকাধরা বেগুন, রেল-চালানি বরফ-দেওয়া সস্তা মাছ বাছিয়া বাছিয়া হোটেলের জন্য কিনিবে না।

এখানে খদ্দেরদের বিশ্রামের বন্দোবস্ত নাই–যাহারা নিতান্ত বিশ্রাম করিতে চায়, কর্তার গদিতে বসিয়া এক-আধটা বিড়ি খায়–কিন্তু তাহার মনে হয় বিশ্রামের ভাল ব্যবস্থা থাকিলে সে হোটেলে লোক বেশী আসিবে–অনেকেই খাওয়ার পরে একটু গড়াইয়া লইতে চায়, সে তাহার হোটেলে একটা আলাদা ঘর রাখিবে খুচরা খদ্দেরদের বিশ্রামের জন্য। সেখানে তক্তপোশের ওপর শতরঞ্চি ও চাদর পাতা থাকিবে, বালিশ থাকিবে, তামাক খাইবার বন্দোবস্ত থাকিবে, কেউ একটু ঘুমাইয়া লইতে চাহিলেও অনায়াসে পারিবে। খাও-দাও, বিশ্রাম কর, তামাক খাও, চলিয়া যাও। রাণাঘাটের কোনো হোটেলে এমন ব্যবস্থা নাই, যদু বাঁড়ুয্যের হোটেলেও না। ব্যবসা ভাল করিয়া চালাইতে হইলে এ-সব ব্যবস্থা দরকার, নইলে রেলগাড়ীর সময়ে ইস্টিশানে গিয়া শুধু ‘আসুন বাবু, ভাল হিন্দু-হোটেল’ বলিয়া চেঁচাইলে কি আর খদ্দের আসে?

খদ্দেররা খোঁজে আরামে ভাল খাওয়া। যে দিতে পারিবে, তাহার ওখানেই লোক ঝুঁকিবে।

অবশ্য ইহা সে বোঝে, আজ যদি একটা হোটেলে বিশ্রামের ঘর করে, তবে দেখিতে দেখিতে কালই রাণাঘাটের বাজারময় সব হিন্দু-হোটেলেই দেখাদেখি বিশ্রামের ঘর খুলিয়া বসিবে যদি তাহাতে খদ্দের টানা যায়।

তবুও একবার নাম বাহির করিতে পারিলে, প্রথম যে নাম বাহির করে তাহারই সুবিধা। আরও কত মতলব হাজারির মাথায় আছে, শুধু খদ্দেরের বিশ্রাম ঘর কেন, মোকদ্দমা মামলা যাহারা করিতে আসে, তাহারা সারাদিনের খাটুনির পরে হয়তো খাইয়া-দাইয়া একটু তাস খেলিতে চায়– সে ব্যবস্থা থাকিবে, পান-তামাকের দাম দিতে হইবে না, নিজেরাই সাজিয়া খাও বা হোটেলের চাকরেই সাজিয়া দিক।

চূর্ণী নদীর ধারে বসিয়া একা ভাবিলে এমন সব কত নতুন নতুন মতলব তাহার মনে আসে। কিন্তু কখনো কি তাহা ঘটিবে? তাহার মনের আশা পূর্ণ হইবে? বয়স তো হইয়া গেল ছ’চল্লিশের উপর–সারাজীবন কিছু করিতে পারে নাই, সাত টাকা মাহিনার চাকুরি আজও ঘুচিল না–ছাঁ-পোষা গরীব লোক, কি করিয়া কি হইবে, তাহা সে ভাবিয়া পায় না।

তবু সে কেন ভাবে রোজ এ-সব কথা, এই চূর্ণী নদীর ধারে বসিয়া? ভাবিতে বেশ লাগে, তাই ভাবে।

তবে বয়স হইয়াছে বলিয়া দমিবার পাত্র সে নয়। ছেচল্লিশ বছর এমন কিছু বয়স নয়। এখনও সে অনেকদিন বাঁচিবে। কাজে উৎসাহ তাহার আছে, হোটেল খুলিতে পারিলে সে দেখাইয়া দিবে কি করিয়া সুনাম করিতে পারা যায়। হোটেল খুলিয়া মরিয়া গেলেও তাহার দুঃখ নাই।

সময় হইয়া গেল। আর বেশীক্ষণ বসিয়া থাকা চলিবে না। পদ্ম ঝি এতক্ষণ উনুনে আঁচ দিয়াছে, দেরি করিয়া গেলে তাহার মুখনাড়া খাইতে হইবে। আর কি লাগানি-ভাঙানি! কর্তার কাছে লাগাইয়াছে সে নাকি গাঁজা খায়–অথচ সে গাঁজা ছোঁয় না কস্মিনকালে।

ফিরিবার পথে ছোট বাজারে রাধাবল্লভ-তলা।

হাজারি ঠাকুর প্রতিদিন এখানে এই সময়ে ভক্তিভরে প্রণাম করিয়া যায়।

–বাবা রাধাবল্লভ, তোমার চরণে পড়ে আছি ঠাকুর! মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করো। পদ্ম ঝির ঝাঁটা খেতে আর পারি নে। ওই কর্তাবাবুর হোটেলের পাশে পদ্ম ঝিকে দেখিয়ে দেখিয়ে যেন হোটেল খুলতে পারি।

হোটেলে ফিরিয়া দেখিল রতন ঠাকুর এখনও আসে নাই, পদ্ম ঝি উনুনে আঁচ দিয়া কোথায় গিয়াছে।

বেচু চক্কত্তি দিবানিদ্রা হইতে উঠিয়া বাসা হইতে ফিরিয়াই হাজারিকে ডাক দিলেন।

–শোনো। আজ আমাদের এখানে ক’জন বাবু মাংস খাবেন, ফিষ্টি করবেন, তাঁরা আমায় আগাম দামও দিয়ে গেলেন। যাতে সকাল সকাল চুকে যায় তার ব্যবস্থা করবে। ওঁরা মুর্শিদাবাদের গাড়ীতে আবার চলে যাবেন। মনে থাকবে তো? রতন এখনও আসে নি?

হাজারির দুঃখ হইল, বেচু চক্কত্তি একথা তাহাকে কেন বলিল না যে, তাহার হাতের রান্না খুব ভাল, অতএব সে যেন নিজেই মাংস রাঁধে। কখনো ইহারা তাহার রান্না ভাল বলে না সে জানে। অথচ এই রান্না শিখিতে সে কি পরিশ্রমই না করিয়াছে।

রান্না কি করিয়া ভাল শিথিল, সে এক ইতিহাস।

হাজারির মনে আছে, তাহাদের এঁড়োশোলা গ্রামে একজন সেকালের প্রাচীনা ব্রাহ্মণ বিধবা থাকিতেন, তখন হাজারির বয়স নয়-দশ বছর। রান্নায় তার শুধু সাধারণ ধরণের সুখ্যাতি নয়, অসাধারণ সুনামও ছিল। গ্রামেরও বাহিরেও অনেক জায়গায় লোকে তাঁর নাম জানিত।

হাজারির মা তাঁকে বলিল–খুড়ীমা, আপনার তো বয়েস হয়েছে, কবে চলে যাবেন– আপনার গুণ আমাকে দিয়ে যান। চিরকাল আপনার নাম করবো।

তিনি বলেন–আচ্ছা তোকে বৌ একটা জিনিস দিয়ে যাবো। কি করে নিরিমিষ চচ্চড়ি রাঁধতে হয় সেটাই তোকে দিয়ে যাবো।

সেই বৃদ্ধা হাজারির মাকে ওই একটিমাত্র জিনিস শিখাইয়াছিলেন এবং সেই একটি জিনিস রাঁধিবার গুণেই হাজারির মায়ের নাম ও-দিকের আট-দশখানা গ্রামে প্রসিদ্ধ ছিল। শুনিতে অতি সামান্য জিনিস–নিৰিমিষ চচ্চড়ি, ওর মধ্যে আছে কি? কিন্তু এ-কথার জবাব পাইতে হইলে হাজারির মায়ের হাতের নিরিমিষ চচ্চড়ি খাইতে হয়।

দুঃখের বিষয় তিনি আর বাঁচিয়া নাই, ও-বৎসর দেহ রাখিয়াছেন।

হাজারি মায়ের রন্ধন-প্রতিভা উত্তরাধিকারসূত্রে লাভ করিয়াছে-মাংস, মাছ সবই রাঁধে ভাল–কিন্তু তার হাতের নিরিমিষ চচ্চড়ি এত চমৎকার যে, বেচু চক্কত্তির হোটেলে একবার যে খাইয়া যায়, সে আবার ঘুরিয়া সেখানেই আসে। রেল-বাজারে তো অতগুলো হোটেল রহিয়াছে–সে আর কোথাও যাইবে না।

আজও মাংস রান্না রাঁধিবার ভার তাহারই উপর পড়িল! খদ্দেররা মাংস খাইয়া খুব তারিফও করিতে লাগিল। কিন্তু আসলে তাহাতে হাজারির ব্যক্তিগত লাভ বিশেষ কিছুই নাই–খদ্দেরের মুখের প্রশংসা ছাড়া। পদ্ম ঝি তাহাকে একটা উৎসাহের কথাও বলিল না। বেচু চক্কত্তিও তাই।

অনেক রাত্রে সে খাইতে বসিল। এত যে ভাল করিয়া নিজের হাতে রান্না মাংস, তাহার নিজের জন্য তখন আর কিছুই নাই। যাহা ছিল, কর্তাবাবু নিজের বাসায় পাঠাইয়া দিয়াছেন। তার পরেও সামান্য কিছু যা অবশিষ্ট ছিল, পদ্ম ঝি চাটিয়া-পুটিয়া লইয়া গিয়াছে।

খাইবার সময় রোজই এমন মুশকিল ঘটে। তাহার জন্য বিশেষ কিছুই থাকে না, এক একদিন ভাত পৰ্যন্ত কম পড়িয়া যায়–মাছ, মাংস তো দূরের কথা। বয়স ছেচল্লিশ হইলেও হাজারি খাইতে পারে ভাল, খাইতে ভালও বাসে–কিন্তু খাইয়া অধিকাংশ দিনই তার পেট তরে না।

রাত সাড়ে বারোটা। কর্তাবাবু হিসাব মিলাইয়া চলিয়া গিয়াছেন। হোটেলে সে আর মতি চাকর ছাড়া আর কেহ রাত্রে থাকে না। পদ্ম ঝি অনেকক্ষণ চলিয়া গিয়াছে–রাত দশটার পরে সে থাকে না কোনোদিনই।

মতি চাকর বলিল–চলো, ছোট বাজারে যাত্রা হচ্চে, শুনতে যাবে বামুনঠাকুর?

–এত রাত্রে যাত্রা? পাগল আর কি! সারাদিন খেটে আবার ও-সব শখ থাকে? আমি যাব না–তুই যাস তো যা। এসে ভাঁড়ার ঘরের জানালায় টোকা মারিস। দোর খুলে দেবো।

মতি চাকর ছোকরা মানুষ। তাহার শখও বেশী। সে চলিয়া গেল।

মতি যাইবার কিছুক্ষণ পরে কে একজন বাহির হইতে দরজা ঠেলিল। হাজারি উঠিয়া গিয়া দরজা খুলিয়া পাশের হোটেলের মালিক খোদ যদু বাঁড়ুয্যেকে দরজার বাহিরে দেখিয়া আশ্চর্য হইয়া গেল। যদু বাঁড়ুয্যের হোটেলের সঙ্গে তাহাদের রেষারেষি করিয়া কারবার চলে। তিনি এত রাতে এখানে কি মনে করিয়া? কখনো তো আসেন না! হাজারির মন সম্ভ্রমে পূর্ণ হইয়া গেল, যদু বাঁড়ুয্যেও একটা হোটেলের কর্তা, সুতরাং হাজারির কাছে সেও তার মনিবের সমান দরের লোক, এক রকম মনিবই।

যদু বাঁড়ুয্যে বলিল, আর কে আছে ঘরে?

যদুর আসিবার উদ্দেশ্য বুঝিতে না পারিয়া হাজারি ততক্ষণে মনে মনে আকাশ-পাতাল ভাবিতেছিল–বিনীত ভাবে বলিল–কেউ নেই বাবু, আমিই আছি। মতি ছিল, ছোট বাজারে যাত্রা—

যদু বাঁড়ুয্যে বলিল–চল ঘরের মধ্যে বসি। তোমার সঙ্গে কথা আছে।

ঘরের মধ্যে বসিয়া যদু বাঁড়ুয্যে বেচু চক্কত্তির গদিতে বসিয়া একবার চারিদিকে চাহিয়া লইয়া বলিল–তুমি এখানে কত পাও ঠাকুর?

–আজ্ঞে সাত টাকা আর খোরাকী।

–কাপড় চোপড় দেয়?

–আজ্ঞে বছরে দু’খানা কাপড়।

যদু বাঁড়ুয্যে কাশিয়া গলা পরিষ্কার করিয়া বলিলেন–শোন, আমার হোটেলে তুমি কাজ করতে যাবে? তোমায় দশ টাকা আর খোরাকী দেবো। বছরে তিনখানা কাপড় পাবে। ধোপা-নাপিত, তেল-তামাক। যাবে?

হাজারি দস্তুরমত অবাক হইয়া গিয়াছিল। কিছুক্ষণ সে কথা বলিতে পারিল না। তার পর বলিল–বাবু, এখন তো কিছু বলতে পারি নে। ভেবে বলবো।

–ভেবে বলাবলি আর কি, আমার যে কথা সেই কাজ। তুমি কাল থেকে এ হোটেল ছেড়ে আমার হোটেলে চলো, কাল থেকেই আমি নিতে রাজি। তবে হ্যাঁ, বেচু চক্কত্তির সঙ্গে আমি অসরস করতে চাইনে। সেও ব্যবসাদার, আমিও ব্যবসাদার।

হাজারির মাথা যেন ঘুরিয়া উঠিল। কেহ দেখিতেছে না তো? পদ্ম ঝি কোথাও আড়ি পাতিয়া নাই তো? সে তাড়াতাড়ি বলিল–এখন আমি কোন কথা বলতে পারব না বাবু। কাল ভেবে বলবো। কাল রাত্তিরে এমন সময় আসবেন।

যদু বাঁড়ুয্যে চলিয়া গেল।

হাজারি গাঁজা খায় এ খবর একেবারে মিথ্যা নয়, তবে খায় খুব সঙ্গোপনে এবং খুব কম। আজ এ ব্যাপারের পরে সে এক কলিকা গাঁজা না সাজিয়া পারিল না। সংসারে কেহ এ পর্যন্ত তাহাকে ভাল লোক বা ভাল রাঁধে বলিয়া খাইবার সঙ্গে সঙ্গে তাহার পুরস্কার দিতে চায় নাই–খদ্দেরর মুখের ফাঁকা কথায় পেট ভরে না তো!

যদুবাবু নিজে বাড়ী বহিয়া আসিয়াছেন, তাহাকে দশ টাকা মাহিনার চাকরি (মায় খোরাকী ধোপা নাপিত) দিতে।

এতদিন রাণাঘাটের বাজারে আছে–কখনও কাহারও সঙ্গে মেশে না সে–মিশিতে ভালও বাসে না। তাহার জীবনের আশা যে-টা, সে-টা দশজনের সঙ্গে মিশিয়া আড্ডা দিয়া গাঁজা খাইয়া বেড়াইলে পূর্ণ হবে না। তাহাকে খাঁটিতে হইবে, বাজার বুঝিতে হইবে, হিসাব রাখা শিখিতে হইবে, একটা ভাল হোটেল চালাইবার যাহা কিছু সুলুক সন্ধান সব সংগ্রহ করিতে হইবে। সংসারে উন্নতি করিতে হইলে, দেশের কাছে বড় মুখ দেখাইতে হইলে, পরের মুখে নিজের নাম শুনিতে হইলে–সেজন্য চেষ্টা চাই, খাটুনি চাই। আড্ডা দিয়া গাঁজা খাইয়া বেড়াইলে কিংবা মতি চাকরের মত ছোট বাজারের বারোয়ারীর যাত্রা শুনিয়া বেড়াইলে কি হইবে?

রাত অনেক। মাথা গরম হইয়া গিয়াছে। ঘুম আসার নামটি নাই।

দরজায় খটখট শব্দ হইল। হাজারি উঠিয়া দরজা খুলিল–সে আগেই বুঝিয়াছিল মতি চাকর ফিরিয়াছে। মতি ঘরে ঢুকিয়া বলিল–এখনো ঘুমোওনি ঠাকুর? এখনো জেগে যে!

হাজারি গাঁজার কলিকা লুকাইয়া রাখিয়া তবে মতিকে দরজা খুলিয়া দিতে গিয়াছিল। বলিল–যে গরম, ঘুম আসবে কি, সারাদিন আগুনের তাতে–যাত্রা দেখলি নে?

মতি বলিল–যাত্রার আসরে জায়গা নেই। লোক ভর্তি। ফিরে এলাম। চল এক জায়গায়, যাবে ঠাকুরমশায়?

–কোথায়?

–পাড়ার মধ্যে। চলো না–ঘুম যখন নেই, একটু ঘুরেই না হয় এলে। তোমার তো কোনদিন কোথাও–

হাজারি বলিল–তোরা ছেলে-ছোকরা, আমার বয়স ছেচল্লিশ। আমি তোর বাপের বয়সের মানুষ, আমার সঙ্গে ও-সব কথা কেন?…তোর ইচ্ছে, যা বুঝিস করগে যা।

–বাবুর কাছে কি পদ্মদিদির কাছে কিছু বলো না ঠাকুরমশাই, দোহাই, দুটি পায়ে পড়ি।

আশ্চর্য এই যে, মতির এই কথা হাজারির মনে এক নতুন ধরনের ভাবনা আনিয়া দিল। তাহার উচ্চাশা আছে, মতির মত রাত বেড়াইয়া স্ফূৰ্তি করিয়া সময় নষ্ট করিলে ভগবান তাহাকে দয়া করিবেন না। মতি কি ভাবিয়া আর বাহিরে গেল না, বাসনের ঘরে (হোটেলের পিতল কাঁসার থালা-বাটি রান্নাঘরের পাশে সিন্দুকে থাকে, মাজাঘষার পর রোজ রাত্রে বেচু চক্কত্তি নিজে দাঁড়াইয়া থাকিয়া সেগুলি গুনিয়া সিন্দুকে তুলিয়া রাখিয়া চাবি নিজে সঙ্গে করিয়া লইয়া যান) গিয়া শুইয়া পড়িল। হাজারিও বাসনের ঘরে শোয়, আজ সে বাহিরের গদির মেজেতে তাহার পুরোনো মাদুরখান পাতিয়া শুইল।

না–যদুবাবুর হোটেলে সে যাইবে না। হোটেলের রাঁধুনিগিরি সব জায়গায় সমান। এ হোটেলে আছে পদ্ম, ও হোটেলে হয়তো আবার কে আছে কে জানে? তা ছাড়া, বেচু বাবু তাহার পাঁচ বছরের অন্নদাতা। লোভে পড়িয়া এতদিনের অন্নদাতাকে ত্যাগ করিয়া যাওয়া ঠিক নয়।

সে নিজে হোটেলে খুলিবে, এই তো তাহার লক্ষ্য। রাঁধুনি-বিত্তি যতদিন করিতে হয়, এই হোটেলেই করিবে। অন্য কোথাও যাইবে না। তাহার পর রাধাবল্লভ দয়া করেন, তখন অন্য কথা।

পরদিন খুব সকালে পদ্ম ঝি আসিয়া ডাকিল–ও ঠাকুর, দোর খোল–এখনও ঘুম– বাবাঃ! কুম্ভকর্ণকে হার মানালে তোমরা!

হাজারি তাড়াতাড়ি বিছানা হইতে উঠিয়া ছেঁড়া মাদুরখানা গুটাইয়া রাখিয়া দোর খুলিয়া দিল। একটু পরেই বেচু চক্কত্তি আসিলেন। দরজায়, গদিতে ও ক্যাশ-বাক্সে গঙ্গা জলের ছিটা দিয়া, ক্যাশ-বাক্সের ডালার উপরটা সামান্য একটু গঙ্গাজল দিয়া মার্জনা করিয়া লইয়া পদ্ম ঝিকে বলিলেন–ধুনো দে–বেলা হয়ে গেল। আজ হাটবার, ব্যাপারীদের ভিড় আছে, শীগগির করে আঁচ দে–আর সেদিনকার মত পচা দই-টই আনিস নে বাপু। ওতে নাম খারাপ হয়ে যায়–শেষকালে স্যানিটারি বাবুর চোখে পড়ে যাবে। দরকার কি?

ব্যাপারীরা সাধারণতঃ পাড়াগাঁয়ের চাষা লোক। তাহারা দই খাইতে পছন্দ করে বলিয়া প্রতি হাটবারে তাহাদের জন্য কয়েক হাঁড়ি দইয়ের বরাদ্দ আছে। এই দই পদ্ম ঝি তাহার নিজের ঘরে পাতিয়া হোটেলে বিক্রয় করিয়া দুই পয়সা লাভ করিয়া থাকে। এবং সে যে প্রথম শ্রেণীর জিনিস সরবরাহ করে না, তাহা বলাই বাহুল্য।

পদ্ম ঝি মুখ ঘুরাইয়া বলিল–বাবু আপনার যত সব অনাছিষ্টি কথা! দই পচা না ঘন্ট, কে বলচে দই পচা! ওই মুখপোড়া হাজারি ঠাকুর তো? ওর ছেরাদ্দর চাল যদি আজ–

হাজারি ঠাকুর কথাটা বলিয়াছিল বটে তবে সে দই পচা কি তাজা তাহা বলে নাই বলিয়াছিল ব্যাপারী খদ্দেররা বলাবলি করিতেছিল এ রকম খারাপ দই খাইতে দিলে তাহারা চোদ্দ পয়সার জায়গায় বারো পয়সার বেশি খোরাকি দিবে না।

পদ্ম ঝি রান্নাঘরের চৌকাঠে পা দিয়া ঝাঁজালো ঝগড়ার সুরে বলিল–বলি, ও ঠাকুর দই পচা তোমাকে কে বলেছে?

হাজারি আমতা আমতা করিয়া বলিল–ওই সাধু মণ্ডল আর তার ভাইপো রোজ হাটেই তো এখানে খায়–ওরাই বলচিল–

–বলচিল! তোমার গলা ধরে বলতে গিয়েছে ওরা। তোমার মত হিংসুক কুচুটে লোক তো কখনো দেখিনি–আমি দই দিই বলে তুমি হিংসেয় বুক ফেটে মরে যাচ্চ সে কি আমি বুঝিনে! তোমার শখের কুসুম গয়লানীর ছাপ-বাক্সে পয়সা না উঠলে কি আর তোমার মনে শান্তি আছে!…গাঁজাখোর মড়ুই-পোড়া বামুন কোথাকার!

হাজারি জিভ কাটিয়া বলিল–ছি ছি, কি যে বলো পদ্মদিদি তার ঠিক নেই–-কুসুমের বাপের বাড়ী আমাদের গায়ে, আমায় জ্যাঠা ব’লে ডাকে, আমি তাকে মেয়ে বলি–তার নামে অমন কথা বল্লে তোমার পাপ হবে না?

ইহার উত্তরে পদ্ম ঝি যাহা বলিল, তাহা ছাপার অক্ষরে প্রকাশ করা যায় না।

হাজারির চোখে প্রায় জল আসিল। কুসুমকে সে সত্যই মেয়ের মত স্নেহ করে– তাহাদের গ্রামের রসিকলাল ঘোষের মেয়ে–রাণাঘাটে তার শশুরবাড়ী–অল্পবয়সে বিধবা হইয়াছে, এখন দুধ বেচিয়া, দই বেচিয়া ছোট ছোট দুইটি ছেলেকে মানুষ করে। এক শাশুড়ী ছাড়া বাড়ীতে কেহ নাই।

হঠাৎ একদিন পথে দু’জনের দেখা।

–জ্যাঠামশায় যে! দাঁড়ান একটু পায়ের ধূলো দিন। আপনি এখানে কোথায়?

–আরে কুসুম, কোত্থেকে তুই এখানে?

–এই তো আমার শশুরবাড়ী, ছোট বাজারে মন্দিরের গায়েই। আপনি কি আজ বাড়ী থেকে এসেছেন?

–না রে–আমি রেল-বাজারে হোটেলে কাজ করি। আজ মাস ছ’-সাত আছি।

বিদেশে একই গ্রামের মানুষ দেখিয়া দু’জনেই খুব খুশী হইল। সেই হইতে কুসুম হাজারি ঠাকুরের হোটেলে দুধ দই বেচিতে গিয়াছে। গরীব বলিয়া হাজারি ঠাকুর অনেকবার লুকাইয়া হোটেল হইতে রাঁধা ভাত-তরকারি তাহাকে থালা করিয়া বাড়িয়া দিয়াছে। দুধ দই বেচিয়া ফিরিবার সময় কুণ্ডুদের পাটের আড়তের গলিটায় দাঁড়াইয়া কুসুম থালা লইয়া গিয়াছে। ইহাদের মেলামেশা ও ঘনিষ্ঠতা পদ্ম ঝির চোখ এড়ায় নাই, সুতরাং সে বলিতেই পারে।

.

দুপুরের পর হাজারি প্রতিদিনের মত চূর্ণীর ধারে যাইতেছে–এমন সময় কুসুমের সঙ্গে দেখা হইল।

কুসুম দুধের ভাঁড় হাতে ঝুলাইয়া বাড়ী ফিরিতেছিল। তাহার বয়স চব্বিশ-পঁচিশ, বেশ স্বাস্থ্য, রং শ্যামবর্ণ, মুখশ্রী বেশ শান্ত।

হাজারি বলিল–বাড়ী ফিরছিস এত বেলায় যে!

কুসুম বলিল–জ্যাঠামশায়, বড্ড দেরি হয়ে গেল। নিজের তো দুধ নেই–কায়েত পাড়া থেকে দুধ আনি, তবে বিক্রী করি, তবে বাড়ী ফিরি। আসুন না আমাদের বাড়ী।

–না, এখন আর কোথায় যাবো! তুই যা, খাবি-দাবি।

কুসুম কিছুতেই ছাড়ে না, বলিল–আমার খাওয়া-দাওয়া জ্যাঠামশায়, শাশুড়ী রেঁধে রেখে দিয়েচে গিয়ে খাবো; কতক্ষণ লাগবে? আসুন না।

হাজারি অগত্যা গেল। ছ’চাল একখানা বড় ঘর, সেখানেতে কুসুমের শাশুড়ী থাকে আর একখানা ছোট চারচালা ঘরে কুসুম ছেলে দুটি লইয়া থাকে। শাশুড়ীর সহিত কুসুমের খুব সদ্ভাব নাই।

কুসুম নিজের ঘরে হাজারিকে লইয়া গিয়া বসাইল। ঘরের মধ্যে একখানা তক্তপোশ, পুরু কাঁথা পাতিয়া সুন্দর পরিপাটি বিছানা তাহার উপরে। তক্তপোশের নীচে বালি দেওয়া আর-বছরের আলু। এককোণে কতকগুলি হাঁড়িকুড়ি ও একটা বড় জালা–বাঁশের আলনাতে কতকগুলি লেপ-কাঁথা বাঁধা। একটা জলচৌকিতে থানকতক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ঝকঝকে পিতল কাঁসার বাসন। ঘর দেখিয়া হাজারির মনে হইল–কুসুম বেশ সাজাইয়া রাখিতে জানে জিনিসপত্র।

কুসুম বলিল–পান খাবেন জ্যাঠামশায়?

–দে একটা। আর তুই খেতে যা। বেলা অনেক হয়েচে।

কিন্তু কুসুমের দেখা গেল, খাওয়ার সম্বন্ধে কোনো তাড়া নাই। হাজারিকে পান দিয়া সেই যে হাজারির সামনে মেজেতে বসিয়া গল্প করিতে লাগিল–প্রায় ঘণ্টাখানেক হইয়া গেল। সে নড়িবার নামও করে না দেখিয়া হাজারি ব্যস্ত হইয়া পড়িল।

বলিল–তুই খেতে যা না। আমি যাই, আবার উনুনে আঁচ দিতে হবে সকাল সকাল।

কুসুম বলিল–যাচ্ছি এবার।

বলিয়া আর যায় না। আরও আধঘণ্টা কাটিয়া গেল।

কুসুম আর যায় নাই। বাবা মারা গিয়াছে, ভাইয়েরা গরীব বলিয়া হউক বা ভাইবৌদের জন্যই হউক–তাহাকে বাপের বাড়ীতে কেহ লইয়া যায় না। নিজে দু-একবার গিয়াছিল, বেশী দিন টিকিতে পারে নাই। ভাইবৌদের ব্যবহার ভাল নয়।

হাজারির সঙ্গে কুসুম সেই সব কাহিনীই বলিতে লাগিল। ছেলেবেলায় গ্রামে কি পথে করিয়াছিল কি, সেই বিষয়ে কথাও তাহার আর ফুরায় না।

–এখানে ছোলার শাক পয়সা দিয়ে কিনতে হয়। আমাদের গাঁয়ের যুগীপাড়ার মাঠে আমরা ছোলার শাক তুলতে যেতাম জ্যাঠামশায়–একবার, তখন আমার বয়েস ন’বছর, আমি আর সাধু কুমোরের মেয়ে আদর, আমরা দুজনে গিয়েছি ছোলার শাক তুলতে– একটা মিন্সে দেখি জ্যাঠামশায় ছোলার ক্ষেতে বসে কচি ছোলা তুলে তুলে খাচ্ছে। আমাদের দেখে দোড় দোড়, বিষম দোড়! আমরা তো হেসে বাচিনে–ভেবেছে বুঝি আমাদের ক্ষেত!

বলিয়া কুসুম মুখে কাপড় দিয়া হাসিতে হাসিতে গড়াইয়া পড়ে আর কি!

হাজারি দেখিল, ইহার ছেলেমানুষী গল্প শুনিতে গেলে ওদিকে হোটেলে যাইতে বিলম্ব হইবে–পদ্ম ঝি মুখ-নাড়ার চোটে অতিষ্ঠ করিয়া তুলিবে।

সে উঠিতে যাইতেছে, কুসুম বলিল–দাঁড়ান জ্যাঠামশায়, আপনার জন্যে একটা জিনিস করে রেখেছি। সেইটে দেবার জন্যেই আপনাকে নিয়ে এলাম।

বলিয়া একটা কাপড়ের পুঁটুলি খুলিয়া একখানা কাঁথা বাহির করিয়া হাজারির সামনে মেলিয়া ধরিয়া বলিল–কেমন হয়েছে কাঁথাখানা?

–বাঃ, বেশ হয়েছে রে!

কুসুম কাঁথাখানি পাট করিতে করিতে হাসিমুখে বলিল–আপনি এখানা রাত্রে পেতে শোবেন। আপনি শুধু মাদুরের উপর শুয়ে থাকেন হোটেলে,–আমার অনেক দিনের ইচ্ছে একখানা কাঁথা আপনাকে সেলাই করে দেব। তা দু-তিন মাস ধরে একটু একটু করে এখানা আজ দিন পাঁচ-ছয় হ’ল শেষ হয়েছে।

হাজারি ভারি খুশী হইল।

কুসুমের বাবা রসিক ঘোষ প্রায় তাহার সমবয়সী। কুসুম তাহার মেয়ের সমান। একই গায়ের লোক–তাহা হইলেও কি সবাই করে? গাঁয়ে তো কত লোক আছে! ·

মুখে বলিল, বেঁচে থাক মা, মেয়ে না হলে বাপের জন্যে এত আত্তি দেখায় কে? ভারী চমৎকার কাঁথা। আমি পেতে শুয়ে বাঁচবো এখন। ভারী চমৎকার কাঁথা। বেশ, বেশ!

কুসুম বলিল–জ্যাঠামশায়, আপনি তো বললেন মেয়ে না হলে কে করে–কিন্তু আমিও বলচি, বাবা না হলে হোটেল থেকে নিজের মুখের ভাতের থালা কে মেয়েকে দেয় লুকিয়ে– শ্রাবণ মাসের সেই উপঝ্রান্ত বাদলায়–

কুসুমের চোখ দিয়া জল গড়াইয়া পড়িতে সে বাঁ-হাতে আঁচল দিয়া চোখ মুছিয়া চুপ করিয়া মাটির দিকে চাহিয়া রহিল। কিছুক্ষণ পরে বলিল–মাথার ওপর ভগবান জানেন– আর কেউ জানে না–আপনি আমার জন্যে যা করচেন। আপনি ব্রাহ্মণ, দেবতা–আমি ছোট জাতের মেয়ে–আমার ছোট মুখে বড় কথা সাজে না, তবে আমিও বলচি ওপরের দেনেওয়ালা আপনাকে ভাতের থালার বদলে মোহরের থালা যেন দেন। আমিও যেন দেখে মরি।

বলিয়াই সে আসিয়া হাজারির পায়ে গড় হইয়া গলায় আঁচল দিয়া প্রণাম করিল।

সেদিন ছিল বেশ বর্ষা।

হাজারি দেখিল, হোটেলে গদির ঘরে অনেকগুলি ভদ্রলোক বসিয়া আছে। অন্যদিন এ ধরনের খদ্দের এ হোটেলে সাধারণতঃ আসে না–হাজারি ইহাদের দেখিয়া একটু বিস্মিত হইল।

বেচু চক্কত্তি ডাকিল–হাজারি ঠাকুর, এদিকে এস–হাজারি গদির ঘরে দরজায় আসিয়া দাঁড়াইলে ভদ্রলোকদের একজন বলিলেন–এই ঠাকুরটির নাম হাজারি?

বেচু চক্কত্তি বলিল–হাঁ বাবু, এরই নাম হাজারি।

বাবুটি বলিলেন–এর কথাই শুনেচি। ঠাকুর তুমি আজ বর্ষার দিনে আমাদের মাংস পোলাও রেঁধে ভাল করে খাওয়াতে পারবে? তোমার আলাদা মজুরী যা হয় দেবো।

বেচু বলিল–ওকে আলাদা মজুরী দেবেন কেন বাবু, আপনাদের আশীর্বাদে আমার হোটেলের নাম অনেক দূর অবধি লোকে জানে। ও আমারই ঠাকুর, ওকে কিছু দিতে হবে না। আপনারা যা হুকুম করবেন তা ও করবে।

এই সময় পদ্ম ঝি বেচু চক্কত্তির ডাকে ঘরে ঢুকিল।

বেচু চক্কত্তি কিছু বলিবার পূর্বে জনৈক বাবু বলিল–ঝি, আমাদের একটু চা ক’রে খাওয়াও তো এই বর্ষার দিনটাতে। না হয় কোনো দোকান থেকে একটু এনে দাও। বুঝলেন চক্কত্তি মশায়। আপনার হোটেলের নাম অনেক দূর পর্যন্ত যে গিয়েছে বল্লেন–সে কথা মিথ্যা নয়। আমরা যখন আজ শিকারে বেরিয়েছি, তখন আমার পিসতুতো ভাই বলে দিয়েছিল, রাণাঘাট যাচ্চ, শিকার করে ফেরবার পথে রেল-বাজারের বেচু চক্কত্তির হোটেলের হাজারি ঠাকুরের হাতে মাংস খেয়ে এসো। তাই আজ সারাদিন জলায় আর বিলে পাখী মেয়ে বেড়িয়ে বেড়িয়ে ভাবলাম, ফিরবার গাড়ী তো রাত দশটায়। তা এ বর্ষার দিনে গরম গরম মাংস একটু খেয়েই যাই। মজুরী কেন দেবো না চক্কত্তি মশায়? ও আমাদের রান্না করুক, আমরা ওকে খুশি করে দিয়ে যাবো। ওর জন্যেই তো এখানে আসা। কথা শুনিয়া হাজারি অত্যন্ত খুশি হইয়া উঠিল, আরও সে খুশি হইল এই ভাবিয়া যে, চক্কত্তি মশায়ের কানে কথাগুলি গেল–তাহার চাকুরির উন্নতি হইতে পারে। মনিবের সুনজরে পড়িলে কি না সম্ভব? খুশির চোটে ইহা সে লক্ষ্যই করিল না যে, পদ্ম ঝি তাহার প্রশংসা শুনিয়া এদিকে হিংসায় নীলবর্ণ হইয়া উঠিয়াছে।

বাবুরা হোটেলের উপর নির্ভর করিল না–তাহারা জিনিসপত্র নিজেরাই কিনিয়া আনিল। হাজারি ঠাকুর মাংস রাঁধিবার একটি বিশেষ প্রণালী জানে, মাংসে একটুকু জল না দিয়া নেপালী ধরনের মাংস রান্নার কায়দা সে তাহাদের গ্রামের নেপাল-ফেরত ডাক্তার শিবচরণ গাঙ্গুলীর স্ত্রীর নিকট অনেকদিন আগে শিখিয়াছিল। কিন্তু হোটেলে দৈনন্দিন খাদ্য তালিকার মধ্যে মাংস কোনদিনই থাকে না–তবে বাধা খরিদ্দারগণের মনস্তুষ্টির জন্য মাসে একবার বা দুবার মাংস দেওয়ার ব্যবস্থা আছে বটে-সে রান্নার মধ্যে বিশেষ কৌশল দেখাইতে গেলে চলে না, বা হাজারির ইচ্ছাও করে না–যেমন ভাল শ্রোতা না পাইলে গায়কের ভাল গান করিতে ইচ্ছা করে না–তেমনি।

হাজারি ঠিক করিল, পদ্ম ঝি তাহাকে দুই চক্ষু পাড়িয়া যেমন দেখিতে পারে না–তেমনি আজ মাংস রাঁধিয়া সকলের বাহবা লইয়া পদ্ম ঝির চোখে আঙুল দিয়া দেখাইয়া দিবে, তাহাকে যত ছোট মনে করে ও, তত ছোট সে নয়। সেও মানুষ, সে অনেক বড় মানুষ।

ভাল যোগাড় না দিলে ভাল রান্না হয় না। পদ্ম ঝি যোগাড় দিবে না এ জানা কথা। হোটেলের অন্য উড়ে বামুনটিকে বলিতে পারা যায় না–কারণ সে-ই হোটেলের সাধারণ রান্না রাঁধিবে।

একবার ভাবিল–কুসুমকে আনবো?

পরক্ষণেই স্থির করিল, তার দরকার নাই। লোকে কে কি বলিবে, পদ্ম ঝি তো বঁটি পাতিয়া কুটিবে কুসুমকে। যাক, নিজেই যাহা হয় করিয়া লইবে এখন।

বেলা হইয়াছে। হাজারি বাজার হইতে কেনা তরি-তরকারী, মাংস নিজেই কুটিয়া বাছিয়া লইয়া রান্না চাপাইয়া দিল। বর্ষাও যেন নামিয়াছে হিমালয় পাহাড় ভাঙিয়া। কাঠগুলা ভিজিয়া গিয়াছে–মাংস সে কয়লার জালে রাঁধিবে না। তাহার সে বিশেষ প্রণালীর মাংস রান্না কয়লার জ্বালে হইবে না।

সব রান্না শেষ হইতে বেলা দুইটা রাজিয়া গেল। তারপরে খরিদ্দার বাবুরা খাইতে বসিল। মাংস পরিবেশন করিবার অনেক পূর্বেই ওস্তাদ শিল্পীর গর্ব ও আত্মপ্রত্যয়ের সহিত হাজারি বুঝিয়াছে, আজ যে ধরনের মাংস রান্না হইয়াছে–ইহাদের ভাল না লাগিয়া উপায় নাই। হইলও তাই।

বাবুরা বেচু চক্কত্তিকে ডাকাইলেন, হাজারি ঠাকুরের সম্বন্ধে এমন সব কথা বলিলেন যে বেচু চক্কত্তিও যেন অস্বস্তি বোধ করিতে লাগিল সে কথা নিয়া। চাকরকে ছোট করিয়া রাখিয়া মনিবের সুবিধা আছে, তাহাকে বড় করিলেই সে পাইয়া বসিবে।

যাইবার সময় একজন বাবু হাজারিকে আড়ালে ডাকিয়া বলিলেন–তুমি এখানে কত পাও ঠাকুর।

–সাত টাকা আর খাওয়া-পরা।

–এই দুটো টাকা তোমাকে আমরা বকশিশ দিলাম–চমৎকার রান্না তোমার। যখন আবার এদিকে আসবো, তুমি আমাদের রেঁধে খাইও।

হাজারি আমি খুশি হইল। বকশিশ ইহারা হয়তো কিছু দিবেন সে আশা করিয়াছিল বটে, কি দু-টাকা দিবেন তা সে ভাবে নাই।

যাইবার সময় বেচু চক্কত্তির সামনে বাবুরা হাজারি রান্নার আর এক দফা প্রশংসা করিয়া গেলেন। আর একবার শীঘ্রই শিকারে আসিবেন এদিকে। তখন এখানে আসিয়া হাজারি ঠাকুরের হাতে মাংস না খাইলে তাহাদের চলিবেই না। বেশ হোটেল করেছেন চক্কত্তি মশায়।

বেচু চক্কত্তি বিনীত ভাবে কাঁচুমাচু হইয়া বলিল–আজ্ঞে বাবু মশায়েরা রাজসই লোক, সব দেখতে পাচ্ছেন, সব বুঝতে পাচ্ছেন। এই রাণাঘাট রেল-বাজারে হোটেল আছে অনেকগুলো, কিন্তু আপনাদের মত লোক যখনই আসেন, সকলেই দয়া করে এই গরীবের কুঁড়েতেই পায়ের ধূলো দিয়ে থাকেন। তা আসবেন, যখন আপনাদের ইচ্ছা হয়, আগে থেকে একখানা চিঠি দেবেন, সব মজুদ থাকবে আপনাদের জন্যে; বলবেন কলকাতায় ফিরে দু’চার জন আলাপী লোককে–যাতে এদিকে এলে তারাও এখানেই এসে ওঠেন। বাবু–তা আমার বামুনের মজুরীটা?…হেঁ-হেঁ–

–কত মজুরী দেবো?

–তা দিন বাবু একবেলার মজুরী আট আনা দিন।

বাবুরা আরও আট আনা পয়সা বেচুর হাতে দিয়া চলিয়া গেলেন।

বেচু হাজারী ঠাকুরকে ডাকিয়া বলিল–ঠাকুর আজ আর বেরিও না কোথাও। বেলা গিয়েচে। উনুনে আঁচ আর একটু পরেই দিতে হবে। পদ্ম কোথায়?

–পদ্মদিদি থালা বাসন বার করচে, ডেকে দেবো?

পদ্ম ঝি আজ যে মুখ ভার করিয়া আছে, হাজারি তাহা বুঝিয়াছিল। আর হোটেলে সকলের সামনে তাহার প্রশংসা করিয়া গিয়াছে বাবুরা, আজ আর কি তাহার মনে সুখ আছে? পদ্ম ঝির মনস্তুষ্টি করিবার জন্য তাহার ভাতের থালায় হাজারি বেশী করিয়া ভাত তরকারি এবং মাংস দিয়াছিল। পদ্ম ঝি কিছুমাত্র প্রসন্ন হইয়াছে বলিয়া মনে হইল না, মুখ যেমন ভার তেমনিই রহিল।

ভাতের থালা উঠাইয়া লইয়া পদ্ম ঝি হঠাৎ প্রশ্ন করিল– রাঁধসা মাংস আর কতটা আছে ঠাকুর?

বলিয়াই ডেকচির দিকে চাহিল। এমন চমৎকার মাংস কুসুমের বাড়ী কিছু দিয়া আসিবে (সে ব্রাহ্মণের বিধবা নয়, মাছ-মাংস খাইতে তাহার আপত্তি নাই) ভাবিয়া ডেকচিতে দেড় পোয়া আন্দাজ মাংস হাজারি রাখিয়া দিয়াছিল–পদ্ম ঝি কি তাহা দেখিতে পাইল?

পদ্ম দেখিয়াছে বুঝিয়া হাজারি বলিল–সামান্য একটু আছে।

–কি হবে ওটুকু? আমায় দাও না-আমার আজ ভাগ্নীজামাই আসবে–তুমি ত মাংস খাও না–

কুসুমের জন্য রাখা মাংস পদ্ম ঝিকে দিতে হইবে–যার মুখ দেখিতে ইচ্ছা করে না হাজারির! হাজারি মাংস খায় না তাহা নয়, হোটেলে মাংস রান্না হইলেই হাজারি নিজের ভাগের মাংস লুকাইয়া কুসুমকে দিয়া আসে–নিজেকে বঞ্চিত করিয়া। পদ্ম ঝি তাহা জানে, জানে বলিয়াই তাহাকে আঘাত করিয়া প্রতিশোধ লইবার ইচ্ছা উহার মনে জাগিয়াছে ইহাও হাজারি বুঝিল।

হাজারি বলিল–তোমায় তো দিলাম পদ্মদিদি, একটুখানি পড়ে আছে ডেকচির তলায় ওটুকু আর তুমি কি করবে?

–কি করবো বললুম, তা তোমার কানে গেল না? ভাগ্নীজামাই এসেছে শুনলে না? যা দিলে এতটুকুতে কি কুলুবে? ঢেলে দাও ওটুকু।

হাজারি বিপন্ন মুখে বলিল–আমি একটু রেখে দিইছি, আমার দরকার আছে।

পদ্ম ঝি ঘুরিয়া দাঁড়াইয়া শ্লেষের সুরে বলিল–কি দরকার? তুমি তো খাও না–কাকে দেবে শুনি?

হাজারি বলিল–দেবো–ও একজন একটু চেয়েছে–

–কে একজন?

–আছে–ও সে তুমি জানো না।

পদ্ম ঝি ভাতের থালা নামাইয়া হাত নাড়িয়া বলিল–না, আমি জানিনে। তা কি আর জানি? আর সে জানা-জানি, আমার দরকার নেই। হোটেলের জিনিস তুমি কাউকে দিতে পারবে না, তোমায় অনেকদিন বলে দিইছি। বেশ তুমি আমায় না দাও, চক্কত্তি মশায়ের শালাও আজ কলকাতা থেকে এসেছে–তার জন্যে মাংস বাটি করে আলাদা রেখে দাও–ওবেলা এসে খাবে এখন। আমি না পেতে পারি, সে হোটেলের মালিকের আপনার লোক, সে তো পেতে পারে?

বেচু চক্কত্তির এই শালাটিকে হাজারি অনেকবার দেখিয়াছে–মাসের মধ্যে দশ দিন আসিয়া ভগ্নীপতির বাড়ী পড়িয়া থাকে, আর কালাপেড়ে ধুতি পরিয়া টেরি কাটিয়া হোটেলে আসিয়া সকলের উপর কর্তৃত্ব চালায়–কথায় কথায় ঠাকুর-চাকরকে অপমান করে; চোখ রাঙায়, যেন হোটেলের মালিক নিজেই।

তাহাদের গ্রামের মেয়ে, দরিদ্ৰা কুসুম ভালটা মন্দটা খাইতে পাওয়া দূরে থাকুক, অনেক সময় পেটের ভাত জুটাইতে পারে না–তাহার জন্য রাখিয়া দেওয়া এত যত্নের মাংস শেষকালে সেই চালবাজ বার্ডসাই-খোর শালাকে দিয়া খাওয়াইতে হইবে–এ প্রস্তাব হাজারির মোটেই ভাল লাগিল না। কিন্তু সে ভালমানুষ এবং কিছু ভীতু ধরনের লোক, যাহাদের হোটেল, তাহারা যদি খাইতে চায়, হাজারি তাহা না দিয়া পারে কি করিয়া–অগত্যা হাজারিকে পদ্ম ঝিয়ের সামনে বড় জামবাটিতে ডেকচির মাংসটুকু ঢালিয়া রান্নাঘরের কুলুঙ্গিতে রেকাবি চাপা দিয়া রাখিয়া দিতে হইল।

সামান্য একটু বেলা আছে, হাজারি সেটুকু সময়ের মধ্যেই একবার নদীর ধারে ফাঁকা জায়গায় বেড়াইতে গেল।

আজ তাহার মনে আত্মপ্রত্যয় খুব বাড়িয়া গিয়াছে–দুইটি জিনিস আজ বুঝিয়াছে সে। প্রথম, ভাল রান্না সে ভুলিয়া যায় নাই, কলিকাতার বাবুরাও তাহার রান্না খাইয়া তারিফ করেন। দ্বিতীয়, পরের তাঁবে কাজ করিলে মানুষকে মায়া-দয়া বিসর্জন দিতে হয়।

আজ এমন চমৎকার রান্না মাংসটুকু সে কুসুমকে খাওয়াইতে পারিল না, খাওয়াইতে হইল তাহাদের দিয়া, যাহাদের সে দুই চক্ষু পাড়িয়া দেখিতে পারে না। কুসুম যেদিন কাঁথাখানি দিয়াছিল, সেদিন হইতে হাজারির কেমন একটা অদ্ভুত ধরনের স্নেহ পড়িয়াছে কুসুমের ওপর।

বয়সে তো সে মেয়ের সমান বটেই, কাজও করিয়াছে মেয়ের মতই। আজ যদি হাজারির হাতে পয়সা থাকিত, তবে সে বাপের স্নেহ কি করিয়া দেখাইতে হয়, দেখাইয়া দিত। অন্য কিছু দেওয়া তো দূরের কথা, নিজের হাতে অমন রান্না মাংসটুকুই সে কুসুমকে দিতে পারিল না।

ছেলেবেলাকার কথা হাজারির মনে হয়। তাহার মা গঙ্গাসাগর যাইবেন বলিয়া যোগাড়-যন্ত্র করিতেছেন–পাড়ার অনেক বৃদ্ধা ও প্রৌঢ়া বিধবাদের সঙ্গে। হাজারি তখন আট বছরের ছেলে–সেও ভীষণ বায়না ধরিল গঙ্গাসাগর সে না গিয়া ছাড়িবেই না। তাহার ঝুঁকি লইতে কেহই রাজী নয়। সকলেই বলিল–তোমার ও ছেলেকে কে দেখাশুনো করবে বাপু, অত ছোট ছেলে আর সেখানে নানা ঝক্কি–তাহলে তোমার যাওয়া হয় না।

হাজারির মা ছেলেকে ফেলিয়া গঙ্গাসাগরে যাইতে পারিলেন না বলিয়া তাঁর যাওয়াই হইল না। জীবনে আর কখনোই তাঁর সাগর দেখা হয় নাই, কিন্তু হাজারির মনে মায়ের এই স্বার্থত্যাগের ঘটনাটকু উজ্জ্বল অক্ষরে লেখা হইয়া আছে।

হাজারি ভাবিল-যাক গে, যদি কখনো নিজে হোটেল খুলতে পারি, তবে এই রাণাঘাটের বাজারে বসেই পদ্ম ঝিকে দেখাবো–তুই কোথায় আর আমি কোথায়! হাতে পয়সা থাকলে কালই না হোটেল খুলে দিতাম! কুসুমকে রোজ রোজ ভাল জিনিস খাওয়াবো আমার নিজের হোটেল হলে।

কতকগুলি বিষয় সে যে খুব ভাল শিখিয়াছে, সে বেশ বুঝিতে পারে। বাজার-করা হোটেলওয়ালার একটি অত্যন্ত দরকারী কাজ এবং শক্ত কাজ। ভাল বাজার করার উপরে হোটেলের সাফল্য অনেকখানি নির্ভর করে এবং ভাল বাজার করার মানেই হইতেছে সস্তায় ভাল জিনিস কেনা। ভাল জিনিসের বদলে সস্তা জিনিস–অথচ দেখিলে তাহাকে মোটেই খেলো বলিয়া মনে হইবে না–এমন দ্রব্য খুঁজিয়া বাহির করা। যেমন বাটা মাছ যেদিন বাজারে আক্রা–সেদিন ছ’আনা সের রেল-চালানী রাস মাছের পোনা কিনিয়া তাহাকে বাটা বলিয়া চালাইতে হইবে–হঠাৎ ধরা বড় কঠিন, কোনটা বাটার পোনা, কোনটা রাসের পোনা।

.

পরদিন হাজারি চূর্ণীর ঘাটে গিয়া অনেকক্ষণ বসিয়া রহিল। তাহার মন কাল হইতে ভাল নয়। পদ্ম ঝির নিকট ভাল ব্যবহার কখনও সে পায় নাই, পাইবার প্রত্যাশাও করে না। কিন্তু তবুও কাল সামান্য একটু রাধা মাংস লইয়া পদ্ম ঝি যে কাণ্ডটি করিল, তাহাতে সে মনোকষ্ট পাইয়াছে খুব বেশী। পরের চাকরি করিতে গেলে এমন হয়। কুসুমকে একটুখানি মাংস না দিতে পারিয়া তাহার কষ্ট হইয়াছে বেশী–অমন ভাল রান্না সে অনেক দিন করে নাই–অত আশার জিনিসটা কুসুমকে দিতে পারিলে তাহার মনটা খুশি হইত।

ভাল কাজ করিলেও চাকুরির উন্নতি তো দূরের কথা, ইহারা সুখ্যাতি পর্যন্ত করিতে জানে না। বরঞ্চ পদে পদে হেনস্থা করে। এক একবার ইচ্ছা হয় যদুবাবুর হোটেলে কাজ লইতে। কিন্তু সেখানেও যে এরকম হইবে না তাহার প্রমাণ কিছুই নাই। সেখানেও পদ্ম ঝি জুটিতে বিলম্ব হইবে না। কি করা যায়।

বেলা পড়িয়া আসিতেছে। আর বেশীক্ষণ বসা যায় না। বহু পাপ না করিলে আর কেহ হোটেলের রাঁধুনীগিরি করিতে আসে না। এখনি গিয়া ডেকচি না চড়াইলে পদ্ম ঝি এক ঝুড়ি কথা শুনাইয়া দিবে, এতক্ষণ উনুনে আঁচ দেওয়া হইয়া গিয়াছে।…কিন্তু ফিরিবার পথে সে কি মনে করিয়া কুসুমের বাড়ী গেল!

কুসুম আসন পাতিয়া দিয়া বলিল–বাবাঠাকুর আসুন, বড় সৌভাগ্য অসময়ে আপনার পায়ের ধূলো পড়লো।

হাজারি বলিল–দ্যাখ, কুসুম, তোর সঙ্গে একটা পরামর্শ করতে এলাম।

কুসুম সাগ্রহ-দৃষ্টিতে মুখের দিকে চাহিয়া বলিল–কি বাবাঠাকুর?

–আমার বয়েস ছেচল্লিশ হয়েছে বটে, কিন্তু আমার তত বয়েস দেখায় না, কি বলিস কুসুম? আমার এখনও বেশ খাটবার ক্ষমতা আছে, তুই কি বলিস?

হাজারির কথাবার্তার গতি কোনদিকে বুঝিতে না পারিয়া কুসুম কিছু বিস্ময়, কিছু কৌতুকের সুরে বলিল–তা–বাবাঠাকুর, তা তো বটেই। বয়েস আপনার এমন আর কি–কেন বাবাঠাকুর?

কুসুমের মনে একটা কথা উঁকি মারিতে লাগিল–বাবাঠাকুর আবার বিয়ে-টিয়ে করবার কথা ভাবচেন নাকি?

হাজারি বলিল–আমার বড় ইচ্ছে আছে কুসুম, একটা হোটেল করব নিজের নামে। পয়সা যদি হাতে কোনদিন জমাতে পারি, এ আমি নিশ্চয়ই করবো, তুই জানিস! পরের ঝাঁটা খেয়ে কাজ করতে আর ইচ্ছে করে না। আমি আজ দশ বছর হোটেলে কাজ করছি, বাজার কি করে করতে হয় ভাল করে শিখে ফেলেছি। চক্কত্তি মশায়ের চেয়েও আমি ভাল বাজার করতে পারি। মাখমপুরের হাট থেকে ফি হাটরা যদি তরিতরকারী কিনে আনি তবে রাণাঘাটের বাজারের চেয়ে টাকায় চার আনা ছ’আনা সস্তা পড়ে। এ ধরো কম লাভ নয় একটা হোটেলের ব্যাপারে। বাজার করবার মধ্যেই হোটেলের কাজের আদ্ধেক লাভ। আমার খুব মনে জোর আছে কুসুম, টাকা পয়সা হাতে যদি কখনো পড়ে, তবে হোটেল যা চালাবো, বাজারের সেরা হোটেলে হবে, তুই দেখে নিস।

কুসুম হাজারি ঠাকুরের এ দীর্ঘ বক্তৃতা অবাক হইয়া শুনিতেছিল–সে হাজারিকে বাবার মত দেখে বলিয়াই মেয়ের মত বাবার প্রতি সর্বপ্রকার কাল্পনিক গুণ ও জ্ঞানের আরোপ করিয়া আসিতেছে। হোটেলের ব্যাপারে সে বিশেষ কিছু বুঝুক না বুঝুক, বাবাঠাকুর যে বুদ্ধিমান, তাহা সে হাজারির বক্তৃতা হইতে ধারণা করিয়া লইল।

কিছুক্ষণ পরে কি ভাবিয়া সে বলিল–আমার এক জোড়া রুলি ছিল, এক গাছা বিক্রী ক’রে দিয়েছি আমার ছোট ছেলের অসুখের সময় আর বছর। আর এক গাছা আছে। বিক্রী করলে যাট-সত্তর টাকা হবে। আপনি নেবেন বাবাঠাকুর? ওই টাকা নিয়ে হোটেল খোলা হবে আপনার।

হাজারি হাসিয়া বলিল–দূর পাগলী! ষাট টাকায় হোটেল হবে কি রে?

–কত টাকা হলে হয়?

–অন্ততঃ দুশো টাকার কম তো নয়। তাতেও হবে না।

–আচ্ছা, হিসেব করে দেখুন না বাবাঠাকুর।

–হিসেব করে দেখব কি, হিসেব আমার মুখে মুখে। ধরো গিয়ে দুটো বড় ডেকচি, ছোট ডেকচি তিনটে। থালা-বাসন এক প্রস্থ। হাতা, খুন্তি, বেড়ি, চামচে, চায়ের বাসন। বাইরে গদির ঘরের একখানা তক্তপোশ, বিছানা, তাকিয়া। বাক্স, খেরো বাঁধানো খাতা দুখানা। বালতি, লণ্ঠন, চাকি, বেলুন–এই সব নানান নটখটি জিনিস কিনতেই তো দুশো টাকার ওপর বেরিয়ে যাবে। পাঁচদিনের বাজার খরচ হাতে করে নিয়ে নামতে হবে। চাকর ঠাকুরের দু’মাসের মাইনে হাতে রেখে দিতে হয়–যদি প্রথম দু’মাস না হলো কিছু, ঠাকুর চাকরের মাইনে আসবে কোথা থেকে? সে-সব যাক-গে, তা ছাড়া তোর টাকা নেবোই বা কেন?

কুসুম রিদ্ধ স্বরে বলিল–আমার থাকতো যদি তবে আপনি নিতেন না কেন–ব্রাহ্মণের সেবায় যদি লাগে ও-টাকা, তবে ও-টাকার ভাগ্যি বাবাঠাকুর। সে ভাগ্যি থাকলে তো হবে, আমার অত টাকা যখন নেই, তখন আর সে কথা বলচি কি করে বলুন। যা আছে, ওতে যদি কখনো-সখনো কোন দরকার পড়ে আপনার মেয়েকে জানাবেন।

হাজারি উঠিল। আর এখানে বসিয়া দেরি করিলে চলিবে না। বলিল–না রে কুসুম, এতে আর কি হবে। আমি যাই এখন।

কুসুম বলিল– একটু কিছু মুখে না দিলে মেয়ের বাড়ী থেকে কি করে উঠবেন বাবাঠাকুর, বসুন আর একটু। আমি আসছি।

কুসুম এত দ্রুত ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল, যে হাজারি ঠাকুর প্রতিবাদ করিবার অবসর পর্যন্ত পাইল না। একটু পরে কুসুম ঘরের মধ্যে একখানা আসন আনিয়া পাতিল এবং মেজের উপর জলের হাত বুলাইয়া লইয়া আবার বাহিরে গেল। কিছুক্ষণ পরে একবাটি দুধ ও একখানা রেকাবিতে পেঁপে কাটা, আমের টিকলি ও দুটি সন্দেশ তানিয়া আসনের সামনে মেজের উপর রাখিয়া বলিল–একটু জল খান, বসুন এসে, আমি খাবার জল আনি। হাজারি আসনের উপর বসিল। কুসুম ঝকঝকে করিয়া মাজা একটা কাঁচের গেলাসে জল আনিয়া রেকাবির পাশে রাখিয়া সামনে দাঁড়াইয়া রহিল।

খাইতে খাইতে হাজারির মনে পড়িল সেদিনকার সেই মাংসের কথা। মেয়ের মত স্নেহ-যত্ন করে কুসুম, তাহারই জন্য তুলিয়া রাখা মাংস কিনা খাওয়াইতে হইল চক্কত্তি মহাশয়ের গাঁজাখোর শালাকে দিয়া শুধু ওই পদ্ম ঝিয়ের জন্যে। দাসত্বের এই তো সুখ!

হাজারি বলিল–তুই আমার মেয়ের মতন কুসুম-মা।

কুসুম হাসিয়া বলিল–মেয়ের মতন কেন বাবাঠাকুর, মেয়েই তো।

–ঠিক, মেয়েই তো। মেয়ে না হোলে বাপের এত যত্ন কে করে?

–যত্ন আর কি করেছি, সে ভাগ্যি ভগবান কি আমায় দিয়েছেন। একে কি যত্ন করা বলে? কাঁথাখানা পেতে শুচ্চেন বাবাঠাকুর?

–তা শুচ্চি বই কি রে। রোজ তোর কথা মনে হয় শোবার সময়। মনে ভাবি কুসুম এখানা দিয়েছে। ছেঁড়া মাদুরের কাটি ফুটে ফুটেঁপিঠে দাগ হয়ে গিয়েছিল। পেতে শুয়ে বেঁচেছি।

–আহা, কি যে বলেন! না, সন্দেশ দুটোই খেয়ে ফেলুন, পায়ে পড়ি। ও ফেলতে পারবেন না।

–কুসুম, তোর জন্যে না রেখে খেতে পারি কিছু মা? ওটা তোর কাছে রেখে দিলাম।

কুসুম লজায় চুপ করিয়া বহিল। হাজারি আসন হইতে উঠিয়া পড়িলে বলিল–পান আনি, দাঁড়ান।

তাহার পর সামনে দরজা পর্যন্ত আগাইয়া দিতে আসিয়া বলিল–আমার ও রুলি গাছা রইল তোলা আপনার জন্যে, বাবাঠাকুর। যখন দরকার হয়, মেয়ের কাছ থেকে নেবেন কিন্তু।

সেদিন হোটেলে ফিরিয়া হাজারি দেখিল, প্রায় পনেরো সের কি আধ মণ ময়দা চাকর আর পদ্ম ঝি মিলিয়া মাখিতেছে।

ব্যাপার কি! এত লুচির ময়দা কে খাইবে?

পদ্ম ঝি কথার সঙ্গে বেশ খানিকটা ঝাঁজ মিশাইয়া বলিল–হাজারি ঠাকুর, তোমার যা যা রাঁধবার আগে সেরে নাও–তারপর এই লুচিগুলো ভেযে ফেলতে হবে। আচার্য-পাড়ায় মহাদেব ঘোষালের বাড়ীতে খাবার যাবে, তারা অর্ডার দিয়ে গেছে সাড়ে ন’টার মধ্যে চাই, বুঝলে।

হাজারি ঠাকুর অবাক হইয়া বলিল–সাড়ে ন’টার মধ্যে ওই আধ মণ ময়দা ভেজে পাঠিয়ে দেবো, আবার হোটেলের রান্না রাঁধবো! কি যে বল পদ্মদিদি, তা কি করে হবে? রতন ঠাকুকে বল না লুচি ভেঙে দিক, আমি হোটেলের রান্না বাঁধবো।

পদ্ম ঝি চোখ রাঙাইয়া ছাড়া কথা বলে না। সে গরম হইয়া ঝঙ্কার দিয়া বলিল– তোমার ইচ্ছে বা খুশিতে এখানকার কাজ চলবে না। কর্তা মশায়ের হুকুম। আমায় যা বলে গেছেন তোমায় বললাম, তিনি বড় বাজারে বেরিয়ে গেলেন–আসতে রাত হবে। এখন তোমার মর্জি–করো আর না করো।

অর্থাৎ না করিয়া উপায় নাই। কিন্তু ইহাদের এই অবিচারে হাজারির চোখে প্রায় জল আসিল। নিছক অবিচার ছাড়া ইহা অন্য কিছু নহে। রতন ঠাকুরকে দিয়া ইহারা সাধারণ রান্না অনায়াসেই করাইতে পারিত, কিন্তু পদ্ম ঝি তাহা হইলে খুশি হইবে না। সে যে কি বিষ-চক্ষে পড়িয়াছে পদ্ম ঝিয়ের! উহাকে জব্দ করিবার কোনো ফাঁকই পদ্ম ছাড়ে না।

ভীষণ আগুনের তাতের মধ্যে বসিয়া রতন ঠাকুরের সঙ্গে দৈনিক রান্না কাৰ্যেতেই প্রায় ন’টা বাজিয়া গেল। পদ্ম ঝি তাহার পর ভীষণ তাগাদা লাগাইল লুচি ভাজাতে হাত দিবার জন্য। পদ্ম নিজে খাটিতে রাজি নয়, সে গেল খরিদ্দারদের খাওয়ার তদারক করিতে। আজ আবার হাটবার, বহু ব্যাপারী খরিদ্দার। রতন ঠাকুর তাহাদের পরিবেশন করিতে লাগিল। হাজারি এক ছিলিম তামাক খাইয়া লইয়াই আবার আগুনের তাতে বসিয়া গেল লুচি ভাজিতে।

আধঘণ্টা পরে–তখন পাঁচ সের ময়দাও ভাজা হয় নাই–পদ্ম আসিয়া বলিল–ও ঠাকুর, লুচি হয়েছে? ওদের লোক এসেছে নিতে।

হাজারি বলিল–না এখনো হয়নি পদ্মদিদি। একটু ঘুরে আসতে বল।

–ঘুরে আসতে বললে চলবে কেন? সাড়ে ন’টার মধ্যে ওদের খাবার তৈরি করে রাখতে হবে বলে গেছে। তোমায় বলিনি সেকথা?

–বল্লে কি হবে পদ্মদিদি? মন্তরে ভাজা হবে আধ মণ ময়দা? ন’টার সময় তো উনুনে ব্ৰহ্মার নেচি ফেলেচি–জিগ্যেস করো মতিকে।

–সে সব আমি জানিনে। যদি ওরা অর্ডার ফেরত দেয়, বোঝাপড়া ক’রো কর্তার সঙ্গে, তোমার মাইনে থেকে আধ মন ময়দা আর দশ সের ঘি র দাম একমাসে তো উঠবে না, তিন মাসে ওঠাতে হবে।

হাজারি দেখিল, কথা কাটাকাটি করিয়া লাভ নাই। সে নীরবে লুচি ভাজিয়া যাইতে লাগিল। হাজারি ফাঁকি দেওয়া অভ্যাস করে নাই–কাজ করিতে বসিয়া শুধু ভাবে কাজ করিয়া যাওয়াই তাহার নিয়ম–কেউ দেখুক বা না-ই দেখুক। লুচি ঘিয়ে ডুবাইয়া তাড়াতাড়ি তুলিয়া ফেলিলে শীঘ্র শীঘ্র কাজ চুকিয়া যায় বটে, কিন্তু তাহাতে লুচি কাঁচা থাকিয়া যাইবে। এজন্য সে ধীরে ধীরে সময় লইয়া লুচি তুলিতে লাগিল। পদ্ম ঝি একবার বলিল– অত দেরি করে খোলা নামাচ্ছ কেন ঠাকুর? হাত চালাও না–অত লুচি ডুবিয়ে রাখলে কড়া হয়ে যাবে–

হাজারি ভাবিল, একবার সে বলে যে রান্নার কাজ পদ্ম ঝিয়ের কাছে তাহাকে শিখিতে হইবে না, লুচি ডুবাইলে কড়া কি নরম হয় সে ভালই জানে, কিন্তু তখনই সে বুঝিল, পদ্ম ঝি কেন একথা বলিতেছে।

দশ সের ঘি হইতে জলতি বাদে যাহা বাকী থাকিবে পদ্ম ঝিয়ের লাভ। সে বাড়ী লইয়া যাইবে লুকাইয়া। কর্তামশায় পদ্ম ঝিয়ের বেলায় অন্ধ। দেখিয়াও দেখেন না।

হাজাৰি ভাবিল, এই সব জুয়াচুরির জন্য হোটেলের দুর্নাম হয়। খদ্দেরে পয়সা দেবে, তারা কাঁচা লুচি খাবে কেন? দশ সের ঘিয়ের দাম তো তাদের কাছ থেকে আদায় হয়েছে, তবে তা থেকে বাঁচানোই বা কেন? তাদের জিনিসটা যাতে ভাল হয় তাই তো দেখতে হবে? পদ্ম ঝি বাড়ী নিয়ে যাবে বলে তারা দশ সের ঘিয়ের ব্যবস্থা করে নি।

পরক্ষণেই তাহার নিজের স্বপ্নে সে ভোর হইয়া গেল।

এই রেল-বাজারেই সে হোটেল খুলিবে। তাহার নিজের হোটেল। ফাঁকি কাহাকে বলে, তাহার মধ্যে থাকিবে না। খদ্দের যে জিনিসের অর্ডার দিবে, তাহার মধ্যে চুরি সে করিবে না। খদ্দের সন্তুষ্ট করিয়া ব্যবসা। নিজের হাতে রাঁধিবে, খাওয়াইয়া সকলকে সন্তুষ্ট রাখিবে। চুরি-জুয়াচুরির মধ্যে সে নাই।

লুচি ভাজা ঘিয়ের বুদ্বুদের মধ্যে হাজারি ঠাকুর যেন সেই ভবিষ্যৎ হোটেলের ছবি দেখিতে পাইতেছে। প্রত্যেক ঘিয়ের বুদ্বুদটাতে। পদ্ম ঝি সেখানে নাই, বেচু চক্কত্তির গাঁজাখোর ও মাতাল শালাও নাই। বাহিরে গদির ঘরে দিব্য ফর্সা বিছানা পাতা, খদ্দের যতক্ষণ ইচ্ছা বিশ্রাম করুক, তামাক খাইতে ইচ্ছা করে থাক, বাড়তি পয়সা আর একটিও দিতে হইবে না। দুইটা করিয়া মাছ, হপ্তায় তিন দিন মাংস বাঁধা-খদ্দেরদের। এসব না করিয়া শুধু ইষ্টিশনের প্লাটফর্মে–হি-ই-ইন্দু হোটেল, হি-ই-ই-ন্দু হোটেল, বলিয়া মতি চাকরের মত চেঁচাইয়া গলা ফাটাইলে কি খদ্দের ভিড়িবে?

পদ্ম ঝি আসিয়া বলিল–ও ঠাকুর, তোমার হোল? হাত চালিয়ে নিতে পাচ্ছ না? বাবুদের নোক যে বসে আছে।

বলিয়াই ময়দার বারকোশের দিকে চাহিয়া দেখিল, বেলা লুচি যতগুলি ছিল, হাজারি প্রায় সব খোলায় চাপাইয়া দিয়াছে–খান পনেরো কুড়ির বেশী বারকোশে নাই। মতি চাকর পদ্ম ঝিকে আসিতে দেখিয়া তাড়াতাড়ি হাত চালাইতে লাগিল।

পদ্ম ঝি বলিল–তোমার হাত চলচে না, না? এখনো দশ সের ময়দার তাল ডাঙায়, ওই রকম করে লুচি বেললে কখন কি হবে?

হাজারি বলিল–পদ্মদিদি, রাত এগারোটা বাজবে ওই লুচি বেলতে আর এক হাতে ভাজতে। তুমি বেলবার লোক দাও।

পদ্ম ঝি মুখ নাড়িয়া বলিল–আমি ভাড়া করে আনি বেলবার লোক তোমার জন্যে। ও আমার বাবু রে! ভাজতে হয় ভাজো, না হয় না ভাজো গে–ফেরত গেলে তখন কর্তামশায় তোমার সঙ্গে বোঝাপড়া করবেন এখন।

পদ্ম ঝি চলিয়া গেল।

মতি চাকর বলিল–ঠাকুর, তুমি লুচি ভেজে উঠতে পারবে কি করে? লুচি পোড়াবে না। এত ময়দার তাল আমি বেলবো কখন বলো।

হঠাৎ হাজারির মনে হইল, একজন মানুষ এখনি তাহাকে সাহায্য করিতে বসিয়া যাইত–কুসুম! কিন্তু সে গৃহস্থের মেয়ে, গৃহস্থের ঘরের বৌ–তাহাকে তো এখানে আনা যায় না। যদিও ইহা ঠিক, খবর পাঠাইয়া তাহার বিপদ জানাইলে কুসুম এখনি ছুটিয়া আসিত।

তারপর একঘণ্টা হাজারি অন্য কিছু ভাবে নাই, কিছু দেখে নাই–দেখিয়াছে শুধু লুচির কড়া, ফুটন্ত ঘি, ময়দার তাল আর বাখারির সরু আগায় ভাজিয়া তোলা রাঙ্গা রাঙ্গা লুচির গোছা–তাহা হইতে গরম ঘি ঝরিয়া পড়িতেছে। ভীষণ আগুনের তাত, মাজা পিঠ বিষম টনটন করিতেছে, ঘাম ঝরিয়া কাপড় ও গামছা ভিজিয়া গিয়াছে, এক ছিলিম তামাক খাইবারও অবকাশ নাই–শুধু কাঁচা লুচি কড়ায় ফেলা এবং ভাজিয়া তুলিয়া ঘি ঝরাইয়া পাশের ধামাতে রাখা।

রাত দশটা।

মুর্শিদাবাদের গাড়ী আসিবার সময় হইল।

মতি চাকর বলিল–আমি একবার ইষ্টিশনে যাই ঠাকুরমশায়। টেরেনের টাইম হয়েছে। খদ্দের না আনলে কাল কর্তামশায়ের কাছে মার খেতে হবে। একটা বিড়ি খেয়ে যাই।

ঠিক কথা, সে খানিকক্ষণ প্লাটফর্মে পায়চারি করিতে করিতে ‘হি-ই-ই- হোটেল’ ‘হি-ই-ই-দু হোটেল’ বলিয়া চেঁচাইবে। মুর্শিদাবাদের ট্রেন আসিতে আর মিনিট পনেরো বাকী।

হাজারি বলিল–একা আমি বেলবো আর ভাজবো। তুই কি খেপলি মতি? দেখলি তো এদের কাণ্ড। রতনঠাকুর সরে পড়েছে, পদ্মদিদিও বোধ হয় সরে পড়েছে। আমি একা কি করি?

মতি বলিল–তোমাকে পদ্মদিদি দুচোখে দেখতে পারে না। কারো কাছে বোলো না ঠাকুর–এ সব তারই কারসাজি। তোমাকে জব্দ করবার মতলবে এ কাজ করেচে। আমি যাই, নইলে আমার চাকরি থাকবে না।

মতি চলিয়া গেল। অন্ততঃ পাঁচ সের ময়দার তাল তখনও বাকী। লেচি পাকানো সে-ও প্রায় দেড় সের–হাজারি গুণিয়া দেখিল ষোল গণ্ডা লেচি। অসম্ভব! একজন মানুষের দ্বারা কি করিয়া রাত বারোটার কমে বেলা এবং ভাজা দুই কাল হইতে পারে!

মতি চলিয়া যাইবার সময় যে বিড়িটা দিয়া গিয়াছিল সেটি তখনও ফুরায় নাই–এমন সময় পদ্ম উঁকি মারিয়া বলিল–কেবল বিড়ি খাওয়া আর কেবল বিড়ি খাওয়া! ওদিকে বাবুর বাড়ী থেকে নোক দুবার ফিরে গেল–তখনি তো বলেচি হাজারি ঠাকুরকে দিয়ে এ কাজ হবে না–বলি বিড়িটা ফেলে কাজে হাত দেও না, রাত কি আর আছে?

হাজারি ঠাকুর সত্যই কিছু অপ্রতিভ হইয়া বিড়ি ফেলিয়া দিল। পদ্ম ঝিয়ের সামনে সে একথা বলিতে পারিল না যে, লুচি বেলিবার লোক নই। আবার সে লুচি ভাজিতে আরম্ভ করিয়া দিল একাই।

রাত এগারোটার বেশী দেরি নাই। হাজারির এখন মনে হইল যে, সে আর বসিতে পারিতেছে না। কেবলই এই সময়টা মনে আসিতেছিল দুটি মুখ। একটি মুখ তাহার নিজের মেয়ে টেঁপির–বছর বারো বয়স, বাড়ীতে আছে; প্রায় পাঁচ ছ’মাস তার সঙ্গে দেখা হয় নাই–আর একটি মুখ কুসুমের। ওবেলা কুসুমের সেই যত্ন করিয়া বসাইয়া জল খাওয়ানো…তার সেই হাসিমুখ …টেঁপির মুখ আর কুসুমের মুখ এক হইয়া গিয়াছে…লুচি ও ঘিয়ের বুদ্বুদে সে তখনও যেন একখানা মুখই দেখিতে পাইতেছে–টেঁপি ও কুসুম দুইয়ে মিলিয়া এক…ওরা আজ যদি দু’জনে এখানে থাকিত। ওদিকে কুসুম বসিয়া হাসিমুখে লুচি বেলিতেছে এদিকে টেঁপি…

–ঠাকুর!

স্বয়ং কর্তামশায়, বেচু চক্কত্তি। পিছনে পদ্ম ঝি। পদ্ম ঝি বলিল–ও গাঁজাখোর ঠাকুরকে দিয়ে হবে না আপনাকে তখুনি বলিনি বাবু? ও গাঁজা খেয়ে বুঁদ হয়ে আছে, দেখচো না? কাজ এগুবে কোত্থেকে!

হাজারি তটস্থ হইয়া আরও তাড়াতাড়ি লুচি খোলা হইতে তুলিতে লাগিল। বাবুদের লোক আসিয়া বসিয়া ছিল। পদ্ম ঝি যে লুচি ভাজা হইয়াছিল, তাহাদের ওজন করিয়া দিল কর্তাবাবুর সামনে। পাঁচ সের ময়দার লুচি বাকী থাকিলেও তাহারা লইল না, এত রাত্রে লইয়া গিয়া কোনো কাজ হইবে না।

বেচু চক্কত্তি হাজৰিকে বলিলেন–এই ঘি আর ময়দার দাম তোমার মাইনে থেকে কাটা যাবে। গাঁজাখোর মানুষকে দিয়ে কি কাজ হয়?

হাজারি বলিল–আপনার হোটেলে সব উল্টো বন্দোবস্ত বাবু। কেউ তো বেলে দিতে আসেনি এক মতি চাকর ছাড়া। সেও গাড়ীর টাইমে ইষ্টিশনে খদ্দের আনতে গেল, আমি কি করব বাবু।

বেচু চক্কত্তি বলিলেন–সে সব শুনচি নে ঠাকুর। ওর দাম তুমি দেবে। খদ্দের অর্ডার ফেরত দিলে সে মাল আমি নিজের ঘর থেকে লোকসান দিতে পারিনে, আর মাখা নেচি কাটা ময়দা।

হাজারি ভাবিল, বেশ, তাহাকে যদি এদের দাম দিতে হয়, লুচি ভাজিয়া সে নিজে লইবে। রাত সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত খাটিয়া ও মতি চাকরকে কিছু অংশ দিবার জন্য লোভ দেখাইয়া তাহাকে দিয়া লুচি বেলাইয়া সব ময়দা ভাজিয়া তুলিল। মতি তাহার অংশ লইয়া চলিয়া গেল। এখনও তিন চার বুড়ি লুচি মজুত।

পদ্ম ঝি উঁকি মারিয়া বলিল–লুচি ভাজচো এখনও বসে? আমাকে খানকতক দাও দিকি–

বলিয়া নিজেই একখানা গামছা পাতিয়া নিজের হাতে খান পঁচিশ-ত্রিশ গরম লুচি তুলিয়া লইল। হাজারি মুখ ফুটিয়া বারণ করিতে পারিল না। সাহসে কুলাইল না।

অনেক রাত্রে সুপ্তোত্থিতা কুসুম চোখ মুছিতে মুছিতে বাহিরের দরজা খুলিয়া সম্মুখে মস্ত এক পোঁটলা-হাতে-ঝোলানো অবস্থায় হাজারি ঠাকুরকে দেখিয়া বিস্ময়ের সুরে বলিল–কি বাবাঠাকুর, কি মনে করে এত রাত্রে?…

হাজারি বলিল–এতে লুচি আছে মা কুসুম। হোটেলে লুচি ভাজতে দিয়েছিল খদ্দেরে। বেলে দেবার লোক নেই–শেষকালে খদ্দের পাঁচ সের ময়দার লুচি নিলে না, কর্তাবাবু বলেন আমায় তার দাম দিতে হবে। বেশ আমায় দাম দিতে হয় আমিই নিয়ে নিই। তাই তোমার জন্যে বলি নিয়ে যাই, কুসুমকে তো কিছু দেওয়া হয় না কখনো। রাত বড্ড হয়ে গিয়েচে– ঘুমিয়েছিলে বুঝি? ধর তো মা বোঁচকাটা রাখো গে যাও।

কুসুম বোঁচকাটা হাজারির হাত হইতে নামাইয়া লইল। সে একটু অবাক হইয়া গিয়াছে, বাবাঠাকুর পাগল, নতুবা এত রাত্রে–(তাহার এক ঘুম হইয়া গিয়াছে–), এখন আসিয়াছে লুচির বোঁচকা লইয়া।

হাজারি বলিল, আমি যাই মা–লুচি গরম আর টাটকা, এই ভেজে তুলিচি। তুমি খানকতক খেয়ে ফেলো গিয়ে এখনি। কাল সকালে বাসি হয়ে যাবে। আর ছেলেপিলেদের দাও গিয়ে। কত আর রাত হয়েচে– সাড়ে বারোটার বেশী নয়।

সেদিন ছিল বেশ বর্ষা।

হাজারি দেখিল, হোটেলে গদির ঘরে অনেকগুলি ভদ্রলোক বসিয়া আছে। অন্যদিন এ ধরনের খদ্দের এ হোটেলে সাধারণতঃ আসে না–হাজারি ইহাদের দেখিয়া একটু বিস্মিত হইল।

বেচু চক্কত্তি ডাকিল–হাজারি ঠাকুর, এদিকে এস–হাজারি গদির ঘরে দরজায় আসিয়া দাঁড়াইলে ভদ্রলোকদের একজন বলিলেন–এই ঠাকুরটির নাম হাজারি?

বেচু চক্কত্তি বলিল–হাঁ বাবু, এরই নাম হাজারি।

বাবুটি বলিলেন–এর কথাই শুনেচি। ঠাকুর তুমি আজ বর্ষার দিনে আমাদের মাংস পোলাও রেঁধে ভাল করে খাওয়াতে পারবে? তোমার আলাদা মজুরী যা হয় দেবো।

বেচু বলিল–ওকে আলাদা মজুরী দেবেন কেন বাবু, আপনাদের আশীর্বাদে আমার হোটেলের নাম অনেক দূর অবধি লোকে জানে। ও আমারই ঠাকুর, ওকে কিছু দিতে হবে না। আপনারা যা হুকুম করবেন তা ও করবে।

এই সময় পদ্ম ঝি বেচু চক্কত্তির ডাকে ঘরে ঢুকিল।

বেচু চক্কত্তি কিছু বলিবার পূর্বে জনৈক বাবু বলিল–ঝি, আমাদের একটু চা ক’রে খাওয়াও তো এই বর্ষার দিনটাতে। না হয় কোনো দোকান থেকে একটু এনে দাও। বুঝলেন চক্কত্তি মশায়। আপনার হোটেলের নাম অনেক দূর পর্যন্ত যে গিয়েছে বল্লেন–সে কথা মিথ্যা নয়। আমরা যখন আজ শিকারে বেরিয়েছি, তখন আমার পিসতুতো ভাই বলে দিয়েছিল, রাণাঘাট যাচ্চ, শিকার করে ফেরবার পথে রেল-বাজারের বেচু চক্কত্তির হোটেলের হাজারি ঠাকুরের হাতে মাংস খেয়ে এসো। তাই আজ সারাদিন জলায় আর বিলে পাখী মেয়ে বেড়িয়ে বেড়িয়ে ভাবলাম, ফিরবার গাড়ী তো রাত দশটায়। তা এ বর্ষার দিনে গরম গরম মাংস একটু খেয়েই যাই। মজুরী কেন দেবো না চক্কত্তি মশায়? ও আমাদের রান্না করুক, আমরা ওকে খুশি করে দিয়ে যাবো। ওর জন্যেই তো এখানে আসা। কথা শুনিয়া হাজারি অত্যন্ত খুশি হইয়া উঠিল, আরও সে খুশি হইল এই ভাবিয়া যে, চক্কত্তি মশায়ের কানে কথাগুলি গেল–তাহার চাকুরির উন্নতি হইতে পারে। মনিবের সুনজরে পড়িলে কি না সম্ভব? খুশির চোটে ইহা সে লক্ষ্যই করিল না যে, পদ্ম ঝি তাহার প্রশংসা শুনিয়া এদিকে হিংসায় নীলবর্ণ হইয়া উঠিয়াছে।

বাবুরা হোটেলের উপর নির্ভর করিল না–তাহারা জিনিসপত্র নিজেরাই কিনিয়া আনিল। হাজারি ঠাকুর মাংস রাঁধিবার একটি বিশেষ প্রণালী জানে, মাংসে একটুকু জল না দিয়া নেপালী ধরনের মাংস রান্নার কায়দা সে তাহাদের গ্রামের নেপাল-ফেরত ডাক্তার শিবচরণ গাঙ্গুলীর স্ত্রীর নিকট অনেকদিন আগে শিখিয়াছিল। কিন্তু হোটেলে দৈনন্দিন খাদ্য তালিকার মধ্যে মাংস কোনদিনই থাকে না–তবে বাধা খরিদ্দারগণের মনস্তুষ্টির জন্য মাসে একবার বা দুবার মাংস দেওয়ার ব্যবস্থা আছে বটে-সে রান্নার মধ্যে বিশেষ কৌশল দেখাইতে গেলে চলে না, বা হাজারির ইচ্ছাও করে না–যেমন ভাল শ্রোতা না পাইলে গায়কের ভাল গান করিতে ইচ্ছা করে না–তেমনি।

হাজারি ঠিক করিল, পদ্ম ঝি তাহাকে দুই চক্ষু পাড়িয়া যেমন দেখিতে পারে না–তেমনি আজ মাংস রাঁধিয়া সকলের বাহবা লইয়া পদ্ম ঝির চোখে আঙুল দিয়া দেখাইয়া দিবে, তাহাকে যত ছোট মনে করে ও, তত ছোট সে নয়। সেও মানুষ, সে অনেক বড় মানুষ।

ভাল যোগাড় না দিলে ভাল রান্না হয় না। পদ্ম ঝি যোগাড় দিবে না এ জানা কথা। হোটেলের অন্য উড়ে বামুনটিকে বলিতে পারা যায় না–কারণ সে-ই হোটেলের সাধারণ রান্না রাঁধিবে।

একবার ভাবিল–কুসুমকে আনবো?

পরক্ষণেই স্থির করিল, তার দরকার নাই। লোকে কে কি বলিবে, পদ্ম ঝি তো বঁটি পাতিয়া কুটিবে কুসুমকে। যাক, নিজেই যাহা হয় করিয়া লইবে এখন।

বেলা হইয়াছে। হাজারি বাজার হইতে কেনা তরি-তরকারী, মাংস নিজেই কুটিয়া বাছিয়া লইয়া রান্না চাপাইয়া দিল। বর্ষাও যেন নামিয়াছে হিমালয় পাহাড় ভাঙিয়া। কাঠগুলা ভিজিয়া গিয়াছে–মাংস সে কয়লার জালে রাঁধিবে না। তাহার সে বিশেষ প্রণালীর মাংস রান্না কয়লার জ্বালে হইবে না।

সব রান্না শেষ হইতে বেলা দুইটা রাজিয়া গেল। তারপরে খরিদ্দার বাবুরা খাইতে বসিল। মাংস পরিবেশন করিবার অনেক পূর্বেই ওস্তাদ শিল্পীর গর্ব ও আত্মপ্রত্যয়ের সহিত হাজারি বুঝিয়াছে, আজ যে ধরনের মাংস রান্না হইয়াছে–ইহাদের ভাল না লাগিয়া উপায় নাই। হইলও তাই।

বাবুরা বেচু চক্কত্তিকে ডাকাইলেন, হাজারি ঠাকুরের সম্বন্ধে এমন সব কথা বলিলেন যে বেচু চক্কত্তিও যেন অস্বস্তি বোধ করিতে লাগিল সে কথা নিয়া। চাকরকে ছোট করিয়া রাখিয়া মনিবের সুবিধা আছে, তাহাকে বড় করিলেই সে পাইয়া বসিবে।

যাইবার সময় একজন বাবু হাজারিকে আড়ালে ডাকিয়া বলিলেন–তুমি এখানে কত পাও ঠাকুর।

–সাত টাকা আর খাওয়া-পরা।

–এই দুটো টাকা তোমাকে আমরা বকশিশ দিলাম–চমৎকার রান্না তোমার। যখন আবার এদিকে আসবো, তুমি আমাদের রেঁধে খাইও।

হাজারি আমি খুশি হইল। বকশিশ ইহারা হয়তো কিছু দিবেন সে আশা করিয়াছিল বটে, কি দু-টাকা দিবেন তা সে ভাবে নাই।

যাইবার সময় বেচু চক্কত্তির সামনে বাবুরা হাজারি রান্নার আর এক দফা প্রশংসা করিয়া গেলেন। আর একবার শীঘ্রই শিকারে আসিবেন এদিকে। তখন এখানে আসিয়া হাজারি ঠাকুরের হাতে মাংস না খাইলে তাহাদের চলিবেই না। বেশ হোটেল করেছেন চক্কত্তি মশায়।

বেচু চক্কত্তি বিনীত ভাবে কাঁচুমাচু হইয়া বলিল–আজ্ঞে বাবু মশায়েরা রাজসই লোক, সব দেখতে পাচ্ছেন, সব বুঝতে পাচ্ছেন। এই রাণাঘাট রেল-বাজারে হোটেল আছে অনেকগুলো, কিন্তু আপনাদের মত লোক যখনই আসেন, সকলেই দয়া করে এই গরীবের কুঁড়েতেই পায়ের ধূলো দিয়ে থাকেন। তা আসবেন, যখন আপনাদের ইচ্ছা হয়, আগে থেকে একখানা চিঠি দেবেন, সব মজুদ থাকবে আপনাদের জন্যে; বলবেন কলকাতায় ফিরে দু’চার জন আলাপী লোককে–যাতে এদিকে এলে তারাও এখানেই এসে ওঠেন। বাবু–তা আমার বামুনের মজুরীটা?…হেঁ-হেঁ–

–কত মজুরী দেবো?

–তা দিন বাবু একবেলার মজুরী আট আনা দিন।

বাবুরা আরও আট আনা পয়সা বেচুর হাতে দিয়া চলিয়া গেলেন।

বেচু হাজারী ঠাকুরকে ডাকিয়া বলিল–ঠাকুর আজ আর বেরিও না কোথাও। বেলা গিয়েচে। উনুনে আঁচ আর একটু পরেই দিতে হবে। পদ্ম কোথায়?

–পদ্মদিদি থালা বাসন বার করচে, ডেকে দেবো?

পদ্ম ঝি আজ যে মুখ ভার করিয়া আছে, হাজারি তাহা বুঝিয়াছিল। আর হোটেলে সকলের সামনে তাহার প্রশংসা করিয়া গিয়াছে বাবুরা, আজ আর কি তাহার মনে সুখ আছে? পদ্ম ঝির মনস্তুষ্টি করিবার জন্য তাহার ভাতের থালায় হাজারি বেশী করিয়া ভাত তরকারি এবং মাংস দিয়াছিল। পদ্ম ঝি কিছুমাত্র প্রসন্ন হইয়াছে বলিয়া মনে হইল না, মুখ যেমন ভার তেমনিই রহিল।

ভাতের থালা উঠাইয়া লইয়া পদ্ম ঝি হঠাৎ প্রশ্ন করিল– রাঁধসা মাংস আর কতটা আছে ঠাকুর?

বলিয়াই ডেকচির দিকে চাহিল। এমন চমৎকার মাংস কুসুমের বাড়ী কিছু দিয়া আসিবে (সে ব্রাহ্মণের বিধবা নয়, মাছ-মাংস খাইতে তাহার আপত্তি নাই) ভাবিয়া ডেকচিতে দেড় পোয়া আন্দাজ মাংস হাজারি রাখিয়া দিয়াছিল–পদ্ম ঝি কি তাহা দেখিতে পাইল?

পদ্ম দেখিয়াছে বুঝিয়া হাজারি বলিল–সামান্য একটু আছে।

–কি হবে ওটুকু? আমায় দাও না-আমার আজ ভাগ্নীজামাই আসবে–তুমি ত মাংস খাও না–

কুসুমের জন্য রাখা মাংস পদ্ম ঝিকে দিতে হইবে–যার মুখ দেখিতে ইচ্ছা করে না হাজারির! হাজারি মাংস খায় না তাহা নয়, হোটেলে মাংস রান্না হইলেই হাজারি নিজের ভাগের মাংস লুকাইয়া কুসুমকে দিয়া আসে–নিজেকে বঞ্চিত করিয়া। পদ্ম ঝি তাহা জানে, জানে বলিয়াই তাহাকে আঘাত করিয়া প্রতিশোধ লইবার ইচ্ছা উহার মনে জাগিয়াছে ইহাও হাজারি বুঝিল।

হাজারি বলিল–তোমায় তো দিলাম পদ্মদিদি, একটুখানি পড়ে আছে ডেকচির তলায় ওটুকু আর তুমি কি করবে?

–কি করবো বললুম, তা তোমার কানে গেল না? ভাগ্নীজামাই এসেছে শুনলে না? যা দিলে এতটুকুতে কি কুলুবে? ঢেলে দাও ওটুকু।

হাজারি বিপন্ন মুখে বলিল–আমি একটু রেখে দিইছি, আমার দরকার আছে।

পদ্ম ঝি ঘুরিয়া দাঁড়াইয়া শ্লেষের সুরে বলিল–কি দরকার? তুমি তো খাও না–কাকে দেবে শুনি?

হাজারি বলিল–দেবো–ও একজন একটু চেয়েছে–

–কে একজন?

–আছে–ও সে তুমি জানো না।

পদ্ম ঝি ভাতের থালা নামাইয়া হাত নাড়িয়া বলিল–না, আমি জানিনে। তা কি আর জানি? আর সে জানা-জানি, আমার দরকার নেই। হোটেলের জিনিস তুমি কাউকে দিতে পারবে না, তোমায় অনেকদিন বলে দিইছি। বেশ তুমি আমায় না দাও, চক্কত্তি মশায়ের শালাও আজ কলকাতা থেকে এসেছে–তার জন্যে মাংস বাটি করে আলাদা রেখে দাও–ওবেলা এসে খাবে এখন। আমি না পেতে পারি, সে হোটেলের মালিকের আপনার লোক, সে তো পেতে পারে?

বেচু চক্কত্তির এই শালাটিকে হাজারি অনেকবার দেখিয়াছে–মাসের মধ্যে দশ দিন আসিয়া ভগ্নীপতির বাড়ী পড়িয়া থাকে, আর কালাপেড়ে ধুতি পরিয়া টেরি কাটিয়া হোটেলে আসিয়া সকলের উপর কর্তৃত্ব চালায়–কথায় কথায় ঠাকুর-চাকরকে অপমান করে; চোখ রাঙায়, যেন হোটেলের মালিক নিজেই।

তাহাদের গ্রামের মেয়ে, দরিদ্ৰা কুসুম ভালটা মন্দটা খাইতে পাওয়া দূরে থাকুক, অনেক সময় পেটের ভাত জুটাইতে পারে না–তাহার জন্য রাখিয়া দেওয়া এত যত্নের মাংস শেষকালে সেই চালবাজ বার্ডসাই-খোর শালাকে দিয়া খাওয়াইতে হইবে–এ প্রস্তাব হাজারির মোটেই ভাল লাগিল না। কিন্তু সে ভালমানুষ এবং কিছু ভীতু ধরনের লোক, যাহাদের হোটেল, তাহারা যদি খাইতে চায়, হাজারি তাহা না দিয়া পারে কি করিয়া–অগত্যা হাজারিকে পদ্ম ঝিয়ের সামনে বড় জামবাটিতে ডেকচির মাংসটুকু ঢালিয়া রান্নাঘরের কুলুঙ্গিতে রেকাবি চাপা দিয়া রাখিয়া দিতে হইল।

সামান্য একটু বেলা আছে, হাজারি সেটুকু সময়ের মধ্যেই একবার নদীর ধারে ফাঁকা জায়গায় বেড়াইতে গেল।

আজ তাহার মনে আত্মপ্রত্যয় খুব বাড়িয়া গিয়াছে–দুইটি জিনিস আজ বুঝিয়াছে সে। প্রথম, ভাল রান্না সে ভুলিয়া যায় নাই, কলিকাতার বাবুরাও তাহার রান্না খাইয়া তারিফ করেন। দ্বিতীয়, পরের তাঁবে কাজ করিলে মানুষকে মায়া-দয়া বিসর্জন দিতে হয়।

আজ এমন চমৎকার রান্না মাংসটুকু সে কুসুমকে খাওয়াইতে পারিল না, খাওয়াইতে হইল তাহাদের দিয়া, যাহাদের সে দুই চক্ষু পাড়িয়া দেখিতে পারে না। কুসুম যেদিন কাঁথাখানি দিয়াছিল, সেদিন হইতে হাজারির কেমন একটা অদ্ভুত ধরনের স্নেহ পড়িয়াছে কুসুমের ওপর।

বয়সে তো সে মেয়ের সমান বটেই, কাজও করিয়াছে মেয়ের মতই। আজ যদি হাজারির হাতে পয়সা থাকিত, তবে সে বাপের স্নেহ কি করিয়া দেখাইতে হয়, দেখাইয়া দিত। অন্য কিছু দেওয়া তো দূরের কথা, নিজের হাতে অমন রান্না মাংসটুকুই সে কুসুমকে দিতে পারিল না।

ছেলেবেলাকার কথা হাজারির মনে হয়। তাহার মা গঙ্গাসাগর যাইবেন বলিয়া যোগাড়-যন্ত্র করিতেছেন–পাড়ার অনেক বৃদ্ধা ও প্রৌঢ়া বিধবাদের সঙ্গে। হাজারি তখন আট বছরের ছেলে–সেও ভীষণ বায়না ধরিল গঙ্গাসাগর সে না গিয়া ছাড়িবেই না। তাহার ঝুঁকি লইতে কেহই রাজী নয়। সকলেই বলিল–তোমার ও ছেলেকে কে দেখাশুনো করবে বাপু, অত ছোট ছেলে আর সেখানে নানা ঝক্কি–তাহলে তোমার যাওয়া হয় না।

হাজারির মা ছেলেকে ফেলিয়া গঙ্গাসাগরে যাইতে পারিলেন না বলিয়া তাঁর যাওয়াই হইল না। জীবনে আর কখনোই তাঁর সাগর দেখা হয় নাই, কিন্তু হাজারির মনে মায়ের এই স্বার্থত্যাগের ঘটনাটকু উজ্জ্বল অক্ষরে লেখা হইয়া আছে।

হাজারি ভাবিল-যাক গে, যদি কখনো নিজে হোটেল খুলতে পারি, তবে এই রাণাঘাটের বাজারে বসেই পদ্ম ঝিকে দেখাবো–তুই কোথায় আর আমি কোথায়! হাতে পয়সা থাকলে কালই না হোটেল খুলে দিতাম! কুসুমকে রোজ রোজ ভাল জিনিস খাওয়াবো আমার নিজের হোটেল হলে।

কতকগুলি বিষয় সে যে খুব ভাল শিখিয়াছে, সে বেশ বুঝিতে পারে। বাজার-করা হোটেলওয়ালার একটি অত্যন্ত দরকারী কাজ এবং শক্ত কাজ। ভাল বাজার করার উপরে হোটেলের সাফল্য অনেকখানি নির্ভর করে এবং ভাল বাজার করার মানেই হইতেছে সস্তায় ভাল জিনিস কেনা। ভাল জিনিসের বদলে সস্তা জিনিস–অথচ দেখিলে তাহাকে মোটেই খেলো বলিয়া মনে হইবে না–এমন দ্রব্য খুঁজিয়া বাহির করা। যেমন বাটা মাছ যেদিন বাজারে আক্রা–সেদিন ছ’আনা সের রেল-চালানী রাস মাছের পোনা কিনিয়া তাহাকে বাটা বলিয়া চালাইতে হইবে–হঠাৎ ধরা বড় কঠিন, কোনটা বাটার পোনা, কোনটা রাসের পোনা।

.

পরদিন হাজারি চূর্ণীর ঘাটে গিয়া অনেকক্ষণ বসিয়া রহিল। তাহার মন কাল হইতে ভাল নয়। পদ্ম ঝির নিকট ভাল ব্যবহার কখনও সে পায় নাই, পাইবার প্রত্যাশাও করে না। কিন্তু তবুও কাল সামান্য একটু রাধা মাংস লইয়া পদ্ম ঝি যে কাণ্ডটি করিল, তাহাতে সে মনোকষ্ট পাইয়াছে খুব বেশী। পরের চাকরি করিতে গেলে এমন হয়। কুসুমকে একটুখানি মাংস না দিতে পারিয়া তাহার কষ্ট হইয়াছে বেশী–অমন ভাল রান্না সে অনেক দিন করে নাই–অত আশার জিনিসটা কুসুমকে দিতে পারিলে তাহার মনটা খুশি হইত।

ভাল কাজ করিলেও চাকুরির উন্নতি তো দূরের কথা, ইহারা সুখ্যাতি পর্যন্ত করিতে জানে না। বরঞ্চ পদে পদে হেনস্থা করে। এক একবার ইচ্ছা হয় যদুবাবুর হোটেলে কাজ লইতে। কিন্তু সেখানেও যে এরকম হইবে না তাহার প্রমাণ কিছুই নাই। সেখানেও পদ্ম ঝি জুটিতে বিলম্ব হইবে না। কি করা যায়।

বেলা পড়িয়া আসিতেছে। আর বেশীক্ষণ বসা যায় না। বহু পাপ না করিলে আর কেহ হোটেলের রাঁধুনীগিরি করিতে আসে না। এখনি গিয়া ডেকচি না চড়াইলে পদ্ম ঝি এক ঝুড়ি কথা শুনাইয়া দিবে, এতক্ষণ উনুনে আঁচ দেওয়া হইয়া গিয়াছে।…কিন্তু ফিরিবার পথে সে কি মনে করিয়া কুসুমের বাড়ী গেল!

কুসুম আসন পাতিয়া দিয়া বলিল–বাবাঠাকুর আসুন, বড় সৌভাগ্য অসময়ে আপনার পায়ের ধূলো পড়লো।

হাজারি বলিল–দ্যাখ, কুসুম, তোর সঙ্গে একটা পরামর্শ করতে এলাম।

কুসুম সাগ্রহ-দৃষ্টিতে মুখের দিকে চাহিয়া বলিল–কি বাবাঠাকুর?

–আমার বয়েস ছেচল্লিশ হয়েছে বটে, কিন্তু আমার তত বয়েস দেখায় না, কি বলিস কুসুম? আমার এখনও বেশ খাটবার ক্ষমতা আছে, তুই কি বলিস?

হাজারির কথাবার্তার গতি কোনদিকে বুঝিতে না পারিয়া কুসুম কিছু বিস্ময়, কিছু কৌতুকের সুরে বলিল–তা–বাবাঠাকুর, তা তো বটেই। বয়েস আপনার এমন আর কি–কেন বাবাঠাকুর?

কুসুমের মনে একটা কথা উঁকি মারিতে লাগিল–বাবাঠাকুর আবার বিয়ে-টিয়ে করবার কথা ভাবচেন নাকি?

হাজারি বলিল–আমার বড় ইচ্ছে আছে কুসুম, একটা হোটেল করব নিজের নামে। পয়সা যদি হাতে কোনদিন জমাতে পারি, এ আমি নিশ্চয়ই করবো, তুই জানিস! পরের ঝাঁটা খেয়ে কাজ করতে আর ইচ্ছে করে না। আমি আজ দশ বছর হোটেলে কাজ করছি, বাজার কি করে করতে হয় ভাল করে শিখে ফেলেছি। চক্কত্তি মশায়ের চেয়েও আমি ভাল বাজার করতে পারি। মাখমপুরের হাট থেকে ফি হাটরা যদি তরিতরকারী কিনে আনি তবে রাণাঘাটের বাজারের চেয়ে টাকায় চার আনা ছ’আনা সস্তা পড়ে। এ ধরো কম লাভ নয় একটা হোটেলের ব্যাপারে। বাজার করবার মধ্যেই হোটেলের কাজের আদ্ধেক লাভ। আমার খুব মনে জোর আছে কুসুম, টাকা পয়সা হাতে যদি কখনো পড়ে, তবে হোটেল যা চালাবো, বাজারের সেরা হোটেলে হবে, তুই দেখে নিস।

কুসুম হাজারি ঠাকুরের এ দীর্ঘ বক্তৃতা অবাক হইয়া শুনিতেছিল–সে হাজারিকে বাবার মত দেখে বলিয়াই মেয়ের মত বাবার প্রতি সর্বপ্রকার কাল্পনিক গুণ ও জ্ঞানের আরোপ করিয়া আসিতেছে। হোটেলের ব্যাপারে সে বিশেষ কিছু বুঝুক না বুঝুক, বাবাঠাকুর যে বুদ্ধিমান, তাহা সে হাজারির বক্তৃতা হইতে ধারণা করিয়া লইল।

কিছুক্ষণ পরে কি ভাবিয়া সে বলিল–আমার এক জোড়া রুলি ছিল, এক গাছা বিক্রী ক’রে দিয়েছি আমার ছোট ছেলের অসুখের সময় আর বছর। আর এক গাছা আছে। বিক্রী করলে যাট-সত্তর টাকা হবে। আপনি নেবেন বাবাঠাকুর? ওই টাকা নিয়ে হোটেল খোলা হবে আপনার।

হাজারি হাসিয়া বলিল–দূর পাগলী! ষাট টাকায় হোটেল হবে কি রে?

–কত টাকা হলে হয়?

–অন্ততঃ দুশো টাকার কম তো নয়। তাতেও হবে না।

–আচ্ছা, হিসেব করে দেখুন না বাবাঠাকুর।

–হিসেব করে দেখব কি, হিসেব আমার মুখে মুখে। ধরো গিয়ে দুটো বড় ডেকচি, ছোট ডেকচি তিনটে। থালা-বাসন এক প্রস্থ। হাতা, খুন্তি, বেড়ি, চামচে, চায়ের বাসন। বাইরে গদির ঘরের একখানা তক্তপোশ, বিছানা, তাকিয়া। বাক্স, খেরো বাঁধানো খাতা দুখানা। বালতি, লণ্ঠন, চাকি, বেলুন–এই সব নানান নটখটি জিনিস কিনতেই তো দুশো টাকার ওপর বেরিয়ে যাবে। পাঁচদিনের বাজার খরচ হাতে করে নিয়ে নামতে হবে। চাকর ঠাকুরের দু’মাসের মাইনে হাতে রেখে দিতে হয়–যদি প্রথম দু’মাস না হলো কিছু, ঠাকুর চাকরের মাইনে আসবে কোথা থেকে? সে-সব যাক-গে, তা ছাড়া তোর টাকা নেবোই বা কেন?

কুসুম রিদ্ধ স্বরে বলিল–আমার থাকতো যদি তবে আপনি নিতেন না কেন–ব্রাহ্মণের সেবায় যদি লাগে ও-টাকা, তবে ও-টাকার ভাগ্যি বাবাঠাকুর। সে ভাগ্যি থাকলে তো হবে, আমার অত টাকা যখন নেই, তখন আর সে কথা বলচি কি করে বলুন। যা আছে, ওতে যদি কখনো-সখনো কোন দরকার পড়ে আপনার মেয়েকে জানাবেন।

হাজারি উঠিল। আর এখানে বসিয়া দেরি করিলে চলিবে না। বলিল–না রে কুসুম, এতে আর কি হবে। আমি যাই এখন।

কুসুম বলিল– একটু কিছু মুখে না দিলে মেয়ের বাড়ী থেকে কি করে উঠবেন বাবাঠাকুর, বসুন আর একটু। আমি আসছি।

কুসুম এত দ্রুত ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল, যে হাজারি ঠাকুর প্রতিবাদ করিবার অবসর পর্যন্ত পাইল না। একটু পরে কুসুম ঘরের মধ্যে একখানা আসন আনিয়া পাতিল এবং মেজের উপর জলের হাত বুলাইয়া লইয়া আবার বাহিরে গেল। কিছুক্ষণ পরে একবাটি দুধ ও একখানা রেকাবিতে পেঁপে কাটা, আমের টিকলি ও দুটি সন্দেশ তানিয়া আসনের সামনে মেজের উপর রাখিয়া বলিল–একটু জল খান, বসুন এসে, আমি খাবার জল আনি। হাজারি আসনের উপর বসিল। কুসুম ঝকঝকে করিয়া মাজা একটা কাঁচের গেলাসে জল আনিয়া রেকাবির পাশে রাখিয়া সামনে দাঁড়াইয়া রহিল।

খাইতে খাইতে হাজারির মনে পড়িল সেদিনকার সেই মাংসের কথা। মেয়ের মত স্নেহ-যত্ন করে কুসুম, তাহারই জন্য তুলিয়া রাখা মাংস কিনা খাওয়াইতে হইল চক্কত্তি মহাশয়ের গাঁজাখোর শালাকে দিয়া শুধু ওই পদ্ম ঝিয়ের জন্যে। দাসত্বের এই তো সুখ!

হাজারি বলিল–তুই আমার মেয়ের মতন কুসুম-মা।

কুসুম হাসিয়া বলিল–মেয়ের মতন কেন বাবাঠাকুর, মেয়েই তো।

–ঠিক, মেয়েই তো। মেয়ে না হোলে বাপের এত যত্ন কে করে?

–যত্ন আর কি করেছি, সে ভাগ্যি ভগবান কি আমায় দিয়েছেন। একে কি যত্ন করা বলে? কাঁথাখানা পেতে শুচ্চেন বাবাঠাকুর?

–তা শুচ্চি বই কি রে। রোজ তোর কথা মনে হয় শোবার সময়। মনে ভাবি কুসুম এখানা দিয়েছে। ছেঁড়া মাদুরের কাটি ফুটে ফুটেঁপিঠে দাগ হয়ে গিয়েছিল। পেতে শুয়ে বেঁচেছি।

–আহা, কি যে বলেন! না, সন্দেশ দুটোই খেয়ে ফেলুন, পায়ে পড়ি। ও ফেলতে পারবেন না।

–কুসুম, তোর জন্যে না রেখে খেতে পারি কিছু মা? ওটা তোর কাছে রেখে দিলাম।

কুসুম লজায় চুপ করিয়া বহিল। হাজারি আসন হইতে উঠিয়া পড়িলে বলিল–পান আনি, দাঁড়ান।

তাহার পর সামনে দরজা পর্যন্ত আগাইয়া দিতে আসিয়া বলিল–আমার ও রুলি গাছা রইল তোলা আপনার জন্যে, বাবাঠাকুর। যখন দরকার হয়, মেয়ের কাছ থেকে নেবেন কিন্তু।

সেদিন হোটেলে ফিরিয়া হাজারি দেখিল, প্রায় পনেরো সের কি আধ মণ ময়দা চাকর আর পদ্ম ঝি মিলিয়া মাখিতেছে।

ব্যাপার কি! এত লুচির ময়দা কে খাইবে?

পদ্ম ঝি কথার সঙ্গে বেশ খানিকটা ঝাঁজ মিশাইয়া বলিল–হাজারি ঠাকুর, তোমার যা যা রাঁধবার আগে সেরে নাও–তারপর এই লুচিগুলো ভেযে ফেলতে হবে। আচার্য-পাড়ায় মহাদেব ঘোষালের বাড়ীতে খাবার যাবে, তারা অর্ডার দিয়ে গেছে সাড়ে ন’টার মধ্যে চাই, বুঝলে।

হাজারি ঠাকুর অবাক হইয়া বলিল–সাড়ে ন’টার মধ্যে ওই আধ মণ ময়দা ভেজে পাঠিয়ে দেবো, আবার হোটেলের রান্না রাঁধবো! কি যে বল পদ্মদিদি, তা কি করে হবে? রতন ঠাকুকে বল না লুচি ভেঙে দিক, আমি হোটেলের রান্না বাঁধবো।

পদ্ম ঝি চোখ রাঙাইয়া ছাড়া কথা বলে না। সে গরম হইয়া ঝঙ্কার দিয়া বলিল– তোমার ইচ্ছে বা খুশিতে এখানকার কাজ চলবে না। কর্তা মশায়ের হুকুম। আমায় যা বলে গেছেন তোমায় বললাম, তিনি বড় বাজারে বেরিয়ে গেলেন–আসতে রাত হবে। এখন তোমার মর্জি–করো আর না করো।

অর্থাৎ না করিয়া উপায় নাই। কিন্তু ইহাদের এই অবিচারে হাজারির চোখে প্রায় জল আসিল। নিছক অবিচার ছাড়া ইহা অন্য কিছু নহে। রতন ঠাকুরকে দিয়া ইহারা সাধারণ রান্না অনায়াসেই করাইতে পারিত, কিন্তু পদ্ম ঝি তাহা হইলে খুশি হইবে না। সে যে কি বিষ-চক্ষে পড়িয়াছে পদ্ম ঝিয়ের! উহাকে জব্দ করিবার কোনো ফাঁকই পদ্ম ছাড়ে না।

ভীষণ আগুনের তাতের মধ্যে বসিয়া রতন ঠাকুরের সঙ্গে দৈনিক রান্না কাৰ্যেতেই প্রায় ন’টা বাজিয়া গেল। পদ্ম ঝি তাহার পর ভীষণ তাগাদা লাগাইল লুচি ভাজাতে হাত দিবার জন্য। পদ্ম নিজে খাটিতে রাজি নয়, সে গেল খরিদ্দারদের খাওয়ার তদারক করিতে। আজ আবার হাটবার, বহু ব্যাপারী খরিদ্দার। রতন ঠাকুর তাহাদের পরিবেশন করিতে লাগিল। হাজারি এক ছিলিম তামাক খাইয়া লইয়াই আবার আগুনের তাতে বসিয়া গেল লুচি ভাজিতে।

আধঘণ্টা পরে–তখন পাঁচ সের ময়দাও ভাজা হয় নাই–পদ্ম আসিয়া বলিল–ও ঠাকুর, লুচি হয়েছে? ওদের লোক এসেছে নিতে।

হাজারি বলিল–না এখনো হয়নি পদ্মদিদি। একটু ঘুরে আসতে বল।

–ঘুরে আসতে বললে চলবে কেন? সাড়ে ন’টার মধ্যে ওদের খাবার তৈরি করে রাখতে হবে বলে গেছে। তোমায় বলিনি সেকথা?

–বল্লে কি হবে পদ্মদিদি? মন্তরে ভাজা হবে আধ মণ ময়দা? ন’টার সময় তো উনুনে ব্ৰহ্মার নেচি ফেলেচি–জিগ্যেস করো মতিকে।

–সে সব আমি জানিনে। যদি ওরা অর্ডার ফেরত দেয়, বোঝাপড়া ক’রো কর্তার সঙ্গে, তোমার মাইনে থেকে আধ মন ময়দা আর দশ সের ঘি র দাম একমাসে তো উঠবে না, তিন মাসে ওঠাতে হবে।

হাজারি দেখিল, কথা কাটাকাটি করিয়া লাভ নাই। সে নীরবে লুচি ভাজিয়া যাইতে লাগিল। হাজারি ফাঁকি দেওয়া অভ্যাস করে নাই–কাজ করিতে বসিয়া শুধু ভাবে কাজ করিয়া যাওয়াই তাহার নিয়ম–কেউ দেখুক বা না-ই দেখুক। লুচি ঘিয়ে ডুবাইয়া তাড়াতাড়ি তুলিয়া ফেলিলে শীঘ্র শীঘ্র কাজ চুকিয়া যায় বটে, কিন্তু তাহাতে লুচি কাঁচা থাকিয়া যাইবে। এজন্য সে ধীরে ধীরে সময় লইয়া লুচি তুলিতে লাগিল। পদ্ম ঝি একবার বলিল– অত দেরি করে খোলা নামাচ্ছ কেন ঠাকুর? হাত চালাও না–অত লুচি ডুবিয়ে রাখলে কড়া হয়ে যাবে–

হাজারি ভাবিল, একবার সে বলে যে রান্নার কাজ পদ্ম ঝিয়ের কাছে তাহাকে শিখিতে হইবে না, লুচি ডুবাইলে কড়া কি নরম হয় সে ভালই জানে, কিন্তু তখনই সে বুঝিল, পদ্ম ঝি কেন একথা বলিতেছে।

দশ সের ঘি হইতে জলতি বাদে যাহা বাকী থাকিবে পদ্ম ঝিয়ের লাভ। সে বাড়ী লইয়া যাইবে লুকাইয়া। কর্তামশায় পদ্ম ঝিয়ের বেলায় অন্ধ। দেখিয়াও দেখেন না।

হাজাৰি ভাবিল, এই সব জুয়াচুরির জন্য হোটেলের দুর্নাম হয়। খদ্দেরে পয়সা দেবে, তারা কাঁচা লুচি খাবে কেন? দশ সের ঘিয়ের দাম তো তাদের কাছ থেকে আদায় হয়েছে, তবে তা থেকে বাঁচানোই বা কেন? তাদের জিনিসটা যাতে ভাল হয় তাই তো দেখতে হবে? পদ্ম ঝি বাড়ী নিয়ে যাবে বলে তারা দশ সের ঘিয়ের ব্যবস্থা করে নি।

পরক্ষণেই তাহার নিজের স্বপ্নে সে ভোর হইয়া গেল।

এই রেল-বাজারেই সে হোটেল খুলিবে। তাহার নিজের হোটেল। ফাঁকি কাহাকে বলে, তাহার মধ্যে থাকিবে না। খদ্দের যে জিনিসের অর্ডার দিবে, তাহার মধ্যে চুরি সে করিবে না। খদ্দের সন্তুষ্ট করিয়া ব্যবসা। নিজের হাতে রাঁধিবে, খাওয়াইয়া সকলকে সন্তুষ্ট রাখিবে। চুরি-জুয়াচুরির মধ্যে সে নাই।

লুচি ভাজা ঘিয়ের বুদ্বুদের মধ্যে হাজারি ঠাকুর যেন সেই ভবিষ্যৎ হোটেলের ছবি দেখিতে পাইতেছে। প্রত্যেক ঘিয়ের বুদ্বুদটাতে। পদ্ম ঝি সেখানে নাই, বেচু চক্কত্তির গাঁজাখোর ও মাতাল শালাও নাই। বাহিরে গদির ঘরে দিব্য ফর্সা বিছানা পাতা, খদ্দের যতক্ষণ ইচ্ছা বিশ্রাম করুক, তামাক খাইতে ইচ্ছা করে থাক, বাড়তি পয়সা আর একটিও দিতে হইবে না। দুইটা করিয়া মাছ, হপ্তায় তিন দিন মাংস বাঁধা-খদ্দেরদের। এসব না করিয়া শুধু ইষ্টিশনের প্লাটফর্মে–হি-ই-ইন্দু হোটেল, হি-ই-ই-ন্দু হোটেল, বলিয়া মতি চাকরের মত চেঁচাইয়া গলা ফাটাইলে কি খদ্দের ভিড়িবে?

পদ্ম ঝি আসিয়া বলিল–ও ঠাকুর, তোমার হোল? হাত চালিয়ে নিতে পাচ্ছ না? বাবুদের নোক যে বসে আছে।

বলিয়াই ময়দার বারকোশের দিকে চাহিয়া দেখিল, বেলা লুচি যতগুলি ছিল, হাজারি প্রায় সব খোলায় চাপাইয়া দিয়াছে–খান পনেরো কুড়ির বেশী বারকোশে নাই। মতি চাকর পদ্ম ঝিকে আসিতে দেখিয়া তাড়াতাড়ি হাত চালাইতে লাগিল।

পদ্ম ঝি বলিল–তোমার হাত চলচে না, না? এখনো দশ সের ময়দার তাল ডাঙায়, ওই রকম করে লুচি বেললে কখন কি হবে?

হাজারি বলিল–পদ্মদিদি, রাত এগারোটা বাজবে ওই লুচি বেলতে আর এক হাতে ভাজতে। তুমি বেলবার লোক দাও।

পদ্ম ঝি মুখ নাড়িয়া বলিল–আমি ভাড়া করে আনি বেলবার লোক তোমার জন্যে। ও আমার বাবু রে! ভাজতে হয় ভাজো, না হয় না ভাজো গে–ফেরত গেলে তখন কর্তামশায় তোমার সঙ্গে বোঝাপড়া করবেন এখন।

পদ্ম ঝি চলিয়া গেল।

মতি চাকর বলিল–ঠাকুর, তুমি লুচি ভেজে উঠতে পারবে কি করে? লুচি পোড়াবে না। এত ময়দার তাল আমি বেলবো কখন বলো।

হঠাৎ হাজারির মনে হইল, একজন মানুষ এখনি তাহাকে সাহায্য করিতে বসিয়া যাইত–কুসুম! কিন্তু সে গৃহস্থের মেয়ে, গৃহস্থের ঘরের বৌ–তাহাকে তো এখানে আনা যায় না। যদিও ইহা ঠিক, খবর পাঠাইয়া তাহার বিপদ জানাইলে কুসুম এখনি ছুটিয়া আসিত।

তারপর একঘণ্টা হাজারি অন্য কিছু ভাবে নাই, কিছু দেখে নাই–দেখিয়াছে শুধু লুচির কড়া, ফুটন্ত ঘি, ময়দার তাল আর বাখারির সরু আগায় ভাজিয়া তোলা রাঙ্গা রাঙ্গা লুচির গোছা–তাহা হইতে গরম ঘি ঝরিয়া পড়িতেছে। ভীষণ আগুনের তাত, মাজা পিঠ বিষম টনটন করিতেছে, ঘাম ঝরিয়া কাপড় ও গামছা ভিজিয়া গিয়াছে, এক ছিলিম তামাক খাইবারও অবকাশ নাই–শুধু কাঁচা লুচি কড়ায় ফেলা এবং ভাজিয়া তুলিয়া ঘি ঝরাইয়া পাশের ধামাতে রাখা।

রাত দশটা।

মুর্শিদাবাদের গাড়ী আসিবার সময় হইল।

মতি চাকর বলিল–আমি একবার ইষ্টিশনে যাই ঠাকুরমশায়। টেরেনের টাইম হয়েছে। খদ্দের না আনলে কাল কর্তামশায়ের কাছে মার খেতে হবে। একটা বিড়ি খেয়ে যাই।

ঠিক কথা, সে খানিকক্ষণ প্লাটফর্মে পায়চারি করিতে করিতে ‘হি-ই-ই- হোটেল’ ‘হি-ই-ই-দু হোটেল’ বলিয়া চেঁচাইবে। মুর্শিদাবাদের ট্রেন আসিতে আর মিনিট পনেরো বাকী।

হাজারি বলিল–একা আমি বেলবো আর ভাজবো। তুই কি খেপলি মতি? দেখলি তো এদের কাণ্ড। রতনঠাকুর সরে পড়েছে, পদ্মদিদিও বোধ হয় সরে পড়েছে। আমি একা কি করি?

মতি বলিল–তোমাকে পদ্মদিদি দুচোখে দেখতে পারে না। কারো কাছে বোলো না ঠাকুর–এ সব তারই কারসাজি। তোমাকে জব্দ করবার মতলবে এ কাজ করেচে। আমি যাই, নইলে আমার চাকরি থাকবে না।

মতি চলিয়া গেল। অন্ততঃ পাঁচ সের ময়দার তাল তখনও বাকী। লেচি পাকানো সে-ও প্রায় দেড় সের–হাজারি গুণিয়া দেখিল ষোল গণ্ডা লেচি। অসম্ভব! একজন মানুষের দ্বারা কি করিয়া রাত বারোটার কমে বেলা এবং ভাজা দুই কাল হইতে পারে!

মতি চলিয়া যাইবার সময় যে বিড়িটা দিয়া গিয়াছিল সেটি তখনও ফুরায় নাই–এমন সময় পদ্ম উঁকি মারিয়া বলিল–কেবল বিড়ি খাওয়া আর কেবল বিড়ি খাওয়া! ওদিকে বাবুর বাড়ী থেকে নোক দুবার ফিরে গেল–তখনি তো বলেচি হাজারি ঠাকুরকে দিয়ে এ কাজ হবে না–বলি বিড়িটা ফেলে কাজে হাত দেও না, রাত কি আর আছে?

হাজারি ঠাকুর সত্যই কিছু অপ্রতিভ হইয়া বিড়ি ফেলিয়া দিল। পদ্ম ঝিয়ের সামনে সে একথা বলিতে পারিল না যে, লুচি বেলিবার লোক নই। আবার সে লুচি ভাজিতে আরম্ভ করিয়া দিল একাই।

রাত এগারোটার বেশী দেরি নাই। হাজারির এখন মনে হইল যে, সে আর বসিতে পারিতেছে না। কেবলই এই সময়টা মনে আসিতেছিল দুটি মুখ। একটি মুখ তাহার নিজের মেয়ে টেঁপির–বছর বারো বয়স, বাড়ীতে আছে; প্রায় পাঁচ ছ’মাস তার সঙ্গে দেখা হয় নাই–আর একটি মুখ কুসুমের। ওবেলা কুসুমের সেই যত্ন করিয়া বসাইয়া জল খাওয়ানো…তার সেই হাসিমুখ …টেঁপির মুখ আর কুসুমের মুখ এক হইয়া গিয়াছে…লুচি ও ঘিয়ের বুদ্বুদে সে তখনও যেন একখানা মুখই দেখিতে পাইতেছে–টেঁপি ও কুসুম দুইয়ে মিলিয়া এক…ওরা আজ যদি দু’জনে এখানে থাকিত। ওদিকে কুসুম বসিয়া হাসিমুখে লুচি বেলিতেছে এদিকে টেঁপি…

–ঠাকুর!

স্বয়ং কর্তামশায়, বেচু চক্কত্তি। পিছনে পদ্ম ঝি। পদ্ম ঝি বলিল–ও গাঁজাখোর ঠাকুরকে দিয়ে হবে না আপনাকে তখুনি বলিনি বাবু? ও গাঁজা খেয়ে বুঁদ হয়ে আছে, দেখচো না? কাজ এগুবে কোত্থেকে!

হাজারি তটস্থ হইয়া আরও তাড়াতাড়ি লুচি খোলা হইতে তুলিতে লাগিল। বাবুদের লোক আসিয়া বসিয়া ছিল। পদ্ম ঝি যে লুচি ভাজা হইয়াছিল, তাহাদের ওজন করিয়া দিল কর্তাবাবুর সামনে। পাঁচ সের ময়দার লুচি বাকী থাকিলেও তাহারা লইল না, এত রাত্রে লইয়া গিয়া কোনো কাজ হইবে না।

বেচু চক্কত্তি হাজৰিকে বলিলেন–এই ঘি আর ময়দার দাম তোমার মাইনে থেকে কাটা যাবে। গাঁজাখোর মানুষকে দিয়ে কি কাজ হয়?

হাজারি বলিল–আপনার হোটেলে সব উল্টো বন্দোবস্ত বাবু। কেউ তো বেলে দিতে আসেনি এক মতি চাকর ছাড়া। সেও গাড়ীর টাইমে ইষ্টিশনে খদ্দের আনতে গেল, আমি কি করব বাবু।

বেচু চক্কত্তি বলিলেন–সে সব শুনচি নে ঠাকুর। ওর দাম তুমি দেবে। খদ্দের অর্ডার ফেরত দিলে সে মাল আমি নিজের ঘর থেকে লোকসান দিতে পারিনে, আর মাখা নেচি কাটা ময়দা।

হাজারি ভাবিল, বেশ, তাহাকে যদি এদের দাম দিতে হয়, লুচি ভাজিয়া সে নিজে লইবে। রাত সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত খাটিয়া ও মতি চাকরকে কিছু অংশ দিবার জন্য লোভ দেখাইয়া তাহাকে দিয়া লুচি বেলাইয়া সব ময়দা ভাজিয়া তুলিল। মতি তাহার অংশ লইয়া চলিয়া গেল। এখনও তিন চার বুড়ি লুচি মজুত।

পদ্ম ঝি উঁকি মারিয়া বলিল–লুচি ভাজচো এখনও বসে? আমাকে খানকতক দাও দিকি–

বলিয়া নিজেই একখানা গামছা পাতিয়া নিজের হাতে খান পঁচিশ-ত্রিশ গরম লুচি তুলিয়া লইল। হাজারি মুখ ফুটিয়া বারণ করিতে পারিল না। সাহসে কুলাইল না।

অনেক রাত্রে সুপ্তোত্থিতা কুসুম চোখ মুছিতে মুছিতে বাহিরের দরজা খুলিয়া সম্মুখে মস্ত এক পোঁটলা-হাতে-ঝোলানো অবস্থায় হাজারি ঠাকুরকে দেখিয়া বিস্ময়ের সুরে বলিল–কি বাবাঠাকুর, কি মনে করে এত রাত্রে?…

হাজারি বলিল–এতে লুচি আছে মা কুসুম। হোটেলে লুচি ভাজতে দিয়েছিল খদ্দেরে। বেলে দেবার লোক নেই–শেষকালে খদ্দের পাঁচ সের ময়দার লুচি নিলে না, কর্তাবাবু বলেন আমায় তার দাম দিতে হবে। বেশ আমায় দাম দিতে হয় আমিই নিয়ে নিই। তাই তোমার জন্যে বলি নিয়ে যাই, কুসুমকে তো কিছু দেওয়া হয় না কখনো। রাত বড্ড হয়ে গিয়েচে– ঘুমিয়েছিলে বুঝি? ধর তো মা বোঁচকাটা রাখো গে যাও।

কুসুম বোঁচকাটা হাজারির হাত হইতে নামাইয়া লইল। সে একটু অবাক হইয়া গিয়াছে, বাবাঠাকুর পাগল, নতুবা এত রাত্রে–(তাহার এক ঘুম হইয়া গিয়াছে–), এখন আসিয়াছে লুচির বোঁচকা লইয়া।

হাজারি বলিল, আমি যাই মা–লুচি গরম আর টাটকা, এই ভেজে তুলিচি। তুমি খানকতক খেয়ে ফেলো গিয়ে এখনি। কাল সকালে বাসি হয়ে যাবে। আর ছেলেপিলেদের দাও গিয়ে। কত আর রাত হয়েচে– সাড়ে বারোটার বেশী নয়।

সেদিন ছিল বেশ বর্ষা।

হাজারি দেখিল, হোটেলে গদির ঘরে অনেকগুলি ভদ্রলোক বসিয়া আছে। অন্যদিন এ ধরনের খদ্দের এ হোটেলে সাধারণতঃ আসে না–হাজারি ইহাদের দেখিয়া একটু বিস্মিত হইল।

বেচু চক্কত্তি ডাকিল–হাজারি ঠাকুর, এদিকে এস–হাজারি গদির ঘরে দরজায় আসিয়া দাঁড়াইলে ভদ্রলোকদের একজন বলিলেন–এই ঠাকুরটির নাম হাজারি?

বেচু চক্কত্তি বলিল–হাঁ বাবু, এরই নাম হাজারি।

বাবুটি বলিলেন–এর কথাই শুনেচি। ঠাকুর তুমি আজ বর্ষার দিনে আমাদের মাংস পোলাও রেঁধে ভাল করে খাওয়াতে পারবে? তোমার আলাদা মজুরী যা হয় দেবো।

বেচু বলিল–ওকে আলাদা মজুরী দেবেন কেন বাবু, আপনাদের আশীর্বাদে আমার হোটেলের নাম অনেক দূর অবধি লোকে জানে। ও আমারই ঠাকুর, ওকে কিছু দিতে হবে না। আপনারা যা হুকুম করবেন তা ও করবে।

এই সময় পদ্ম ঝি বেচু চক্কত্তির ডাকে ঘরে ঢুকিল।

বেচু চক্কত্তি কিছু বলিবার পূর্বে জনৈক বাবু বলিল–ঝি, আমাদের একটু চা ক’রে খাওয়াও তো এই বর্ষার দিনটাতে। না হয় কোনো দোকান থেকে একটু এনে দাও। বুঝলেন চক্কত্তি মশায়। আপনার হোটেলের নাম অনেক দূর পর্যন্ত যে গিয়েছে বল্লেন–সে কথা মিথ্যা নয়। আমরা যখন আজ শিকারে বেরিয়েছি, তখন আমার পিসতুতো ভাই বলে দিয়েছিল, রাণাঘাট যাচ্চ, শিকার করে ফেরবার পথে রেল-বাজারের বেচু চক্কত্তির হোটেলের হাজারি ঠাকুরের হাতে মাংস খেয়ে এসো। তাই আজ সারাদিন জলায় আর বিলে পাখী মেয়ে বেড়িয়ে বেড়িয়ে ভাবলাম, ফিরবার গাড়ী তো রাত দশটায়। তা এ বর্ষার দিনে গরম গরম মাংস একটু খেয়েই যাই। মজুরী কেন দেবো না চক্কত্তি মশায়? ও আমাদের রান্না করুক, আমরা ওকে খুশি করে দিয়ে যাবো। ওর জন্যেই তো এখানে আসা। কথা শুনিয়া হাজারি অত্যন্ত খুশি হইয়া উঠিল, আরও সে খুশি হইল এই ভাবিয়া যে, চক্কত্তি মশায়ের কানে কথাগুলি গেল–তাহার চাকুরির উন্নতি হইতে পারে। মনিবের সুনজরে পড়িলে কি না সম্ভব? খুশির চোটে ইহা সে লক্ষ্যই করিল না যে, পদ্ম ঝি তাহার প্রশংসা শুনিয়া এদিকে হিংসায় নীলবর্ণ হইয়া উঠিয়াছে।

বাবুরা হোটেলের উপর নির্ভর করিল না–তাহারা জিনিসপত্র নিজেরাই কিনিয়া আনিল। হাজারি ঠাকুর মাংস রাঁধিবার একটি বিশেষ প্রণালী জানে, মাংসে একটুকু জল না দিয়া নেপালী ধরনের মাংস রান্নার কায়দা সে তাহাদের গ্রামের নেপাল-ফেরত ডাক্তার শিবচরণ গাঙ্গুলীর স্ত্রীর নিকট অনেকদিন আগে শিখিয়াছিল। কিন্তু হোটেলে দৈনন্দিন খাদ্য তালিকার মধ্যে মাংস কোনদিনই থাকে না–তবে বাধা খরিদ্দারগণের মনস্তুষ্টির জন্য মাসে একবার বা দুবার মাংস দেওয়ার ব্যবস্থা আছে বটে-সে রান্নার মধ্যে বিশেষ কৌশল দেখাইতে গেলে চলে না, বা হাজারির ইচ্ছাও করে না–যেমন ভাল শ্রোতা না পাইলে গায়কের ভাল গান করিতে ইচ্ছা করে না–তেমনি।

হাজারি ঠিক করিল, পদ্ম ঝি তাহাকে দুই চক্ষু পাড়িয়া যেমন দেখিতে পারে না–তেমনি আজ মাংস রাঁধিয়া সকলের বাহবা লইয়া পদ্ম ঝির চোখে আঙুল দিয়া দেখাইয়া দিবে, তাহাকে যত ছোট মনে করে ও, তত ছোট সে নয়। সেও মানুষ, সে অনেক বড় মানুষ।

ভাল যোগাড় না দিলে ভাল রান্না হয় না। পদ্ম ঝি যোগাড় দিবে না এ জানা কথা। হোটেলের অন্য উড়ে বামুনটিকে বলিতে পারা যায় না–কারণ সে-ই হোটেলের সাধারণ রান্না রাঁধিবে।

একবার ভাবিল–কুসুমকে আনবো?

পরক্ষণেই স্থির করিল, তার দরকার নাই। লোকে কে কি বলিবে, পদ্ম ঝি তো বঁটি পাতিয়া কুটিবে কুসুমকে। যাক, নিজেই যাহা হয় করিয়া লইবে এখন।

বেলা হইয়াছে। হাজারি বাজার হইতে কেনা তরি-তরকারী, মাংস নিজেই কুটিয়া বাছিয়া লইয়া রান্না চাপাইয়া দিল। বর্ষাও যেন নামিয়াছে হিমালয় পাহাড় ভাঙিয়া। কাঠগুলা ভিজিয়া গিয়াছে–মাংস সে কয়লার জালে রাঁধিবে না। তাহার সে বিশেষ প্রণালীর মাংস রান্না কয়লার জ্বালে হইবে না।

সব রান্না শেষ হইতে বেলা দুইটা রাজিয়া গেল। তারপরে খরিদ্দার বাবুরা খাইতে বসিল। মাংস পরিবেশন করিবার অনেক পূর্বেই ওস্তাদ শিল্পীর গর্ব ও আত্মপ্রত্যয়ের সহিত হাজারি বুঝিয়াছে, আজ যে ধরনের মাংস রান্না হইয়াছে–ইহাদের ভাল না লাগিয়া উপায় নাই। হইলও তাই।

বাবুরা বেচু চক্কত্তিকে ডাকাইলেন, হাজারি ঠাকুরের সম্বন্ধে এমন সব কথা বলিলেন যে বেচু চক্কত্তিও যেন অস্বস্তি বোধ করিতে লাগিল সে কথা নিয়া। চাকরকে ছোট করিয়া রাখিয়া মনিবের সুবিধা আছে, তাহাকে বড় করিলেই সে পাইয়া বসিবে।

যাইবার সময় একজন বাবু হাজারিকে আড়ালে ডাকিয়া বলিলেন–তুমি এখানে কত পাও ঠাকুর।

–সাত টাকা আর খাওয়া-পরা।

–এই দুটো টাকা তোমাকে আমরা বকশিশ দিলাম–চমৎকার রান্না তোমার। যখন আবার এদিকে আসবো, তুমি আমাদের রেঁধে খাইও।

হাজারি আমি খুশি হইল। বকশিশ ইহারা হয়তো কিছু দিবেন সে আশা করিয়াছিল বটে, কি দু-টাকা দিবেন তা সে ভাবে নাই।

যাইবার সময় বেচু চক্কত্তির সামনে বাবুরা হাজারি রান্নার আর এক দফা প্রশংসা করিয়া গেলেন। আর একবার শীঘ্রই শিকারে আসিবেন এদিকে। তখন এখানে আসিয়া হাজারি ঠাকুরের হাতে মাংস না খাইলে তাহাদের চলিবেই না। বেশ হোটেল করেছেন চক্কত্তি মশায়।

বেচু চক্কত্তি বিনীত ভাবে কাঁচুমাচু হইয়া বলিল–আজ্ঞে বাবু মশায়েরা রাজসই লোক, সব দেখতে পাচ্ছেন, সব বুঝতে পাচ্ছেন। এই রাণাঘাট রেল-বাজারে হোটেল আছে অনেকগুলো, কিন্তু আপনাদের মত লোক যখনই আসেন, সকলেই দয়া করে এই গরীবের কুঁড়েতেই পায়ের ধূলো দিয়ে থাকেন। তা আসবেন, যখন আপনাদের ইচ্ছা হয়, আগে থেকে একখানা চিঠি দেবেন, সব মজুদ থাকবে আপনাদের জন্যে; বলবেন কলকাতায় ফিরে দু’চার জন আলাপী লোককে–যাতে এদিকে এলে তারাও এখানেই এসে ওঠেন। বাবু–তা আমার বামুনের মজুরীটা?…হেঁ-হেঁ–

–কত মজুরী দেবো?

–তা দিন বাবু একবেলার মজুরী আট আনা দিন।

বাবুরা আরও আট আনা পয়সা বেচুর হাতে দিয়া চলিয়া গেলেন।

বেচু হাজারী ঠাকুরকে ডাকিয়া বলিল–ঠাকুর আজ আর বেরিও না কোথাও। বেলা গিয়েচে। উনুনে আঁচ আর একটু পরেই দিতে হবে। পদ্ম কোথায়?

–পদ্মদিদি থালা বাসন বার করচে, ডেকে দেবো?

পদ্ম ঝি আজ যে মুখ ভার করিয়া আছে, হাজারি তাহা বুঝিয়াছিল। আর হোটেলে সকলের সামনে তাহার প্রশংসা করিয়া গিয়াছে বাবুরা, আজ আর কি তাহার মনে সুখ আছে? পদ্ম ঝির মনস্তুষ্টি করিবার জন্য তাহার ভাতের থালায় হাজারি বেশী করিয়া ভাত তরকারি এবং মাংস দিয়াছিল। পদ্ম ঝি কিছুমাত্র প্রসন্ন হইয়াছে বলিয়া মনে হইল না, মুখ যেমন ভার তেমনিই রহিল।

ভাতের থালা উঠাইয়া লইয়া পদ্ম ঝি হঠাৎ প্রশ্ন করিল– রাঁধসা মাংস আর কতটা আছে ঠাকুর?

বলিয়াই ডেকচির দিকে চাহিল। এমন চমৎকার মাংস কুসুমের বাড়ী কিছু দিয়া আসিবে (সে ব্রাহ্মণের বিধবা নয়, মাছ-মাংস খাইতে তাহার আপত্তি নাই) ভাবিয়া ডেকচিতে দেড় পোয়া আন্দাজ মাংস হাজারি রাখিয়া দিয়াছিল–পদ্ম ঝি কি তাহা দেখিতে পাইল?

পদ্ম দেখিয়াছে বুঝিয়া হাজারি বলিল–সামান্য একটু আছে।

–কি হবে ওটুকু? আমায় দাও না-আমার আজ ভাগ্নীজামাই আসবে–তুমি ত মাংস খাও না–

কুসুমের জন্য রাখা মাংস পদ্ম ঝিকে দিতে হইবে–যার মুখ দেখিতে ইচ্ছা করে না হাজারির! হাজারি মাংস খায় না তাহা নয়, হোটেলে মাংস রান্না হইলেই হাজারি নিজের ভাগের মাংস লুকাইয়া কুসুমকে দিয়া আসে–নিজেকে বঞ্চিত করিয়া। পদ্ম ঝি তাহা জানে, জানে বলিয়াই তাহাকে আঘাত করিয়া প্রতিশোধ লইবার ইচ্ছা উহার মনে জাগিয়াছে ইহাও হাজারি বুঝিল।

হাজারি বলিল–তোমায় তো দিলাম পদ্মদিদি, একটুখানি পড়ে আছে ডেকচির তলায় ওটুকু আর তুমি কি করবে?

–কি করবো বললুম, তা তোমার কানে গেল না? ভাগ্নীজামাই এসেছে শুনলে না? যা দিলে এতটুকুতে কি কুলুবে? ঢেলে দাও ওটুকু।

হাজারি বিপন্ন মুখে বলিল–আমি একটু রেখে দিইছি, আমার দরকার আছে।

পদ্ম ঝি ঘুরিয়া দাঁড়াইয়া শ্লেষের সুরে বলিল–কি দরকার? তুমি তো খাও না–কাকে দেবে শুনি?

হাজারি বলিল–দেবো–ও একজন একটু চেয়েছে–

–কে একজন?

–আছে–ও সে তুমি জানো না।

পদ্ম ঝি ভাতের থালা নামাইয়া হাত নাড়িয়া বলিল–না, আমি জানিনে। তা কি আর জানি? আর সে জানা-জানি, আমার দরকার নেই। হোটেলের জিনিস তুমি কাউকে দিতে পারবে না, তোমায় অনেকদিন বলে দিইছি। বেশ তুমি আমায় না দাও, চক্কত্তি মশায়ের শালাও আজ কলকাতা থেকে এসেছে–তার জন্যে মাংস বাটি করে আলাদা রেখে দাও–ওবেলা এসে খাবে এখন। আমি না পেতে পারি, সে হোটেলের মালিকের আপনার লোক, সে তো পেতে পারে?

বেচু চক্কত্তির এই শালাটিকে হাজারি অনেকবার দেখিয়াছে–মাসের মধ্যে দশ দিন আসিয়া ভগ্নীপতির বাড়ী পড়িয়া থাকে, আর কালাপেড়ে ধুতি পরিয়া টেরি কাটিয়া হোটেলে আসিয়া সকলের উপর কর্তৃত্ব চালায়–কথায় কথায় ঠাকুর-চাকরকে অপমান করে; চোখ রাঙায়, যেন হোটেলের মালিক নিজেই।

তাহাদের গ্রামের মেয়ে, দরিদ্ৰা কুসুম ভালটা মন্দটা খাইতে পাওয়া দূরে থাকুক, অনেক সময় পেটের ভাত জুটাইতে পারে না–তাহার জন্য রাখিয়া দেওয়া এত যত্নের মাংস শেষকালে সেই চালবাজ বার্ডসাই-খোর শালাকে দিয়া খাওয়াইতে হইবে–এ প্রস্তাব হাজারির মোটেই ভাল লাগিল না। কিন্তু সে ভালমানুষ এবং কিছু ভীতু ধরনের লোক, যাহাদের হোটেল, তাহারা যদি খাইতে চায়, হাজারি তাহা না দিয়া পারে কি করিয়া–অগত্যা হাজারিকে পদ্ম ঝিয়ের সামনে বড় জামবাটিতে ডেকচির মাংসটুকু ঢালিয়া রান্নাঘরের কুলুঙ্গিতে রেকাবি চাপা দিয়া রাখিয়া দিতে হইল।

সামান্য একটু বেলা আছে, হাজারি সেটুকু সময়ের মধ্যেই একবার নদীর ধারে ফাঁকা জায়গায় বেড়াইতে গেল।

আজ তাহার মনে আত্মপ্রত্যয় খুব বাড়িয়া গিয়াছে–দুইটি জিনিস আজ বুঝিয়াছে সে। প্রথম, ভাল রান্না সে ভুলিয়া যায় নাই, কলিকাতার বাবুরাও তাহার রান্না খাইয়া তারিফ করেন। দ্বিতীয়, পরের তাঁবে কাজ করিলে মানুষকে মায়া-দয়া বিসর্জন দিতে হয়।

আজ এমন চমৎকার রান্না মাংসটুকু সে কুসুমকে খাওয়াইতে পারিল না, খাওয়াইতে হইল তাহাদের দিয়া, যাহাদের সে দুই চক্ষু পাড়িয়া দেখিতে পারে না। কুসুম যেদিন কাঁথাখানি দিয়াছিল, সেদিন হইতে হাজারির কেমন একটা অদ্ভুত ধরনের স্নেহ পড়িয়াছে কুসুমের ওপর।

বয়সে তো সে মেয়ের সমান বটেই, কাজও করিয়াছে মেয়ের মতই। আজ যদি হাজারির হাতে পয়সা থাকিত, তবে সে বাপের স্নেহ কি করিয়া দেখাইতে হয়, দেখাইয়া দিত। অন্য কিছু দেওয়া তো দূরের কথা, নিজের হাতে অমন রান্না মাংসটুকুই সে কুসুমকে দিতে পারিল না।

ছেলেবেলাকার কথা হাজারির মনে হয়। তাহার মা গঙ্গাসাগর যাইবেন বলিয়া যোগাড়-যন্ত্র করিতেছেন–পাড়ার অনেক বৃদ্ধা ও প্রৌঢ়া বিধবাদের সঙ্গে। হাজারি তখন আট বছরের ছেলে–সেও ভীষণ বায়না ধরিল গঙ্গাসাগর সে না গিয়া ছাড়িবেই না। তাহার ঝুঁকি লইতে কেহই রাজী নয়। সকলেই বলিল–তোমার ও ছেলেকে কে দেখাশুনো করবে বাপু, অত ছোট ছেলে আর সেখানে নানা ঝক্কি–তাহলে তোমার যাওয়া হয় না।

হাজারির মা ছেলেকে ফেলিয়া গঙ্গাসাগরে যাইতে পারিলেন না বলিয়া তাঁর যাওয়াই হইল না। জীবনে আর কখনোই তাঁর সাগর দেখা হয় নাই, কিন্তু হাজারির মনে মায়ের এই স্বার্থত্যাগের ঘটনাটকু উজ্জ্বল অক্ষরে লেখা হইয়া আছে।

হাজারি ভাবিল-যাক গে, যদি কখনো নিজে হোটেল খুলতে পারি, তবে এই রাণাঘাটের বাজারে বসেই পদ্ম ঝিকে দেখাবো–তুই কোথায় আর আমি কোথায়! হাতে পয়সা থাকলে কালই না হোটেল খুলে দিতাম! কুসুমকে রোজ রোজ ভাল জিনিস খাওয়াবো আমার নিজের হোটেল হলে।

কতকগুলি বিষয় সে যে খুব ভাল শিখিয়াছে, সে বেশ বুঝিতে পারে। বাজার-করা হোটেলওয়ালার একটি অত্যন্ত দরকারী কাজ এবং শক্ত কাজ। ভাল বাজার করার উপরে হোটেলের সাফল্য অনেকখানি নির্ভর করে এবং ভাল বাজার করার মানেই হইতেছে সস্তায় ভাল জিনিস কেনা। ভাল জিনিসের বদলে সস্তা জিনিস–অথচ দেখিলে তাহাকে মোটেই খেলো বলিয়া মনে হইবে না–এমন দ্রব্য খুঁজিয়া বাহির করা। যেমন বাটা মাছ যেদিন বাজারে আক্রা–সেদিন ছ’আনা সের রেল-চালানী রাস মাছের পোনা কিনিয়া তাহাকে বাটা বলিয়া চালাইতে হইবে–হঠাৎ ধরা বড় কঠিন, কোনটা বাটার পোনা, কোনটা রাসের পোনা।

.

পরদিন হাজারি চূর্ণীর ঘাটে গিয়া অনেকক্ষণ বসিয়া রহিল। তাহার মন কাল হইতে ভাল নয়। পদ্ম ঝির নিকট ভাল ব্যবহার কখনও সে পায় নাই, পাইবার প্রত্যাশাও করে না। কিন্তু তবুও কাল সামান্য একটু রাধা মাংস লইয়া পদ্ম ঝি যে কাণ্ডটি করিল, তাহাতে সে মনোকষ্ট পাইয়াছে খুব বেশী। পরের চাকরি করিতে গেলে এমন হয়। কুসুমকে একটুখানি মাংস না দিতে পারিয়া তাহার কষ্ট হইয়াছে বেশী–অমন ভাল রান্না সে অনেক দিন করে নাই–অত আশার জিনিসটা কুসুমকে দিতে পারিলে তাহার মনটা খুশি হইত।

ভাল কাজ করিলেও চাকুরির উন্নতি তো দূরের কথা, ইহারা সুখ্যাতি পর্যন্ত করিতে জানে না। বরঞ্চ পদে পদে হেনস্থা করে। এক একবার ইচ্ছা হয় যদুবাবুর হোটেলে কাজ লইতে। কিন্তু সেখানেও যে এরকম হইবে না তাহার প্রমাণ কিছুই নাই। সেখানেও পদ্ম ঝি জুটিতে বিলম্ব হইবে না। কি করা যায়।

বেলা পড়িয়া আসিতেছে। আর বেশীক্ষণ বসা যায় না। বহু পাপ না করিলে আর কেহ হোটেলের রাঁধুনীগিরি করিতে আসে না। এখনি গিয়া ডেকচি না চড়াইলে পদ্ম ঝি এক ঝুড়ি কথা শুনাইয়া দিবে, এতক্ষণ উনুনে আঁচ দেওয়া হইয়া গিয়াছে।…কিন্তু ফিরিবার পথে সে কি মনে করিয়া কুসুমের বাড়ী গেল!

কুসুম আসন পাতিয়া দিয়া বলিল–বাবাঠাকুর আসুন, বড় সৌভাগ্য অসময়ে আপনার পায়ের ধূলো পড়লো।

হাজারি বলিল–দ্যাখ, কুসুম, তোর সঙ্গে একটা পরামর্শ করতে এলাম।

কুসুম সাগ্রহ-দৃষ্টিতে মুখের দিকে চাহিয়া বলিল–কি বাবাঠাকুর?

–আমার বয়েস ছেচল্লিশ হয়েছে বটে, কিন্তু আমার তত বয়েস দেখায় না, কি বলিস কুসুম? আমার এখনও বেশ খাটবার ক্ষমতা আছে, তুই কি বলিস?

হাজারির কথাবার্তার গতি কোনদিকে বুঝিতে না পারিয়া কুসুম কিছু বিস্ময়, কিছু কৌতুকের সুরে বলিল–তা–বাবাঠাকুর, তা তো বটেই। বয়েস আপনার এমন আর কি–কেন বাবাঠাকুর?

কুসুমের মনে একটা কথা উঁকি মারিতে লাগিল–বাবাঠাকুর আবার বিয়ে-টিয়ে করবার কথা ভাবচেন নাকি?

হাজারি বলিল–আমার বড় ইচ্ছে আছে কুসুম, একটা হোটেল করব নিজের নামে। পয়সা যদি হাতে কোনদিন জমাতে পারি, এ আমি নিশ্চয়ই করবো, তুই জানিস! পরের ঝাঁটা খেয়ে কাজ করতে আর ইচ্ছে করে না। আমি আজ দশ বছর হোটেলে কাজ করছি, বাজার কি করে করতে হয় ভাল করে শিখে ফেলেছি। চক্কত্তি মশায়ের চেয়েও আমি ভাল বাজার করতে পারি। মাখমপুরের হাট থেকে ফি হাটরা যদি তরিতরকারী কিনে আনি তবে রাণাঘাটের বাজারের চেয়ে টাকায় চার আনা ছ’আনা সস্তা পড়ে। এ ধরো কম লাভ নয় একটা হোটেলের ব্যাপারে। বাজার করবার মধ্যেই হোটেলের কাজের আদ্ধেক লাভ। আমার খুব মনে জোর আছে কুসুম, টাকা পয়সা হাতে যদি কখনো পড়ে, তবে হোটেল যা চালাবো, বাজারের সেরা হোটেলে হবে, তুই দেখে নিস।

কুসুম হাজারি ঠাকুরের এ দীর্ঘ বক্তৃতা অবাক হইয়া শুনিতেছিল–সে হাজারিকে বাবার মত দেখে বলিয়াই মেয়ের মত বাবার প্রতি সর্বপ্রকার কাল্পনিক গুণ ও জ্ঞানের আরোপ করিয়া আসিতেছে। হোটেলের ব্যাপারে সে বিশেষ কিছু বুঝুক না বুঝুক, বাবাঠাকুর যে বুদ্ধিমান, তাহা সে হাজারির বক্তৃতা হইতে ধারণা করিয়া লইল।

কিছুক্ষণ পরে কি ভাবিয়া সে বলিল–আমার এক জোড়া রুলি ছিল, এক গাছা বিক্রী ক’রে দিয়েছি আমার ছোট ছেলের অসুখের সময় আর বছর। আর এক গাছা আছে। বিক্রী করলে যাট-সত্তর টাকা হবে। আপনি নেবেন বাবাঠাকুর? ওই টাকা নিয়ে হোটেল খোলা হবে আপনার।

হাজারি হাসিয়া বলিল–দূর পাগলী! ষাট টাকায় হোটেল হবে কি রে?

–কত টাকা হলে হয়?

–অন্ততঃ দুশো টাকার কম তো নয়। তাতেও হবে না।

–আচ্ছা, হিসেব করে দেখুন না বাবাঠাকুর।

–হিসেব করে দেখব কি, হিসেব আমার মুখে মুখে। ধরো গিয়ে দুটো বড় ডেকচি, ছোট ডেকচি তিনটে। থালা-বাসন এক প্রস্থ। হাতা, খুন্তি, বেড়ি, চামচে, চায়ের বাসন। বাইরে গদির ঘরের একখানা তক্তপোশ, বিছানা, তাকিয়া। বাক্স, খেরো বাঁধানো খাতা দুখানা। বালতি, লণ্ঠন, চাকি, বেলুন–এই সব নানান নটখটি জিনিস কিনতেই তো দুশো টাকার ওপর বেরিয়ে যাবে। পাঁচদিনের বাজার খরচ হাতে করে নিয়ে নামতে হবে। চাকর ঠাকুরের দু’মাসের মাইনে হাতে রেখে দিতে হয়–যদি প্রথম দু’মাস না হলো কিছু, ঠাকুর চাকরের মাইনে আসবে কোথা থেকে? সে-সব যাক-গে, তা ছাড়া তোর টাকা নেবোই বা কেন?

কুসুম রিদ্ধ স্বরে বলিল–আমার থাকতো যদি তবে আপনি নিতেন না কেন–ব্রাহ্মণের সেবায় যদি লাগে ও-টাকা, তবে ও-টাকার ভাগ্যি বাবাঠাকুর। সে ভাগ্যি থাকলে তো হবে, আমার অত টাকা যখন নেই, তখন আর সে কথা বলচি কি করে বলুন। যা আছে, ওতে যদি কখনো-সখনো কোন দরকার পড়ে আপনার মেয়েকে জানাবেন।

হাজারি উঠিল। আর এখানে বসিয়া দেরি করিলে চলিবে না। বলিল–না রে কুসুম, এতে আর কি হবে। আমি যাই এখন।

কুসুম বলিল– একটু কিছু মুখে না দিলে মেয়ের বাড়ী থেকে কি করে উঠবেন বাবাঠাকুর, বসুন আর একটু। আমি আসছি।

কুসুম এত দ্রুত ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল, যে হাজারি ঠাকুর প্রতিবাদ করিবার অবসর পর্যন্ত পাইল না। একটু পরে কুসুম ঘরের মধ্যে একখানা আসন আনিয়া পাতিল এবং মেজের উপর জলের হাত বুলাইয়া লইয়া আবার বাহিরে গেল। কিছুক্ষণ পরে একবাটি দুধ ও একখানা রেকাবিতে পেঁপে কাটা, আমের টিকলি ও দুটি সন্দেশ তানিয়া আসনের সামনে মেজের উপর রাখিয়া বলিল–একটু জল খান, বসুন এসে, আমি খাবার জল আনি। হাজারি আসনের উপর বসিল। কুসুম ঝকঝকে করিয়া মাজা একটা কাঁচের গেলাসে জল আনিয়া রেকাবির পাশে রাখিয়া সামনে দাঁড়াইয়া রহিল।

খাইতে খাইতে হাজারির মনে পড়িল সেদিনকার সেই মাংসের কথা। মেয়ের মত স্নেহ-যত্ন করে কুসুম, তাহারই জন্য তুলিয়া রাখা মাংস কিনা খাওয়াইতে হইল চক্কত্তি মহাশয়ের গাঁজাখোর শালাকে দিয়া শুধু ওই পদ্ম ঝিয়ের জন্যে। দাসত্বের এই তো সুখ!

হাজারি বলিল–তুই আমার মেয়ের মতন কুসুম-মা।

কুসুম হাসিয়া বলিল–মেয়ের মতন কেন বাবাঠাকুর, মেয়েই তো।

–ঠিক, মেয়েই তো। মেয়ে না হোলে বাপের এত যত্ন কে করে?

–যত্ন আর কি করেছি, সে ভাগ্যি ভগবান কি আমায় দিয়েছেন। একে কি যত্ন করা বলে? কাঁথাখানা পেতে শুচ্চেন বাবাঠাকুর?

–তা শুচ্চি বই কি রে। রোজ তোর কথা মনে হয় শোবার সময়। মনে ভাবি কুসুম এখানা দিয়েছে। ছেঁড়া মাদুরের কাটি ফুটে ফুটেঁপিঠে দাগ হয়ে গিয়েছিল। পেতে শুয়ে বেঁচেছি।

–আহা, কি যে বলেন! না, সন্দেশ দুটোই খেয়ে ফেলুন, পায়ে পড়ি। ও ফেলতে পারবেন না।

–কুসুম, তোর জন্যে না রেখে খেতে পারি কিছু মা? ওটা তোর কাছে রেখে দিলাম।

কুসুম লজায় চুপ করিয়া বহিল। হাজারি আসন হইতে উঠিয়া পড়িলে বলিল–পান আনি, দাঁড়ান।

তাহার পর সামনে দরজা পর্যন্ত আগাইয়া দিতে আসিয়া বলিল–আমার ও রুলি গাছা রইল তোলা আপনার জন্যে, বাবাঠাকুর। যখন দরকার হয়, মেয়ের কাছ থেকে নেবেন কিন্তু।

সেদিন হোটেলে ফিরিয়া হাজারি দেখিল, প্রায় পনেরো সের কি আধ মণ ময়দা চাকর আর পদ্ম ঝি মিলিয়া মাখিতেছে।

ব্যাপার কি! এত লুচির ময়দা কে খাইবে?

পদ্ম ঝি কথার সঙ্গে বেশ খানিকটা ঝাঁজ মিশাইয়া বলিল–হাজারি ঠাকুর, তোমার যা যা রাঁধবার আগে সেরে নাও–তারপর এই লুচিগুলো ভেযে ফেলতে হবে। আচার্য-পাড়ায় মহাদেব ঘোষালের বাড়ীতে খাবার যাবে, তারা অর্ডার দিয়ে গেছে সাড়ে ন’টার মধ্যে চাই, বুঝলে।

হাজারি ঠাকুর অবাক হইয়া বলিল–সাড়ে ন’টার মধ্যে ওই আধ মণ ময়দা ভেজে পাঠিয়ে দেবো, আবার হোটেলের রান্না রাঁধবো! কি যে বল পদ্মদিদি, তা কি করে হবে? রতন ঠাকুকে বল না লুচি ভেঙে দিক, আমি হোটেলের রান্না বাঁধবো।

পদ্ম ঝি চোখ রাঙাইয়া ছাড়া কথা বলে না। সে গরম হইয়া ঝঙ্কার দিয়া বলিল– তোমার ইচ্ছে বা খুশিতে এখানকার কাজ চলবে না। কর্তা মশায়ের হুকুম। আমায় যা বলে গেছেন তোমায় বললাম, তিনি বড় বাজারে বেরিয়ে গেলেন–আসতে রাত হবে। এখন তোমার মর্জি–করো আর না করো।

অর্থাৎ না করিয়া উপায় নাই। কিন্তু ইহাদের এই অবিচারে হাজারির চোখে প্রায় জল আসিল। নিছক অবিচার ছাড়া ইহা অন্য কিছু নহে। রতন ঠাকুরকে দিয়া ইহারা সাধারণ রান্না অনায়াসেই করাইতে পারিত, কিন্তু পদ্ম ঝি তাহা হইলে খুশি হইবে না। সে যে কি বিষ-চক্ষে পড়িয়াছে পদ্ম ঝিয়ের! উহাকে জব্দ করিবার কোনো ফাঁকই পদ্ম ছাড়ে না।

ভীষণ আগুনের তাতের মধ্যে বসিয়া রতন ঠাকুরের সঙ্গে দৈনিক রান্না কাৰ্যেতেই প্রায় ন’টা বাজিয়া গেল। পদ্ম ঝি তাহার পর ভীষণ তাগাদা লাগাইল লুচি ভাজাতে হাত দিবার জন্য। পদ্ম নিজে খাটিতে রাজি নয়, সে গেল খরিদ্দারদের খাওয়ার তদারক করিতে। আজ আবার হাটবার, বহু ব্যাপারী খরিদ্দার। রতন ঠাকুর তাহাদের পরিবেশন করিতে লাগিল। হাজারি এক ছিলিম তামাক খাইয়া লইয়াই আবার আগুনের তাতে বসিয়া গেল লুচি ভাজিতে।

আধঘণ্টা পরে–তখন পাঁচ সের ময়দাও ভাজা হয় নাই–পদ্ম আসিয়া বলিল–ও ঠাকুর, লুচি হয়েছে? ওদের লোক এসেছে নিতে।

হাজারি বলিল–না এখনো হয়নি পদ্মদিদি। একটু ঘুরে আসতে বল।

–ঘুরে আসতে বললে চলবে কেন? সাড়ে ন’টার মধ্যে ওদের খাবার তৈরি করে রাখতে হবে বলে গেছে। তোমায় বলিনি সেকথা?

–বল্লে কি হবে পদ্মদিদি? মন্তরে ভাজা হবে আধ মণ ময়দা? ন’টার সময় তো উনুনে ব্ৰহ্মার নেচি ফেলেচি–জিগ্যেস করো মতিকে।

–সে সব আমি জানিনে। যদি ওরা অর্ডার ফেরত দেয়, বোঝাপড়া ক’রো কর্তার সঙ্গে, তোমার মাইনে থেকে আধ মন ময়দা আর দশ সের ঘি র দাম একমাসে তো উঠবে না, তিন মাসে ওঠাতে হবে।

হাজারি দেখিল, কথা কাটাকাটি করিয়া লাভ নাই। সে নীরবে লুচি ভাজিয়া যাইতে লাগিল। হাজারি ফাঁকি দেওয়া অভ্যাস করে নাই–কাজ করিতে বসিয়া শুধু ভাবে কাজ করিয়া যাওয়াই তাহার নিয়ম–কেউ দেখুক বা না-ই দেখুক। লুচি ঘিয়ে ডুবাইয়া তাড়াতাড়ি তুলিয়া ফেলিলে শীঘ্র শীঘ্র কাজ চুকিয়া যায় বটে, কিন্তু তাহাতে লুচি কাঁচা থাকিয়া যাইবে। এজন্য সে ধীরে ধীরে সময় লইয়া লুচি তুলিতে লাগিল। পদ্ম ঝি একবার বলিল– অত দেরি করে খোলা নামাচ্ছ কেন ঠাকুর? হাত চালাও না–অত লুচি ডুবিয়ে রাখলে কড়া হয়ে যাবে–

হাজারি ভাবিল, একবার সে বলে যে রান্নার কাজ পদ্ম ঝিয়ের কাছে তাহাকে শিখিতে হইবে না, লুচি ডুবাইলে কড়া কি নরম হয় সে ভালই জানে, কিন্তু তখনই সে বুঝিল, পদ্ম ঝি কেন একথা বলিতেছে।

দশ সের ঘি হইতে জলতি বাদে যাহা বাকী থাকিবে পদ্ম ঝিয়ের লাভ। সে বাড়ী লইয়া যাইবে লুকাইয়া। কর্তামশায় পদ্ম ঝিয়ের বেলায় অন্ধ। দেখিয়াও দেখেন না।

হাজাৰি ভাবিল, এই সব জুয়াচুরির জন্য হোটেলের দুর্নাম হয়। খদ্দেরে পয়সা দেবে, তারা কাঁচা লুচি খাবে কেন? দশ সের ঘিয়ের দাম তো তাদের কাছ থেকে আদায় হয়েছে, তবে তা থেকে বাঁচানোই বা কেন? তাদের জিনিসটা যাতে ভাল হয় তাই তো দেখতে হবে? পদ্ম ঝি বাড়ী নিয়ে যাবে বলে তারা দশ সের ঘিয়ের ব্যবস্থা করে নি।

পরক্ষণেই তাহার নিজের স্বপ্নে সে ভোর হইয়া গেল।

এই রেল-বাজারেই সে হোটেল খুলিবে। তাহার নিজের হোটেল। ফাঁকি কাহাকে বলে, তাহার মধ্যে থাকিবে না। খদ্দের যে জিনিসের অর্ডার দিবে, তাহার মধ্যে চুরি সে করিবে না। খদ্দের সন্তুষ্ট করিয়া ব্যবসা। নিজের হাতে রাঁধিবে, খাওয়াইয়া সকলকে সন্তুষ্ট রাখিবে। চুরি-জুয়াচুরির মধ্যে সে নাই।

লুচি ভাজা ঘিয়ের বুদ্বুদের মধ্যে হাজারি ঠাকুর যেন সেই ভবিষ্যৎ হোটেলের ছবি দেখিতে পাইতেছে। প্রত্যেক ঘিয়ের বুদ্বুদটাতে। পদ্ম ঝি সেখানে নাই, বেচু চক্কত্তির গাঁজাখোর ও মাতাল শালাও নাই। বাহিরে গদির ঘরে দিব্য ফর্সা বিছানা পাতা, খদ্দের যতক্ষণ ইচ্ছা বিশ্রাম করুক, তামাক খাইতে ইচ্ছা করে থাক, বাড়তি পয়সা আর একটিও দিতে হইবে না। দুইটা করিয়া মাছ, হপ্তায় তিন দিন মাংস বাঁধা-খদ্দেরদের। এসব না করিয়া শুধু ইষ্টিশনের প্লাটফর্মে–হি-ই-ইন্দু হোটেল, হি-ই-ই-ন্দু হোটেল, বলিয়া মতি চাকরের মত চেঁচাইয়া গলা ফাটাইলে কি খদ্দের ভিড়িবে?

পদ্ম ঝি আসিয়া বলিল–ও ঠাকুর, তোমার হোল? হাত চালিয়ে নিতে পাচ্ছ না? বাবুদের নোক যে বসে আছে।

বলিয়াই ময়দার বারকোশের দিকে চাহিয়া দেখিল, বেলা লুচি যতগুলি ছিল, হাজারি প্রায় সব খোলায় চাপাইয়া দিয়াছে–খান পনেরো কুড়ির বেশী বারকোশে নাই। মতি চাকর পদ্ম ঝিকে আসিতে দেখিয়া তাড়াতাড়ি হাত চালাইতে লাগিল।

পদ্ম ঝি বলিল–তোমার হাত চলচে না, না? এখনো দশ সের ময়দার তাল ডাঙায়, ওই রকম করে লুচি বেললে কখন কি হবে?

হাজারি বলিল–পদ্মদিদি, রাত এগারোটা বাজবে ওই লুচি বেলতে আর এক হাতে ভাজতে। তুমি বেলবার লোক দাও।

পদ্ম ঝি মুখ নাড়িয়া বলিল–আমি ভাড়া করে আনি বেলবার লোক তোমার জন্যে। ও আমার বাবু রে! ভাজতে হয় ভাজো, না হয় না ভাজো গে–ফেরত গেলে তখন কর্তামশায় তোমার সঙ্গে বোঝাপড়া করবেন এখন।

পদ্ম ঝি চলিয়া গেল।

মতি চাকর বলিল–ঠাকুর, তুমি লুচি ভেজে উঠতে পারবে কি করে? লুচি পোড়াবে না। এত ময়দার তাল আমি বেলবো কখন বলো।

হঠাৎ হাজারির মনে হইল, একজন মানুষ এখনি তাহাকে সাহায্য করিতে বসিয়া যাইত–কুসুম! কিন্তু সে গৃহস্থের মেয়ে, গৃহস্থের ঘরের বৌ–তাহাকে তো এখানে আনা যায় না। যদিও ইহা ঠিক, খবর পাঠাইয়া তাহার বিপদ জানাইলে কুসুম এখনি ছুটিয়া আসিত।

তারপর একঘণ্টা হাজারি অন্য কিছু ভাবে নাই, কিছু দেখে নাই–দেখিয়াছে শুধু লুচির কড়া, ফুটন্ত ঘি, ময়দার তাল আর বাখারির সরু আগায় ভাজিয়া তোলা রাঙ্গা রাঙ্গা লুচির গোছা–তাহা হইতে গরম ঘি ঝরিয়া পড়িতেছে। ভীষণ আগুনের তাত, মাজা পিঠ বিষম টনটন করিতেছে, ঘাম ঝরিয়া কাপড় ও গামছা ভিজিয়া গিয়াছে, এক ছিলিম তামাক খাইবারও অবকাশ নাই–শুধু কাঁচা লুচি কড়ায় ফেলা এবং ভাজিয়া তুলিয়া ঘি ঝরাইয়া পাশের ধামাতে রাখা।

রাত দশটা।

মুর্শিদাবাদের গাড়ী আসিবার সময় হইল।

মতি চাকর বলিল–আমি একবার ইষ্টিশনে যাই ঠাকুরমশায়। টেরেনের টাইম হয়েছে। খদ্দের না আনলে কাল কর্তামশায়ের কাছে মার খেতে হবে। একটা বিড়ি খেয়ে যাই।

ঠিক কথা, সে খানিকক্ষণ প্লাটফর্মে পায়চারি করিতে করিতে ‘হি-ই-ই- হোটেল’ ‘হি-ই-ই-দু হোটেল’ বলিয়া চেঁচাইবে। মুর্শিদাবাদের ট্রেন আসিতে আর মিনিট পনেরো বাকী।

হাজারি বলিল–একা আমি বেলবো আর ভাজবো। তুই কি খেপলি মতি? দেখলি তো এদের কাণ্ড। রতনঠাকুর সরে পড়েছে, পদ্মদিদিও বোধ হয় সরে পড়েছে। আমি একা কি করি?

মতি বলিল–তোমাকে পদ্মদিদি দুচোখে দেখতে পারে না। কারো কাছে বোলো না ঠাকুর–এ সব তারই কারসাজি। তোমাকে জব্দ করবার মতলবে এ কাজ করেচে। আমি যাই, নইলে আমার চাকরি থাকবে না।

মতি চলিয়া গেল। অন্ততঃ পাঁচ সের ময়দার তাল তখনও বাকী। লেচি পাকানো সে-ও প্রায় দেড় সের–হাজারি গুণিয়া দেখিল ষোল গণ্ডা লেচি। অসম্ভব! একজন মানুষের দ্বারা কি করিয়া রাত বারোটার কমে বেলা এবং ভাজা দুই কাল হইতে পারে!

মতি চলিয়া যাইবার সময় যে বিড়িটা দিয়া গিয়াছিল সেটি তখনও ফুরায় নাই–এমন সময় পদ্ম উঁকি মারিয়া বলিল–কেবল বিড়ি খাওয়া আর কেবল বিড়ি খাওয়া! ওদিকে বাবুর বাড়ী থেকে নোক দুবার ফিরে গেল–তখনি তো বলেচি হাজারি ঠাকুরকে দিয়ে এ কাজ হবে না–বলি বিড়িটা ফেলে কাজে হাত দেও না, রাত কি আর আছে?

হাজারি ঠাকুর সত্যই কিছু অপ্রতিভ হইয়া বিড়ি ফেলিয়া দিল। পদ্ম ঝিয়ের সামনে সে একথা বলিতে পারিল না যে, লুচি বেলিবার লোক নই। আবার সে লুচি ভাজিতে আরম্ভ করিয়া দিল একাই।

রাত এগারোটার বেশী দেরি নাই। হাজারির এখন মনে হইল যে, সে আর বসিতে পারিতেছে না। কেবলই এই সময়টা মনে আসিতেছিল দুটি মুখ। একটি মুখ তাহার নিজের মেয়ে টেঁপির–বছর বারো বয়স, বাড়ীতে আছে; প্রায় পাঁচ ছ’মাস তার সঙ্গে দেখা হয় নাই–আর একটি মুখ কুসুমের। ওবেলা কুসুমের সেই যত্ন করিয়া বসাইয়া জল খাওয়ানো…তার সেই হাসিমুখ …টেঁপির মুখ আর কুসুমের মুখ এক হইয়া গিয়াছে…লুচি ও ঘিয়ের বুদ্বুদে সে তখনও যেন একখানা মুখই দেখিতে পাইতেছে–টেঁপি ও কুসুম দুইয়ে মিলিয়া এক…ওরা আজ যদি দু’জনে এখানে থাকিত। ওদিকে কুসুম বসিয়া হাসিমুখে লুচি বেলিতেছে এদিকে টেঁপি…

–ঠাকুর!

স্বয়ং কর্তামশায়, বেচু চক্কত্তি। পিছনে পদ্ম ঝি। পদ্ম ঝি বলিল–ও গাঁজাখোর ঠাকুরকে দিয়ে হবে না আপনাকে তখুনি বলিনি বাবু? ও গাঁজা খেয়ে বুঁদ হয়ে আছে, দেখচো না? কাজ এগুবে কোত্থেকে!

হাজারি তটস্থ হইয়া আরও তাড়াতাড়ি লুচি খোলা হইতে তুলিতে লাগিল। বাবুদের লোক আসিয়া বসিয়া ছিল। পদ্ম ঝি যে লুচি ভাজা হইয়াছিল, তাহাদের ওজন করিয়া দিল কর্তাবাবুর সামনে। পাঁচ সের ময়দার লুচি বাকী থাকিলেও তাহারা লইল না, এত রাত্রে লইয়া গিয়া কোনো কাজ হইবে না।

বেচু চক্কত্তি হাজৰিকে বলিলেন–এই ঘি আর ময়দার দাম তোমার মাইনে থেকে কাটা যাবে। গাঁজাখোর মানুষকে দিয়ে কি কাজ হয়?

হাজারি বলিল–আপনার হোটেলে সব উল্টো বন্দোবস্ত বাবু। কেউ তো বেলে দিতে আসেনি এক মতি চাকর ছাড়া। সেও গাড়ীর টাইমে ইষ্টিশনে খদ্দের আনতে গেল, আমি কি করব বাবু।

বেচু চক্কত্তি বলিলেন–সে সব শুনচি নে ঠাকুর। ওর দাম তুমি দেবে। খদ্দের অর্ডার ফেরত দিলে সে মাল আমি নিজের ঘর থেকে লোকসান দিতে পারিনে, আর মাখা নেচি কাটা ময়দা।

হাজারি ভাবিল, বেশ, তাহাকে যদি এদের দাম দিতে হয়, লুচি ভাজিয়া সে নিজে লইবে। রাত সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত খাটিয়া ও মতি চাকরকে কিছু অংশ দিবার জন্য লোভ দেখাইয়া তাহাকে দিয়া লুচি বেলাইয়া সব ময়দা ভাজিয়া তুলিল। মতি তাহার অংশ লইয়া চলিয়া গেল। এখনও তিন চার বুড়ি লুচি মজুত।

পদ্ম ঝি উঁকি মারিয়া বলিল–লুচি ভাজচো এখনও বসে? আমাকে খানকতক দাও দিকি–

বলিয়া নিজেই একখানা গামছা পাতিয়া নিজের হাতে খান পঁচিশ-ত্রিশ গরম লুচি তুলিয়া লইল। হাজারি মুখ ফুটিয়া বারণ করিতে পারিল না। সাহসে কুলাইল না।

অনেক রাত্রে সুপ্তোত্থিতা কুসুম চোখ মুছিতে মুছিতে বাহিরের দরজা খুলিয়া সম্মুখে মস্ত এক পোঁটলা-হাতে-ঝোলানো অবস্থায় হাজারি ঠাকুরকে দেখিয়া বিস্ময়ের সুরে বলিল–কি বাবাঠাকুর, কি মনে করে এত রাত্রে?…

হাজারি বলিল–এতে লুচি আছে মা কুসুম। হোটেলে লুচি ভাজতে দিয়েছিল খদ্দেরে। বেলে দেবার লোক নেই–শেষকালে খদ্দের পাঁচ সের ময়দার লুচি নিলে না, কর্তাবাবু বলেন আমায় তার দাম দিতে হবে। বেশ আমায় দাম দিতে হয় আমিই নিয়ে নিই। তাই তোমার জন্যে বলি নিয়ে যাই, কুসুমকে তো কিছু দেওয়া হয় না কখনো। রাত বড্ড হয়ে গিয়েচে– ঘুমিয়েছিলে বুঝি? ধর তো মা বোঁচকাটা রাখো গে যাও।

কুসুম বোঁচকাটা হাজারির হাত হইতে নামাইয়া লইল। সে একটু অবাক হইয়া গিয়াছে, বাবাঠাকুর পাগল, নতুবা এত রাত্রে–(তাহার এক ঘুম হইয়া গিয়াছে–), এখন আসিয়াছে লুচির বোঁচকা লইয়া।

হাজারি বলিল, আমি যাই মা–লুচি গরম আর টাটকা, এই ভেজে তুলিচি। তুমি খানকতক খেয়ে ফেলো গিয়ে এখনি। কাল সকালে বাসি হয়ে যাবে। আর ছেলেপিলেদের দাও গিয়ে। কত আর রাত হয়েচে– সাড়ে বারোটার বেশী নয়।

সেদিন ছিল বেশ বর্ষা।

হাজারি দেখিল, হোটেলে গদির ঘরে অনেকগুলি ভদ্রলোক বসিয়া আছে। অন্যদিন এ ধরনের খদ্দের এ হোটেলে সাধারণতঃ আসে না–হাজারি ইহাদের দেখিয়া একটু বিস্মিত হইল।

বেচু চক্কত্তি ডাকিল–হাজারি ঠাকুর, এদিকে এস–হাজারি গদির ঘরে দরজায় আসিয়া দাঁড়াইলে ভদ্রলোকদের একজন বলিলেন–এই ঠাকুরটির নাম হাজারি?

বেচু চক্কত্তি বলিল–হাঁ বাবু, এরই নাম হাজারি।

বাবুটি বলিলেন–এর কথাই শুনেচি। ঠাকুর তুমি আজ বর্ষার দিনে আমাদের মাংস পোলাও রেঁধে ভাল করে খাওয়াতে পারবে? তোমার আলাদা মজুরী যা হয় দেবো।

বেচু বলিল–ওকে আলাদা মজুরী দেবেন কেন বাবু, আপনাদের আশীর্বাদে আমার হোটেলের নাম অনেক দূর অবধি লোকে জানে। ও আমারই ঠাকুর, ওকে কিছু দিতে হবে না। আপনারা যা হুকুম করবেন তা ও করবে।

এই সময় পদ্ম ঝি বেচু চক্কত্তির ডাকে ঘরে ঢুকিল।

বেচু চক্কত্তি কিছু বলিবার পূর্বে জনৈক বাবু বলিল–ঝি, আমাদের একটু চা ক’রে খাওয়াও তো এই বর্ষার দিনটাতে। না হয় কোনো দোকান থেকে একটু এনে দাও। বুঝলেন চক্কত্তি মশায়। আপনার হোটেলের নাম অনেক দূর পর্যন্ত যে গিয়েছে বল্লেন–সে কথা মিথ্যা নয়। আমরা যখন আজ শিকারে বেরিয়েছি, তখন আমার পিসতুতো ভাই বলে দিয়েছিল, রাণাঘাট যাচ্চ, শিকার করে ফেরবার পথে রেল-বাজারের বেচু চক্কত্তির হোটেলের হাজারি ঠাকুরের হাতে মাংস খেয়ে এসো। তাই আজ সারাদিন জলায় আর বিলে পাখী মেয়ে বেড়িয়ে বেড়িয়ে ভাবলাম, ফিরবার গাড়ী তো রাত দশটায়। তা এ বর্ষার দিনে গরম গরম মাংস একটু খেয়েই যাই। মজুরী কেন দেবো না চক্কত্তি মশায়? ও আমাদের রান্না করুক, আমরা ওকে খুশি করে দিয়ে যাবো। ওর জন্যেই তো এখানে আসা। কথা শুনিয়া হাজারি অত্যন্ত খুশি হইয়া উঠিল, আরও সে খুশি হইল এই ভাবিয়া যে, চক্কত্তি মশায়ের কানে কথাগুলি গেল–তাহার চাকুরির উন্নতি হইতে পারে। মনিবের সুনজরে পড়িলে কি না সম্ভব? খুশির চোটে ইহা সে লক্ষ্যই করিল না যে, পদ্ম ঝি তাহার প্রশংসা শুনিয়া এদিকে হিংসায় নীলবর্ণ হইয়া উঠিয়াছে।

বাবুরা হোটেলের উপর নির্ভর করিল না–তাহারা জিনিসপত্র নিজেরাই কিনিয়া আনিল। হাজারি ঠাকুর মাংস রাঁধিবার একটি বিশেষ প্রণালী জানে, মাংসে একটুকু জল না দিয়া নেপালী ধরনের মাংস রান্নার কায়দা সে তাহাদের গ্রামের নেপাল-ফেরত ডাক্তার শিবচরণ গাঙ্গুলীর স্ত্রীর নিকট অনেকদিন আগে শিখিয়াছিল। কিন্তু হোটেলে দৈনন্দিন খাদ্য তালিকার মধ্যে মাংস কোনদিনই থাকে না–তবে বাধা খরিদ্দারগণের মনস্তুষ্টির জন্য মাসে একবার বা দুবার মাংস দেওয়ার ব্যবস্থা আছে বটে-সে রান্নার মধ্যে বিশেষ কৌশল দেখাইতে গেলে চলে না, বা হাজারির ইচ্ছাও করে না–যেমন ভাল শ্রোতা না পাইলে গায়কের ভাল গান করিতে ইচ্ছা করে না–তেমনি।

হাজারি ঠিক করিল, পদ্ম ঝি তাহাকে দুই চক্ষু পাড়িয়া যেমন দেখিতে পারে না–তেমনি আজ মাংস রাঁধিয়া সকলের বাহবা লইয়া পদ্ম ঝির চোখে আঙুল দিয়া দেখাইয়া দিবে, তাহাকে যত ছোট মনে করে ও, তত ছোট সে নয়। সেও মানুষ, সে অনেক বড় মানুষ।

ভাল যোগাড় না দিলে ভাল রান্না হয় না। পদ্ম ঝি যোগাড় দিবে না এ জানা কথা। হোটেলের অন্য উড়ে বামুনটিকে বলিতে পারা যায় না–কারণ সে-ই হোটেলের সাধারণ রান্না রাঁধিবে।

একবার ভাবিল–কুসুমকে আনবো?

পরক্ষণেই স্থির করিল, তার দরকার নাই। লোকে কে কি বলিবে, পদ্ম ঝি তো বঁটি পাতিয়া কুটিবে কুসুমকে। যাক, নিজেই যাহা হয় করিয়া লইবে এখন।

বেলা হইয়াছে। হাজারি বাজার হইতে কেনা তরি-তরকারী, মাংস নিজেই কুটিয়া বাছিয়া লইয়া রান্না চাপাইয়া দিল। বর্ষাও যেন নামিয়াছে হিমালয় পাহাড় ভাঙিয়া। কাঠগুলা ভিজিয়া গিয়াছে–মাংস সে কয়লার জালে রাঁধিবে না। তাহার সে বিশেষ প্রণালীর মাংস রান্না কয়লার জ্বালে হইবে না।

সব রান্না শেষ হইতে বেলা দুইটা রাজিয়া গেল। তারপরে খরিদ্দার বাবুরা খাইতে বসিল। মাংস পরিবেশন করিবার অনেক পূর্বেই ওস্তাদ শিল্পীর গর্ব ও আত্মপ্রত্যয়ের সহিত হাজারি বুঝিয়াছে, আজ যে ধরনের মাংস রান্না হইয়াছে–ইহাদের ভাল না লাগিয়া উপায় নাই। হইলও তাই।

বাবুরা বেচু চক্কত্তিকে ডাকাইলেন, হাজারি ঠাকুরের সম্বন্ধে এমন সব কথা বলিলেন যে বেচু চক্কত্তিও যেন অস্বস্তি বোধ করিতে লাগিল সে কথা নিয়া। চাকরকে ছোট করিয়া রাখিয়া মনিবের সুবিধা আছে, তাহাকে বড় করিলেই সে পাইয়া বসিবে।

যাইবার সময় একজন বাবু হাজারিকে আড়ালে ডাকিয়া বলিলেন–তুমি এখানে কত পাও ঠাকুর।

–সাত টাকা আর খাওয়া-পরা।

–এই দুটো টাকা তোমাকে আমরা বকশিশ দিলাম–চমৎকার রান্না তোমার। যখন আবার এদিকে আসবো, তুমি আমাদের রেঁধে খাইও।

হাজারি আমি খুশি হইল। বকশিশ ইহারা হয়তো কিছু দিবেন সে আশা করিয়াছিল বটে, কি দু-টাকা দিবেন তা সে ভাবে নাই।

যাইবার সময় বেচু চক্কত্তির সামনে বাবুরা হাজারি রান্নার আর এক দফা প্রশংসা করিয়া গেলেন। আর একবার শীঘ্রই শিকারে আসিবেন এদিকে। তখন এখানে আসিয়া হাজারি ঠাকুরের হাতে মাংস না খাইলে তাহাদের চলিবেই না। বেশ হোটেল করেছেন চক্কত্তি মশায়।

বেচু চক্কত্তি বিনীত ভাবে কাঁচুমাচু হইয়া বলিল–আজ্ঞে বাবু মশায়েরা রাজসই লোক, সব দেখতে পাচ্ছেন, সব বুঝতে পাচ্ছেন। এই রাণাঘাট রেল-বাজারে হোটেল আছে অনেকগুলো, কিন্তু আপনাদের মত লোক যখনই আসেন, সকলেই দয়া করে এই গরীবের কুঁড়েতেই পায়ের ধূলো দিয়ে থাকেন। তা আসবেন, যখন আপনাদের ইচ্ছা হয়, আগে থেকে একখানা চিঠি দেবেন, সব মজুদ থাকবে আপনাদের জন্যে; বলবেন কলকাতায় ফিরে দু’চার জন আলাপী লোককে–যাতে এদিকে এলে তারাও এখানেই এসে ওঠেন। বাবু–তা আমার বামুনের মজুরীটা?…হেঁ-হেঁ–

–কত মজুরী দেবো?

–তা দিন বাবু একবেলার মজুরী আট আনা দিন।

বাবুরা আরও আট আনা পয়সা বেচুর হাতে দিয়া চলিয়া গেলেন।

বেচু হাজারী ঠাকুরকে ডাকিয়া বলিল–ঠাকুর আজ আর বেরিও না কোথাও। বেলা গিয়েচে। উনুনে আঁচ আর একটু পরেই দিতে হবে। পদ্ম কোথায়?

–পদ্মদিদি থালা বাসন বার করচে, ডেকে দেবো?

পদ্ম ঝি আজ যে মুখ ভার করিয়া আছে, হাজারি তাহা বুঝিয়াছিল। আর হোটেলে সকলের সামনে তাহার প্রশংসা করিয়া গিয়াছে বাবুরা, আজ আর কি তাহার মনে সুখ আছে? পদ্ম ঝির মনস্তুষ্টি করিবার জন্য তাহার ভাতের থালায় হাজারি বেশী করিয়া ভাত তরকারি এবং মাংস দিয়াছিল। পদ্ম ঝি কিছুমাত্র প্রসন্ন হইয়াছে বলিয়া মনে হইল না, মুখ যেমন ভার তেমনিই রহিল।

ভাতের থালা উঠাইয়া লইয়া পদ্ম ঝি হঠাৎ প্রশ্ন করিল– রাঁধসা মাংস আর কতটা আছে ঠাকুর?

বলিয়াই ডেকচির দিকে চাহিল। এমন চমৎকার মাংস কুসুমের বাড়ী কিছু দিয়া আসিবে (সে ব্রাহ্মণের বিধবা নয়, মাছ-মাংস খাইতে তাহার আপত্তি নাই) ভাবিয়া ডেকচিতে দেড় পোয়া আন্দাজ মাংস হাজারি রাখিয়া দিয়াছিল–পদ্ম ঝি কি তাহা দেখিতে পাইল?

পদ্ম দেখিয়াছে বুঝিয়া হাজারি বলিল–সামান্য একটু আছে।

–কি হবে ওটুকু? আমায় দাও না-আমার আজ ভাগ্নীজামাই আসবে–তুমি ত মাংস খাও না–

কুসুমের জন্য রাখা মাংস পদ্ম ঝিকে দিতে হইবে–যার মুখ দেখিতে ইচ্ছা করে না হাজারির! হাজারি মাংস খায় না তাহা নয়, হোটেলে মাংস রান্না হইলেই হাজারি নিজের ভাগের মাংস লুকাইয়া কুসুমকে দিয়া আসে–নিজেকে বঞ্চিত করিয়া। পদ্ম ঝি তাহা জানে, জানে বলিয়াই তাহাকে আঘাত করিয়া প্রতিশোধ লইবার ইচ্ছা উহার মনে জাগিয়াছে ইহাও হাজারি বুঝিল।

হাজারি বলিল–তোমায় তো দিলাম পদ্মদিদি, একটুখানি পড়ে আছে ডেকচির তলায় ওটুকু আর তুমি কি করবে?

–কি করবো বললুম, তা তোমার কানে গেল না? ভাগ্নীজামাই এসেছে শুনলে না? যা দিলে এতটুকুতে কি কুলুবে? ঢেলে দাও ওটুকু।

হাজারি বিপন্ন মুখে বলিল–আমি একটু রেখে দিইছি, আমার দরকার আছে।

পদ্ম ঝি ঘুরিয়া দাঁড়াইয়া শ্লেষের সুরে বলিল–কি দরকার? তুমি তো খাও না–কাকে দেবে শুনি?

হাজারি বলিল–দেবো–ও একজন একটু চেয়েছে–

–কে একজন?

–আছে–ও সে তুমি জানো না।

পদ্ম ঝি ভাতের থালা নামাইয়া হাত নাড়িয়া বলিল–না, আমি জানিনে। তা কি আর জানি? আর সে জানা-জানি, আমার দরকার নেই। হোটেলের জিনিস তুমি কাউকে দিতে পারবে না, তোমায় অনেকদিন বলে দিইছি। বেশ তুমি আমায় না দাও, চক্কত্তি মশায়ের শালাও আজ কলকাতা থেকে এসেছে–তার জন্যে মাংস বাটি করে আলাদা রেখে দাও–ওবেলা এসে খাবে এখন। আমি না পেতে পারি, সে হোটেলের মালিকের আপনার লোক, সে তো পেতে পারে?

বেচু চক্কত্তির এই শালাটিকে হাজারি অনেকবার দেখিয়াছে–মাসের মধ্যে দশ দিন আসিয়া ভগ্নীপতির বাড়ী পড়িয়া থাকে, আর কালাপেড়ে ধুতি পরিয়া টেরি কাটিয়া হোটেলে আসিয়া সকলের উপর কর্তৃত্ব চালায়–কথায় কথায় ঠাকুর-চাকরকে অপমান করে; চোখ রাঙায়, যেন হোটেলের মালিক নিজেই।

তাহাদের গ্রামের মেয়ে, দরিদ্ৰা কুসুম ভালটা মন্দটা খাইতে পাওয়া দূরে থাকুক, অনেক সময় পেটের ভাত জুটাইতে পারে না–তাহার জন্য রাখিয়া দেওয়া এত যত্নের মাংস শেষকালে সেই চালবাজ বার্ডসাই-খোর শালাকে দিয়া খাওয়াইতে হইবে–এ প্রস্তাব হাজারির মোটেই ভাল লাগিল না। কিন্তু সে ভালমানুষ এবং কিছু ভীতু ধরনের লোক, যাহাদের হোটেল, তাহারা যদি খাইতে চায়, হাজারি তাহা না দিয়া পারে কি করিয়া–অগত্যা হাজারিকে পদ্ম ঝিয়ের সামনে বড় জামবাটিতে ডেকচির মাংসটুকু ঢালিয়া রান্নাঘরের কুলুঙ্গিতে রেকাবি চাপা দিয়া রাখিয়া দিতে হইল।

সামান্য একটু বেলা আছে, হাজারি সেটুকু সময়ের মধ্যেই একবার নদীর ধারে ফাঁকা জায়গায় বেড়াইতে গেল।

আজ তাহার মনে আত্মপ্রত্যয় খুব বাড়িয়া গিয়াছে–দুইটি জিনিস আজ বুঝিয়াছে সে। প্রথম, ভাল রান্না সে ভুলিয়া যায় নাই, কলিকাতার বাবুরাও তাহার রান্না খাইয়া তারিফ করেন। দ্বিতীয়, পরের তাঁবে কাজ করিলে মানুষকে মায়া-দয়া বিসর্জন দিতে হয়।

আজ এমন চমৎকার রান্না মাংসটুকু সে কুসুমকে খাওয়াইতে পারিল না, খাওয়াইতে হইল তাহাদের দিয়া, যাহাদের সে দুই চক্ষু পাড়িয়া দেখিতে পারে না। কুসুম যেদিন কাঁথাখানি দিয়াছিল, সেদিন হইতে হাজারির কেমন একটা অদ্ভুত ধরনের স্নেহ পড়িয়াছে কুসুমের ওপর।

বয়সে তো সে মেয়ের সমান বটেই, কাজও করিয়াছে মেয়ের মতই। আজ যদি হাজারির হাতে পয়সা থাকিত, তবে সে বাপের স্নেহ কি করিয়া দেখাইতে হয়, দেখাইয়া দিত। অন্য কিছু দেওয়া তো দূরের কথা, নিজের হাতে অমন রান্না মাংসটুকুই সে কুসুমকে দিতে পারিল না।

ছেলেবেলাকার কথা হাজারির মনে হয়। তাহার মা গঙ্গাসাগর যাইবেন বলিয়া যোগাড়-যন্ত্র করিতেছেন–পাড়ার অনেক বৃদ্ধা ও প্রৌঢ়া বিধবাদের সঙ্গে। হাজারি তখন আট বছরের ছেলে–সেও ভীষণ বায়না ধরিল গঙ্গাসাগর সে না গিয়া ছাড়িবেই না। তাহার ঝুঁকি লইতে কেহই রাজী নয়। সকলেই বলিল–তোমার ও ছেলেকে কে দেখাশুনো করবে বাপু, অত ছোট ছেলে আর সেখানে নানা ঝক্কি–তাহলে তোমার যাওয়া হয় না।

হাজারির মা ছেলেকে ফেলিয়া গঙ্গাসাগরে যাইতে পারিলেন না বলিয়া তাঁর যাওয়াই হইল না। জীবনে আর কখনোই তাঁর সাগর দেখা হয় নাই, কিন্তু হাজারির মনে মায়ের এই স্বার্থত্যাগের ঘটনাটকু উজ্জ্বল অক্ষরে লেখা হইয়া আছে।

হাজারি ভাবিল-যাক গে, যদি কখনো নিজে হোটেল খুলতে পারি, তবে এই রাণাঘাটের বাজারে বসেই পদ্ম ঝিকে দেখাবো–তুই কোথায় আর আমি কোথায়! হাতে পয়সা থাকলে কালই না হোটেল খুলে দিতাম! কুসুমকে রোজ রোজ ভাল জিনিস খাওয়াবো আমার নিজের হোটেল হলে।

কতকগুলি বিষয় সে যে খুব ভাল শিখিয়াছে, সে বেশ বুঝিতে পারে। বাজার-করা হোটেলওয়ালার একটি অত্যন্ত দরকারী কাজ এবং শক্ত কাজ। ভাল বাজার করার উপরে হোটেলের সাফল্য অনেকখানি নির্ভর করে এবং ভাল বাজার করার মানেই হইতেছে সস্তায় ভাল জিনিস কেনা। ভাল জিনিসের বদলে সস্তা জিনিস–অথচ দেখিলে তাহাকে মোটেই খেলো বলিয়া মনে হইবে না–এমন দ্রব্য খুঁজিয়া বাহির করা। যেমন বাটা মাছ যেদিন বাজারে আক্রা–সেদিন ছ’আনা সের রেল-চালানী রাস মাছের পোনা কিনিয়া তাহাকে বাটা বলিয়া চালাইতে হইবে–হঠাৎ ধরা বড় কঠিন, কোনটা বাটার পোনা, কোনটা রাসের পোনা।

.

পরদিন হাজারি চূর্ণীর ঘাটে গিয়া অনেকক্ষণ বসিয়া রহিল। তাহার মন কাল হইতে ভাল নয়। পদ্ম ঝির নিকট ভাল ব্যবহার কখনও সে পায় নাই, পাইবার প্রত্যাশাও করে না। কিন্তু তবুও কাল সামান্য একটু রাধা মাংস লইয়া পদ্ম ঝি যে কাণ্ডটি করিল, তাহাতে সে মনোকষ্ট পাইয়াছে খুব বেশী। পরের চাকরি করিতে গেলে এমন হয়। কুসুমকে একটুখানি মাংস না দিতে পারিয়া তাহার কষ্ট হইয়াছে বেশী–অমন ভাল রান্না সে অনেক দিন করে নাই–অত আশার জিনিসটা কুসুমকে দিতে পারিলে তাহার মনটা খুশি হইত।

ভাল কাজ করিলেও চাকুরির উন্নতি তো দূরের কথা, ইহারা সুখ্যাতি পর্যন্ত করিতে জানে না। বরঞ্চ পদে পদে হেনস্থা করে। এক একবার ইচ্ছা হয় যদুবাবুর হোটেলে কাজ লইতে। কিন্তু সেখানেও যে এরকম হইবে না তাহার প্রমাণ কিছুই নাই। সেখানেও পদ্ম ঝি জুটিতে বিলম্ব হইবে না। কি করা যায়।

বেলা পড়িয়া আসিতেছে। আর বেশীক্ষণ বসা যায় না। বহু পাপ না করিলে আর কেহ হোটেলের রাঁধুনীগিরি করিতে আসে না। এখনি গিয়া ডেকচি না চড়াইলে পদ্ম ঝি এক ঝুড়ি কথা শুনাইয়া দিবে, এতক্ষণ উনুনে আঁচ দেওয়া হইয়া গিয়াছে।…কিন্তু ফিরিবার পথে সে কি মনে করিয়া কুসুমের বাড়ী গেল!

কুসুম আসন পাতিয়া দিয়া বলিল–বাবাঠাকুর আসুন, বড় সৌভাগ্য অসময়ে আপনার পায়ের ধূলো পড়লো।

হাজারি বলিল–দ্যাখ, কুসুম, তোর সঙ্গে একটা পরামর্শ করতে এলাম।

কুসুম সাগ্রহ-দৃষ্টিতে মুখের দিকে চাহিয়া বলিল–কি বাবাঠাকুর?

–আমার বয়েস ছেচল্লিশ হয়েছে বটে, কিন্তু আমার তত বয়েস দেখায় না, কি বলিস কুসুম? আমার এখনও বেশ খাটবার ক্ষমতা আছে, তুই কি বলিস?

হাজারির কথাবার্তার গতি কোনদিকে বুঝিতে না পারিয়া কুসুম কিছু বিস্ময়, কিছু কৌতুকের সুরে বলিল–তা–বাবাঠাকুর, তা তো বটেই। বয়েস আপনার এমন আর কি–কেন বাবাঠাকুর?

কুসুমের মনে একটা কথা উঁকি মারিতে লাগিল–বাবাঠাকুর আবার বিয়ে-টিয়ে করবার কথা ভাবচেন নাকি?

হাজারি বলিল–আমার বড় ইচ্ছে আছে কুসুম, একটা হোটেল করব নিজের নামে। পয়সা যদি হাতে কোনদিন জমাতে পারি, এ আমি নিশ্চয়ই করবো, তুই জানিস! পরের ঝাঁটা খেয়ে কাজ করতে আর ইচ্ছে করে না। আমি আজ দশ বছর হোটেলে কাজ করছি, বাজার কি করে করতে হয় ভাল করে শিখে ফেলেছি। চক্কত্তি মশায়ের চেয়েও আমি ভাল বাজার করতে পারি। মাখমপুরের হাট থেকে ফি হাটরা যদি তরিতরকারী কিনে আনি তবে রাণাঘাটের বাজারের চেয়ে টাকায় চার আনা ছ’আনা সস্তা পড়ে। এ ধরো কম লাভ নয় একটা হোটেলের ব্যাপারে। বাজার করবার মধ্যেই হোটেলের কাজের আদ্ধেক লাভ। আমার খুব মনে জোর আছে কুসুম, টাকা পয়সা হাতে যদি কখনো পড়ে, তবে হোটেল যা চালাবো, বাজারের সেরা হোটেলে হবে, তুই দেখে নিস।

কুসুম হাজারি ঠাকুরের এ দীর্ঘ বক্তৃতা অবাক হইয়া শুনিতেছিল–সে হাজারিকে বাবার মত দেখে বলিয়াই মেয়ের মত বাবার প্রতি সর্বপ্রকার কাল্পনিক গুণ ও জ্ঞানের আরোপ করিয়া আসিতেছে। হোটেলের ব্যাপারে সে বিশেষ কিছু বুঝুক না বুঝুক, বাবাঠাকুর যে বুদ্ধিমান, তাহা সে হাজারির বক্তৃতা হইতে ধারণা করিয়া লইল।

কিছুক্ষণ পরে কি ভাবিয়া সে বলিল–আমার এক জোড়া রুলি ছিল, এক গাছা বিক্রী ক’রে দিয়েছি আমার ছোট ছেলের অসুখের সময় আর বছর। আর এক গাছা আছে। বিক্রী করলে যাট-সত্তর টাকা হবে। আপনি নেবেন বাবাঠাকুর? ওই টাকা নিয়ে হোটেল খোলা হবে আপনার।

হাজারি হাসিয়া বলিল–দূর পাগলী! ষাট টাকায় হোটেল হবে কি রে?

–কত টাকা হলে হয়?

–অন্ততঃ দুশো টাকার কম তো নয়। তাতেও হবে না।

–আচ্ছা, হিসেব করে দেখুন না বাবাঠাকুর।

–হিসেব করে দেখব কি, হিসেব আমার মুখে মুখে। ধরো গিয়ে দুটো বড় ডেকচি, ছোট ডেকচি তিনটে। থালা-বাসন এক প্রস্থ। হাতা, খুন্তি, বেড়ি, চামচে, চায়ের বাসন। বাইরে গদির ঘরের একখানা তক্তপোশ, বিছানা, তাকিয়া। বাক্স, খেরো বাঁধানো খাতা দুখানা। বালতি, লণ্ঠন, চাকি, বেলুন–এই সব নানান নটখটি জিনিস কিনতেই তো দুশো টাকার ওপর বেরিয়ে যাবে। পাঁচদিনের বাজার খরচ হাতে করে নিয়ে নামতে হবে। চাকর ঠাকুরের দু’মাসের মাইনে হাতে রেখে দিতে হয়–যদি প্রথম দু’মাস না হলো কিছু, ঠাকুর চাকরের মাইনে আসবে কোথা থেকে? সে-সব যাক-গে, তা ছাড়া তোর টাকা নেবোই বা কেন?

কুসুম রিদ্ধ স্বরে বলিল–আমার থাকতো যদি তবে আপনি নিতেন না কেন–ব্রাহ্মণের সেবায় যদি লাগে ও-টাকা, তবে ও-টাকার ভাগ্যি বাবাঠাকুর। সে ভাগ্যি থাকলে তো হবে, আমার অত টাকা যখন নেই, তখন আর সে কথা বলচি কি করে বলুন। যা আছে, ওতে যদি কখনো-সখনো কোন দরকার পড়ে আপনার মেয়েকে জানাবেন।

হাজারি উঠিল। আর এখানে বসিয়া দেরি করিলে চলিবে না। বলিল–না রে কুসুম, এতে আর কি হবে। আমি যাই এখন।

কুসুম বলিল– একটু কিছু মুখে না দিলে মেয়ের বাড়ী থেকে কি করে উঠবেন বাবাঠাকুর, বসুন আর একটু। আমি আসছি।

কুসুম এত দ্রুত ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল, যে হাজারি ঠাকুর প্রতিবাদ করিবার অবসর পর্যন্ত পাইল না। একটু পরে কুসুম ঘরের মধ্যে একখানা আসন আনিয়া পাতিল এবং মেজের উপর জলের হাত বুলাইয়া লইয়া আবার বাহিরে গেল। কিছুক্ষণ পরে একবাটি দুধ ও একখানা রেকাবিতে পেঁপে কাটা, আমের টিকলি ও দুটি সন্দেশ তানিয়া আসনের সামনে মেজের উপর রাখিয়া বলিল–একটু জল খান, বসুন এসে, আমি খাবার জল আনি। হাজারি আসনের উপর বসিল। কুসুম ঝকঝকে করিয়া মাজা একটা কাঁচের গেলাসে জল আনিয়া রেকাবির পাশে রাখিয়া সামনে দাঁড়াইয়া রহিল।

খাইতে খাইতে হাজারির মনে পড়িল সেদিনকার সেই মাংসের কথা। মেয়ের মত স্নেহ-যত্ন করে কুসুম, তাহারই জন্য তুলিয়া রাখা মাংস কিনা খাওয়াইতে হইল চক্কত্তি মহাশয়ের গাঁজাখোর শালাকে দিয়া শুধু ওই পদ্ম ঝিয়ের জন্যে। দাসত্বের এই তো সুখ!

হাজারি বলিল–তুই আমার মেয়ের মতন কুসুম-মা।

কুসুম হাসিয়া বলিল–মেয়ের মতন কেন বাবাঠাকুর, মেয়েই তো।

–ঠিক, মেয়েই তো। মেয়ে না হোলে বাপের এত যত্ন কে করে?

–যত্ন আর কি করেছি, সে ভাগ্যি ভগবান কি আমায় দিয়েছেন। একে কি যত্ন করা বলে? কাঁথাখানা পেতে শুচ্চেন বাবাঠাকুর?

–তা শুচ্চি বই কি রে। রোজ তোর কথা মনে হয় শোবার সময়। মনে ভাবি কুসুম এখানা দিয়েছে। ছেঁড়া মাদুরের কাটি ফুটে ফুটেঁপিঠে দাগ হয়ে গিয়েছিল। পেতে শুয়ে বেঁচেছি।

–আহা, কি যে বলেন! না, সন্দেশ দুটোই খেয়ে ফেলুন, পায়ে পড়ি। ও ফেলতে পারবেন না।

–কুসুম, তোর জন্যে না রেখে খেতে পারি কিছু মা? ওটা তোর কাছে রেখে দিলাম।

কুসুম লজায় চুপ করিয়া বহিল। হাজারি আসন হইতে উঠিয়া পড়িলে বলিল–পান আনি, দাঁড়ান।

তাহার পর সামনে দরজা পর্যন্ত আগাইয়া দিতে আসিয়া বলিল–আমার ও রুলি গাছা রইল তোলা আপনার জন্যে, বাবাঠাকুর। যখন দরকার হয়, মেয়ের কাছ থেকে নেবেন কিন্তু।

সেদিন হোটেলে ফিরিয়া হাজারি দেখিল, প্রায় পনেরো সের কি আধ মণ ময়দা চাকর আর পদ্ম ঝি মিলিয়া মাখিতেছে।

ব্যাপার কি! এত লুচির ময়দা কে খাইবে?

পদ্ম ঝি কথার সঙ্গে বেশ খানিকটা ঝাঁজ মিশাইয়া বলিল–হাজারি ঠাকুর, তোমার যা যা রাঁধবার আগে সেরে নাও–তারপর এই লুচিগুলো ভেযে ফেলতে হবে। আচার্য-পাড়ায় মহাদেব ঘোষালের বাড়ীতে খাবার যাবে, তারা অর্ডার দিয়ে গেছে সাড়ে ন’টার মধ্যে চাই, বুঝলে।

হাজারি ঠাকুর অবাক হইয়া বলিল–সাড়ে ন’টার মধ্যে ওই আধ মণ ময়দা ভেজে পাঠিয়ে দেবো, আবার হোটেলের রান্না রাঁধবো! কি যে বল পদ্মদিদি, তা কি করে হবে? রতন ঠাকুকে বল না লুচি ভেঙে দিক, আমি হোটেলের রান্না বাঁধবো।

পদ্ম ঝি চোখ রাঙাইয়া ছাড়া কথা বলে না। সে গরম হইয়া ঝঙ্কার দিয়া বলিল– তোমার ইচ্ছে বা খুশিতে এখানকার কাজ চলবে না। কর্তা মশায়ের হুকুম। আমায় যা বলে গেছেন তোমায় বললাম, তিনি বড় বাজারে বেরিয়ে গেলেন–আসতে রাত হবে। এখন তোমার মর্জি–করো আর না করো।

অর্থাৎ না করিয়া উপায় নাই। কিন্তু ইহাদের এই অবিচারে হাজারির চোখে প্রায় জল আসিল। নিছক অবিচার ছাড়া ইহা অন্য কিছু নহে। রতন ঠাকুরকে দিয়া ইহারা সাধারণ রান্না অনায়াসেই করাইতে পারিত, কিন্তু পদ্ম ঝি তাহা হইলে খুশি হইবে না। সে যে কি বিষ-চক্ষে পড়িয়াছে পদ্ম ঝিয়ের! উহাকে জব্দ করিবার কোনো ফাঁকই পদ্ম ছাড়ে না।

ভীষণ আগুনের তাতের মধ্যে বসিয়া রতন ঠাকুরের সঙ্গে দৈনিক রান্না কাৰ্যেতেই প্রায় ন’টা বাজিয়া গেল। পদ্ম ঝি তাহার পর ভীষণ তাগাদা লাগাইল লুচি ভাজাতে হাত দিবার জন্য। পদ্ম নিজে খাটিতে রাজি নয়, সে গেল খরিদ্দারদের খাওয়ার তদারক করিতে। আজ আবার হাটবার, বহু ব্যাপারী খরিদ্দার। রতন ঠাকুর তাহাদের পরিবেশন করিতে লাগিল। হাজারি এক ছিলিম তামাক খাইয়া লইয়াই আবার আগুনের তাতে বসিয়া গেল লুচি ভাজিতে।

আধঘণ্টা পরে–তখন পাঁচ সের ময়দাও ভাজা হয় নাই–পদ্ম আসিয়া বলিল–ও ঠাকুর, লুচি হয়েছে? ওদের লোক এসেছে নিতে।

হাজারি বলিল–না এখনো হয়নি পদ্মদিদি। একটু ঘুরে আসতে বল।

–ঘুরে আসতে বললে চলবে কেন? সাড়ে ন’টার মধ্যে ওদের খাবার তৈরি করে রাখতে হবে বলে গেছে। তোমায় বলিনি সেকথা?

–বল্লে কি হবে পদ্মদিদি? মন্তরে ভাজা হবে আধ মণ ময়দা? ন’টার সময় তো উনুনে ব্ৰহ্মার নেচি ফেলেচি–জিগ্যেস করো মতিকে।

–সে সব আমি জানিনে। যদি ওরা অর্ডার ফেরত দেয়, বোঝাপড়া ক’রো কর্তার সঙ্গে, তোমার মাইনে থেকে আধ মন ময়দা আর দশ সের ঘি র দাম একমাসে তো উঠবে না, তিন মাসে ওঠাতে হবে।

হাজারি দেখিল, কথা কাটাকাটি করিয়া লাভ নাই। সে নীরবে লুচি ভাজিয়া যাইতে লাগিল। হাজারি ফাঁকি দেওয়া অভ্যাস করে নাই–কাজ করিতে বসিয়া শুধু ভাবে কাজ করিয়া যাওয়াই তাহার নিয়ম–কেউ দেখুক বা না-ই দেখুক। লুচি ঘিয়ে ডুবাইয়া তাড়াতাড়ি তুলিয়া ফেলিলে শীঘ্র শীঘ্র কাজ চুকিয়া যায় বটে, কিন্তু তাহাতে লুচি কাঁচা থাকিয়া যাইবে। এজন্য সে ধীরে ধীরে সময় লইয়া লুচি তুলিতে লাগিল। পদ্ম ঝি একবার বলিল– অত দেরি করে খোলা নামাচ্ছ কেন ঠাকুর? হাত চালাও না–অত লুচি ডুবিয়ে রাখলে কড়া হয়ে যাবে–

হাজারি ভাবিল, একবার সে বলে যে রান্নার কাজ পদ্ম ঝিয়ের কাছে তাহাকে শিখিতে হইবে না, লুচি ডুবাইলে কড়া কি নরম হয় সে ভালই জানে, কিন্তু তখনই সে বুঝিল, পদ্ম ঝি কেন একথা বলিতেছে।

দশ সের ঘি হইতে জলতি বাদে যাহা বাকী থাকিবে পদ্ম ঝিয়ের লাভ। সে বাড়ী লইয়া যাইবে লুকাইয়া। কর্তামশায় পদ্ম ঝিয়ের বেলায় অন্ধ। দেখিয়াও দেখেন না।

হাজাৰি ভাবিল, এই সব জুয়াচুরির জন্য হোটেলের দুর্নাম হয়। খদ্দেরে পয়সা দেবে, তারা কাঁচা লুচি খাবে কেন? দশ সের ঘিয়ের দাম তো তাদের কাছ থেকে আদায় হয়েছে, তবে তা থেকে বাঁচানোই বা কেন? তাদের জিনিসটা যাতে ভাল হয় তাই তো দেখতে হবে? পদ্ম ঝি বাড়ী নিয়ে যাবে বলে তারা দশ সের ঘিয়ের ব্যবস্থা করে নি।

পরক্ষণেই তাহার নিজের স্বপ্নে সে ভোর হইয়া গেল।

এই রেল-বাজারেই সে হোটেল খুলিবে। তাহার নিজের হোটেল। ফাঁকি কাহাকে বলে, তাহার মধ্যে থাকিবে না। খদ্দের যে জিনিসের অর্ডার দিবে, তাহার মধ্যে চুরি সে করিবে না। খদ্দের সন্তুষ্ট করিয়া ব্যবসা। নিজের হাতে রাঁধিবে, খাওয়াইয়া সকলকে সন্তুষ্ট রাখিবে। চুরি-জুয়াচুরির মধ্যে সে নাই।

লুচি ভাজা ঘিয়ের বুদ্বুদের মধ্যে হাজারি ঠাকুর যেন সেই ভবিষ্যৎ হোটেলের ছবি দেখিতে পাইতেছে। প্রত্যেক ঘিয়ের বুদ্বুদটাতে। পদ্ম ঝি সেখানে নাই, বেচু চক্কত্তির গাঁজাখোর ও মাতাল শালাও নাই। বাহিরে গদির ঘরে দিব্য ফর্সা বিছানা পাতা, খদ্দের যতক্ষণ ইচ্ছা বিশ্রাম করুক, তামাক খাইতে ইচ্ছা করে থাক, বাড়তি পয়সা আর একটিও দিতে হইবে না। দুইটা করিয়া মাছ, হপ্তায় তিন দিন মাংস বাঁধা-খদ্দেরদের। এসব না করিয়া শুধু ইষ্টিশনের প্লাটফর্মে–হি-ই-ইন্দু হোটেল, হি-ই-ই-ন্দু হোটেল, বলিয়া মতি চাকরের মত চেঁচাইয়া গলা ফাটাইলে কি খদ্দের ভিড়িবে?

পদ্ম ঝি আসিয়া বলিল–ও ঠাকুর, তোমার হোল? হাত চালিয়ে নিতে পাচ্ছ না? বাবুদের নোক যে বসে আছে।

বলিয়াই ময়দার বারকোশের দিকে চাহিয়া দেখিল, বেলা লুচি যতগুলি ছিল, হাজারি প্রায় সব খোলায় চাপাইয়া দিয়াছে–খান পনেরো কুড়ির বেশী বারকোশে নাই। মতি চাকর পদ্ম ঝিকে আসিতে দেখিয়া তাড়াতাড়ি হাত চালাইতে লাগিল।

পদ্ম ঝি বলিল–তোমার হাত চলচে না, না? এখনো দশ সের ময়দার তাল ডাঙায়, ওই রকম করে লুচি বেললে কখন কি হবে?

হাজারি বলিল–পদ্মদিদি, রাত এগারোটা বাজবে ওই লুচি বেলতে আর এক হাতে ভাজতে। তুমি বেলবার লোক দাও।

পদ্ম ঝি মুখ নাড়িয়া বলিল–আমি ভাড়া করে আনি বেলবার লোক তোমার জন্যে। ও আমার বাবু রে! ভাজতে হয় ভাজো, না হয় না ভাজো গে–ফেরত গেলে তখন কর্তামশায় তোমার সঙ্গে বোঝাপড়া করবেন এখন।

পদ্ম ঝি চলিয়া গেল।

মতি চাকর বলিল–ঠাকুর, তুমি লুচি ভেজে উঠতে পারবে কি করে? লুচি পোড়াবে না। এত ময়দার তাল আমি বেলবো কখন বলো।

হঠাৎ হাজারির মনে হইল, একজন মানুষ এখনি তাহাকে সাহায্য করিতে বসিয়া যাইত–কুসুম! কিন্তু সে গৃহস্থের মেয়ে, গৃহস্থের ঘরের বৌ–তাহাকে তো এখানে আনা যায় না। যদিও ইহা ঠিক, খবর পাঠাইয়া তাহার বিপদ জানাইলে কুসুম এখনি ছুটিয়া আসিত।

তারপর একঘণ্টা হাজারি অন্য কিছু ভাবে নাই, কিছু দেখে নাই–দেখিয়াছে শুধু লুচির কড়া, ফুটন্ত ঘি, ময়দার তাল আর বাখারির সরু আগায় ভাজিয়া তোলা রাঙ্গা রাঙ্গা লুচির গোছা–তাহা হইতে গরম ঘি ঝরিয়া পড়িতেছে। ভীষণ আগুনের তাত, মাজা পিঠ বিষম টনটন করিতেছে, ঘাম ঝরিয়া কাপড় ও গামছা ভিজিয়া গিয়াছে, এক ছিলিম তামাক খাইবারও অবকাশ নাই–শুধু কাঁচা লুচি কড়ায় ফেলা এবং ভাজিয়া তুলিয়া ঘি ঝরাইয়া পাশের ধামাতে রাখা।

রাত দশটা।

মুর্শিদাবাদের গাড়ী আসিবার সময় হইল।

মতি চাকর বলিল–আমি একবার ইষ্টিশনে যাই ঠাকুরমশায়। টেরেনের টাইম হয়েছে। খদ্দের না আনলে কাল কর্তামশায়ের কাছে মার খেতে হবে। একটা বিড়ি খেয়ে যাই।

ঠিক কথা, সে খানিকক্ষণ প্লাটফর্মে পায়চারি করিতে করিতে ‘হি-ই-ই- হোটেল’ ‘হি-ই-ই-দু হোটেল’ বলিয়া চেঁচাইবে। মুর্শিদাবাদের ট্রেন আসিতে আর মিনিট পনেরো বাকী।

হাজারি বলিল–একা আমি বেলবো আর ভাজবো। তুই কি খেপলি মতি? দেখলি তো এদের কাণ্ড। রতনঠাকুর সরে পড়েছে, পদ্মদিদিও বোধ হয় সরে পড়েছে। আমি একা কি করি?

মতি বলিল–তোমাকে পদ্মদিদি দুচোখে দেখতে পারে না। কারো কাছে বোলো না ঠাকুর–এ সব তারই কারসাজি। তোমাকে জব্দ করবার মতলবে এ কাজ করেচে। আমি যাই, নইলে আমার চাকরি থাকবে না।

মতি চলিয়া গেল। অন্ততঃ পাঁচ সের ময়দার তাল তখনও বাকী। লেচি পাকানো সে-ও প্রায় দেড় সের–হাজারি গুণিয়া দেখিল ষোল গণ্ডা লেচি। অসম্ভব! একজন মানুষের দ্বারা কি করিয়া রাত বারোটার কমে বেলা এবং ভাজা দুই কাল হইতে পারে!

মতি চলিয়া যাইবার সময় যে বিড়িটা দিয়া গিয়াছিল সেটি তখনও ফুরায় নাই–এমন সময় পদ্ম উঁকি মারিয়া বলিল–কেবল বিড়ি খাওয়া আর কেবল বিড়ি খাওয়া! ওদিকে বাবুর বাড়ী থেকে নোক দুবার ফিরে গেল–তখনি তো বলেচি হাজারি ঠাকুরকে দিয়ে এ কাজ হবে না–বলি বিড়িটা ফেলে কাজে হাত দেও না, রাত কি আর আছে?

হাজারি ঠাকুর সত্যই কিছু অপ্রতিভ হইয়া বিড়ি ফেলিয়া দিল। পদ্ম ঝিয়ের সামনে সে একথা বলিতে পারিল না যে, লুচি বেলিবার লোক নই। আবার সে লুচি ভাজিতে আরম্ভ করিয়া দিল একাই।

রাত এগারোটার বেশী দেরি নাই। হাজারির এখন মনে হইল যে, সে আর বসিতে পারিতেছে না। কেবলই এই সময়টা মনে আসিতেছিল দুটি মুখ। একটি মুখ তাহার নিজের মেয়ে টেঁপির–বছর বারো বয়স, বাড়ীতে আছে; প্রায় পাঁচ ছ’মাস তার সঙ্গে দেখা হয় নাই–আর একটি মুখ কুসুমের। ওবেলা কুসুমের সেই যত্ন করিয়া বসাইয়া জল খাওয়ানো…তার সেই হাসিমুখ …টেঁপির মুখ আর কুসুমের মুখ এক হইয়া গিয়াছে…লুচি ও ঘিয়ের বুদ্বুদে সে তখনও যেন একখানা মুখই দেখিতে পাইতেছে–টেঁপি ও কুসুম দুইয়ে মিলিয়া এক…ওরা আজ যদি দু’জনে এখানে থাকিত। ওদিকে কুসুম বসিয়া হাসিমুখে লুচি বেলিতেছে এদিকে টেঁপি…

–ঠাকুর!

স্বয়ং কর্তামশায়, বেচু চক্কত্তি। পিছনে পদ্ম ঝি। পদ্ম ঝি বলিল–ও গাঁজাখোর ঠাকুরকে দিয়ে হবে না আপনাকে তখুনি বলিনি বাবু? ও গাঁজা খেয়ে বুঁদ হয়ে আছে, দেখচো না? কাজ এগুবে কোত্থেকে!

হাজারি তটস্থ হইয়া আরও তাড়াতাড়ি লুচি খোলা হইতে তুলিতে লাগিল। বাবুদের লোক আসিয়া বসিয়া ছিল। পদ্ম ঝি যে লুচি ভাজা হইয়াছিল, তাহাদের ওজন করিয়া দিল কর্তাবাবুর সামনে। পাঁচ সের ময়দার লুচি বাকী থাকিলেও তাহারা লইল না, এত রাত্রে লইয়া গিয়া কোনো কাজ হইবে না।

বেচু চক্কত্তি হাজৰিকে বলিলেন–এই ঘি আর ময়দার দাম তোমার মাইনে থেকে কাটা যাবে। গাঁজাখোর মানুষকে দিয়ে কি কাজ হয়?

হাজারি বলিল–আপনার হোটেলে সব উল্টো বন্দোবস্ত বাবু। কেউ তো বেলে দিতে আসেনি এক মতি চাকর ছাড়া। সেও গাড়ীর টাইমে ইষ্টিশনে খদ্দের আনতে গেল, আমি কি করব বাবু।

বেচু চক্কত্তি বলিলেন–সে সব শুনচি নে ঠাকুর। ওর দাম তুমি দেবে। খদ্দের অর্ডার ফেরত দিলে সে মাল আমি নিজের ঘর থেকে লোকসান দিতে পারিনে, আর মাখা নেচি কাটা ময়দা।

হাজারি ভাবিল, বেশ, তাহাকে যদি এদের দাম দিতে হয়, লুচি ভাজিয়া সে নিজে লইবে। রাত সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত খাটিয়া ও মতি চাকরকে কিছু অংশ দিবার জন্য লোভ দেখাইয়া তাহাকে দিয়া লুচি বেলাইয়া সব ময়দা ভাজিয়া তুলিল। মতি তাহার অংশ লইয়া চলিয়া গেল। এখনও তিন চার বুড়ি লুচি মজুত।

পদ্ম ঝি উঁকি মারিয়া বলিল–লুচি ভাজচো এখনও বসে? আমাকে খানকতক দাও দিকি–

বলিয়া নিজেই একখানা গামছা পাতিয়া নিজের হাতে খান পঁচিশ-ত্রিশ গরম লুচি তুলিয়া লইল। হাজারি মুখ ফুটিয়া বারণ করিতে পারিল না। সাহসে কুলাইল না।

অনেক রাত্রে সুপ্তোত্থিতা কুসুম চোখ মুছিতে মুছিতে বাহিরের দরজা খুলিয়া সম্মুখে মস্ত এক পোঁটলা-হাতে-ঝোলানো অবস্থায় হাজারি ঠাকুরকে দেখিয়া বিস্ময়ের সুরে বলিল–কি বাবাঠাকুর, কি মনে করে এত রাত্রে?…

হাজারি বলিল–এতে লুচি আছে মা কুসুম। হোটেলে লুচি ভাজতে দিয়েছিল খদ্দেরে। বেলে দেবার লোক নেই–শেষকালে খদ্দের পাঁচ সের ময়দার লুচি নিলে না, কর্তাবাবু বলেন আমায় তার দাম দিতে হবে। বেশ আমায় দাম দিতে হয় আমিই নিয়ে নিই। তাই তোমার জন্যে বলি নিয়ে যাই, কুসুমকে তো কিছু দেওয়া হয় না কখনো। রাত বড্ড হয়ে গিয়েচে– ঘুমিয়েছিলে বুঝি? ধর তো মা বোঁচকাটা রাখো গে যাও।

কুসুম বোঁচকাটা হাজারির হাত হইতে নামাইয়া লইল। সে একটু অবাক হইয়া গিয়াছে, বাবাঠাকুর পাগল, নতুবা এত রাত্রে–(তাহার এক ঘুম হইয়া গিয়াছে–), এখন আসিয়াছে লুচির বোঁচকা লইয়া।

হাজারি বলিল, আমি যাই মা–লুচি গরম আর টাটকা, এই ভেজে তুলিচি। তুমি খানকতক খেয়ে ফেলো গিয়ে এখনি। কাল সকালে বাসি হয়ে যাবে। আর ছেলেপিলেদের দাও গিয়ে। কত আর রাত হয়েচে– সাড়ে বারোটার বেশী নয়।

সেদিন ছিল বেশ বর্ষা।

হাজারি দেখিল, হোটেলে গদির ঘরে অনেকগুলি ভদ্রলোক বসিয়া আছে। অন্যদিন এ ধরনের খদ্দের এ হোটেলে সাধারণতঃ আসে না–হাজারি ইহাদের দেখিয়া একটু বিস্মিত হইল।

বেচু চক্কত্তি ডাকিল–হাজারি ঠাকুর, এদিকে এস–হাজারি গদির ঘরে দরজায় আসিয়া দাঁড়াইলে ভদ্রলোকদের একজন বলিলেন–এই ঠাকুরটির নাম হাজারি?

বেচু চক্কত্তি বলিল–হাঁ বাবু, এরই নাম হাজারি।

বাবুটি বলিলেন–এর কথাই শুনেচি। ঠাকুর তুমি আজ বর্ষার দিনে আমাদের মাংস পোলাও রেঁধে ভাল করে খাওয়াতে পারবে? তোমার আলাদা মজুরী যা হয় দেবো।

বেচু বলিল–ওকে আলাদা মজুরী দেবেন কেন বাবু, আপনাদের আশীর্বাদে আমার হোটেলের নাম অনেক দূর অবধি লোকে জানে। ও আমারই ঠাকুর, ওকে কিছু দিতে হবে না। আপনারা যা হুকুম করবেন তা ও করবে।

এই সময় পদ্ম ঝি বেচু চক্কত্তির ডাকে ঘরে ঢুকিল।

বেচু চক্কত্তি কিছু বলিবার পূর্বে জনৈক বাবু বলিল–ঝি, আমাদের একটু চা ক’রে খাওয়াও তো এই বর্ষার দিনটাতে। না হয় কোনো দোকান থেকে একটু এনে দাও। বুঝলেন চক্কত্তি মশায়। আপনার হোটেলের নাম অনেক দূর পর্যন্ত যে গিয়েছে বল্লেন–সে কথা মিথ্যা নয়। আমরা যখন আজ শিকারে বেরিয়েছি, তখন আমার পিসতুতো ভাই বলে দিয়েছিল, রাণাঘাট যাচ্চ, শিকার করে ফেরবার পথে রেল-বাজারের বেচু চক্কত্তির হোটেলের হাজারি ঠাকুরের হাতে মাংস খেয়ে এসো। তাই আজ সারাদিন জলায় আর বিলে পাখী মেয়ে বেড়িয়ে বেড়িয়ে ভাবলাম, ফিরবার গাড়ী তো রাত দশটায়। তা এ বর্ষার দিনে গরম গরম মাংস একটু খেয়েই যাই। মজুরী কেন দেবো না চক্কত্তি মশায়? ও আমাদের রান্না করুক, আমরা ওকে খুশি করে দিয়ে যাবো। ওর জন্যেই তো এখানে আসা। কথা শুনিয়া হাজারি অত্যন্ত খুশি হইয়া উঠিল, আরও সে খুশি হইল এই ভাবিয়া যে, চক্কত্তি মশায়ের কানে কথাগুলি গেল–তাহার চাকুরির উন্নতি হইতে পারে। মনিবের সুনজরে পড়িলে কি না সম্ভব? খুশির চোটে ইহা সে লক্ষ্যই করিল না যে, পদ্ম ঝি তাহার প্রশংসা শুনিয়া এদিকে হিংসায় নীলবর্ণ হইয়া উঠিয়াছে।

বাবুরা হোটেলের উপর নির্ভর করিল না–তাহারা জিনিসপত্র নিজেরাই কিনিয়া আনিল। হাজারি ঠাকুর মাংস রাঁধিবার একটি বিশেষ প্রণালী জানে, মাংসে একটুকু জল না দিয়া নেপালী ধরনের মাংস রান্নার কায়দা সে তাহাদের গ্রামের নেপাল-ফেরত ডাক্তার শিবচরণ গাঙ্গুলীর স্ত্রীর নিকট অনেকদিন আগে শিখিয়াছিল। কিন্তু হোটেলে দৈনন্দিন খাদ্য তালিকার মধ্যে মাংস কোনদিনই থাকে না–তবে বাধা খরিদ্দারগণের মনস্তুষ্টির জন্য মাসে একবার বা দুবার মাংস দেওয়ার ব্যবস্থা আছে বটে-সে রান্নার মধ্যে বিশেষ কৌশল দেখাইতে গেলে চলে না, বা হাজারির ইচ্ছাও করে না–যেমন ভাল শ্রোতা না পাইলে গায়কের ভাল গান করিতে ইচ্ছা করে না–তেমনি।

হাজারি ঠিক করিল, পদ্ম ঝি তাহাকে দুই চক্ষু পাড়িয়া যেমন দেখিতে পারে না–তেমনি আজ মাংস রাঁধিয়া সকলের বাহবা লইয়া পদ্ম ঝির চোখে আঙুল দিয়া দেখাইয়া দিবে, তাহাকে যত ছোট মনে করে ও, তত ছোট সে নয়। সেও মানুষ, সে অনেক বড় মানুষ।

ভাল যোগাড় না দিলে ভাল রান্না হয় না। পদ্ম ঝি যোগাড় দিবে না এ জানা কথা। হোটেলের অন্য উড়ে বামুনটিকে বলিতে পারা যায় না–কারণ সে-ই হোটেলের সাধারণ রান্না রাঁধিবে।

একবার ভাবিল–কুসুমকে আনবো?

পরক্ষণেই স্থির করিল, তার দরকার নাই। লোকে কে কি বলিবে, পদ্ম ঝি তো বঁটি পাতিয়া কুটিবে কুসুমকে। যাক, নিজেই যাহা হয় করিয়া লইবে এখন।

বেলা হইয়াছে। হাজারি বাজার হইতে কেনা তরি-তরকারী, মাংস নিজেই কুটিয়া বাছিয়া লইয়া রান্না চাপাইয়া দিল। বর্ষাও যেন নামিয়াছে হিমালয় পাহাড় ভাঙিয়া। কাঠগুলা ভিজিয়া গিয়াছে–মাংস সে কয়লার জালে রাঁধিবে না। তাহার সে বিশেষ প্রণালীর মাংস রান্না কয়লার জ্বালে হইবে না।

সব রান্না শেষ হইতে বেলা দুইটা রাজিয়া গেল। তারপরে খরিদ্দার বাবুরা খাইতে বসিল। মাংস পরিবেশন করিবার অনেক পূর্বেই ওস্তাদ শিল্পীর গর্ব ও আত্মপ্রত্যয়ের সহিত হাজারি বুঝিয়াছে, আজ যে ধরনের মাংস রান্না হইয়াছে–ইহাদের ভাল না লাগিয়া উপায় নাই। হইলও তাই।

বাবুরা বেচু চক্কত্তিকে ডাকাইলেন, হাজারি ঠাকুরের সম্বন্ধে এমন সব কথা বলিলেন যে বেচু চক্কত্তিও যেন অস্বস্তি বোধ করিতে লাগিল সে কথা নিয়া। চাকরকে ছোট করিয়া রাখিয়া মনিবের সুবিধা আছে, তাহাকে বড় করিলেই সে পাইয়া বসিবে।

যাইবার সময় একজন বাবু হাজারিকে আড়ালে ডাকিয়া বলিলেন–তুমি এখানে কত পাও ঠাকুর।

–সাত টাকা আর খাওয়া-পরা।

–এই দুটো টাকা তোমাকে আমরা বকশিশ দিলাম–চমৎকার রান্না তোমার। যখন আবার এদিকে আসবো, তুমি আমাদের রেঁধে খাইও।

হাজারি আমি খুশি হইল। বকশিশ ইহারা হয়তো কিছু দিবেন সে আশা করিয়াছিল বটে, কি দু-টাকা দিবেন তা সে ভাবে নাই।

যাইবার সময় বেচু চক্কত্তির সামনে বাবুরা হাজারি রান্নার আর এক দফা প্রশংসা করিয়া গেলেন। আর একবার শীঘ্রই শিকারে আসিবেন এদিকে। তখন এখানে আসিয়া হাজারি ঠাকুরের হাতে মাংস না খাইলে তাহাদের চলিবেই না। বেশ হোটেল করেছেন চক্কত্তি মশায়।

বেচু চক্কত্তি বিনীত ভাবে কাঁচুমাচু হইয়া বলিল–আজ্ঞে বাবু মশায়েরা রাজসই লোক, সব দেখতে পাচ্ছেন, সব বুঝতে পাচ্ছেন। এই রাণাঘাট রেল-বাজারে হোটেল আছে অনেকগুলো, কিন্তু আপনাদের মত লোক যখনই আসেন, সকলেই দয়া করে এই গরীবের কুঁড়েতেই পায়ের ধূলো দিয়ে থাকেন। তা আসবেন, যখন আপনাদের ইচ্ছা হয়, আগে থেকে একখানা চিঠি দেবেন, সব মজুদ থাকবে আপনাদের জন্যে; বলবেন কলকাতায় ফিরে দু’চার জন আলাপী লোককে–যাতে এদিকে এলে তারাও এখানেই এসে ওঠেন। বাবু–তা আমার বামুনের মজুরীটা?…হেঁ-হেঁ–

–কত মজুরী দেবো?

–তা দিন বাবু একবেলার মজুরী আট আনা দিন।

বাবুরা আরও আট আনা পয়সা বেচুর হাতে দিয়া চলিয়া গেলেন।

বেচু হাজারী ঠাকুরকে ডাকিয়া বলিল–ঠাকুর আজ আর বেরিও না কোথাও। বেলা গিয়েচে। উনুনে আঁচ আর একটু পরেই দিতে হবে। পদ্ম কোথায়?

–পদ্মদিদি থালা বাসন বার করচে, ডেকে দেবো?

পদ্ম ঝি আজ যে মুখ ভার করিয়া আছে, হাজারি তাহা বুঝিয়াছিল। আর হোটেলে সকলের সামনে তাহার প্রশংসা করিয়া গিয়াছে বাবুরা, আজ আর কি তাহার মনে সুখ আছে? পদ্ম ঝির মনস্তুষ্টি করিবার জন্য তাহার ভাতের থালায় হাজারি বেশী করিয়া ভাত তরকারি এবং মাংস দিয়াছিল। পদ্ম ঝি কিছুমাত্র প্রসন্ন হইয়াছে বলিয়া মনে হইল না, মুখ যেমন ভার তেমনিই রহিল।

ভাতের থালা উঠাইয়া লইয়া পদ্ম ঝি হঠাৎ প্রশ্ন করিল– রাঁধসা মাংস আর কতটা আছে ঠাকুর?

বলিয়াই ডেকচির দিকে চাহিল। এমন চমৎকার মাংস কুসুমের বাড়ী কিছু দিয়া আসিবে (সে ব্রাহ্মণের বিধবা নয়, মাছ-মাংস খাইতে তাহার আপত্তি নাই) ভাবিয়া ডেকচিতে দেড় পোয়া আন্দাজ মাংস হাজারি রাখিয়া দিয়াছিল–পদ্ম ঝি কি তাহা দেখিতে পাইল?

পদ্ম দেখিয়াছে বুঝিয়া হাজারি বলিল–সামান্য একটু আছে।

–কি হবে ওটুকু? আমায় দাও না-আমার আজ ভাগ্নীজামাই আসবে–তুমি ত মাংস খাও না–

কুসুমের জন্য রাখা মাংস পদ্ম ঝিকে দিতে হইবে–যার মুখ দেখিতে ইচ্ছা করে না হাজারির! হাজারি মাংস খায় না তাহা নয়, হোটেলে মাংস রান্না হইলেই হাজারি নিজের ভাগের মাংস লুকাইয়া কুসুমকে দিয়া আসে–নিজেকে বঞ্চিত করিয়া। পদ্ম ঝি তাহা জানে, জানে বলিয়াই তাহাকে আঘাত করিয়া প্রতিশোধ লইবার ইচ্ছা উহার মনে জাগিয়াছে ইহাও হাজারি বুঝিল।

হাজারি বলিল–তোমায় তো দিলাম পদ্মদিদি, একটুখানি পড়ে আছে ডেকচির তলায় ওটুকু আর তুমি কি করবে?

–কি করবো বললুম, তা তোমার কানে গেল না? ভাগ্নীজামাই এসেছে শুনলে না? যা দিলে এতটুকুতে কি কুলুবে? ঢেলে দাও ওটুকু।

হাজারি বিপন্ন মুখে বলিল–আমি একটু রেখে দিইছি, আমার দরকার আছে।

পদ্ম ঝি ঘুরিয়া দাঁড়াইয়া শ্লেষের সুরে বলিল–কি দরকার? তুমি তো খাও না–কাকে দেবে শুনি?

হাজারি বলিল–দেবো–ও একজন একটু চেয়েছে–

–কে একজন?

–আছে–ও সে তুমি জানো না।

পদ্ম ঝি ভাতের থালা নামাইয়া হাত নাড়িয়া বলিল–না, আমি জানিনে। তা কি আর জানি? আর সে জানা-জানি, আমার দরকার নেই। হোটেলের জিনিস তুমি কাউকে দিতে পারবে না, তোমায় অনেকদিন বলে দিইছি। বেশ তুমি আমায় না দাও, চক্কত্তি মশায়ের শালাও আজ কলকাতা থেকে এসেছে–তার জন্যে মাংস বাটি করে আলাদা রেখে দাও–ওবেলা এসে খাবে এখন। আমি না পেতে পারি, সে হোটেলের মালিকের আপনার লোক, সে তো পেতে পারে?

বেচু চক্কত্তির এই শালাটিকে হাজারি অনেকবার দেখিয়াছে–মাসের মধ্যে দশ দিন আসিয়া ভগ্নীপতির বাড়ী পড়িয়া থাকে, আর কালাপেড়ে ধুতি পরিয়া টেরি কাটিয়া হোটেলে আসিয়া সকলের উপর কর্তৃত্ব চালায়–কথায় কথায় ঠাকুর-চাকরকে অপমান করে; চোখ রাঙায়, যেন হোটেলের মালিক নিজেই।

তাহাদের গ্রামের মেয়ে, দরিদ্ৰা কুসুম ভালটা মন্দটা খাইতে পাওয়া দূরে থাকুক, অনেক সময় পেটের ভাত জুটাইতে পারে না–তাহার জন্য রাখিয়া দেওয়া এত যত্নের মাংস শেষকালে সেই চালবাজ বার্ডসাই-খোর শালাকে দিয়া খাওয়াইতে হইবে–এ প্রস্তাব হাজারির মোটেই ভাল লাগিল না। কিন্তু সে ভালমানুষ এবং কিছু ভীতু ধরনের লোক, যাহাদের হোটেল, তাহারা যদি খাইতে চায়, হাজারি তাহা না দিয়া পারে কি করিয়া–অগত্যা হাজারিকে পদ্ম ঝিয়ের সামনে বড় জামবাটিতে ডেকচির মাংসটুকু ঢালিয়া রান্নাঘরের কুলুঙ্গিতে রেকাবি চাপা দিয়া রাখিয়া দিতে হইল।

সামান্য একটু বেলা আছে, হাজারি সেটুকু সময়ের মধ্যেই একবার নদীর ধারে ফাঁকা জায়গায় বেড়াইতে গেল।

আজ তাহার মনে আত্মপ্রত্যয় খুব বাড়িয়া গিয়াছে–দুইটি জিনিস আজ বুঝিয়াছে সে। প্রথম, ভাল রান্না সে ভুলিয়া যায় নাই, কলিকাতার বাবুরাও তাহার রান্না খাইয়া তারিফ করেন। দ্বিতীয়, পরের তাঁবে কাজ করিলে মানুষকে মায়া-দয়া বিসর্জন দিতে হয়।

আজ এমন চমৎকার রান্না মাংসটুকু সে কুসুমকে খাওয়াইতে পারিল না, খাওয়াইতে হইল তাহাদের দিয়া, যাহাদের সে দুই চক্ষু পাড়িয়া দেখিতে পারে না। কুসুম যেদিন কাঁথাখানি দিয়াছিল, সেদিন হইতে হাজারির কেমন একটা অদ্ভুত ধরনের স্নেহ পড়িয়াছে কুসুমের ওপর।

বয়সে তো সে মেয়ের সমান বটেই, কাজও করিয়াছে মেয়ের মতই। আজ যদি হাজারির হাতে পয়সা থাকিত, তবে সে বাপের স্নেহ কি করিয়া দেখাইতে হয়, দেখাইয়া দিত। অন্য কিছু দেওয়া তো দূরের কথা, নিজের হাতে অমন রান্না মাংসটুকুই সে কুসুমকে দিতে পারিল না।

ছেলেবেলাকার কথা হাজারির মনে হয়। তাহার মা গঙ্গাসাগর যাইবেন বলিয়া যোগাড়-যন্ত্র করিতেছেন–পাড়ার অনেক বৃদ্ধা ও প্রৌঢ়া বিধবাদের সঙ্গে। হাজারি তখন আট বছরের ছেলে–সেও ভীষণ বায়না ধরিল গঙ্গাসাগর সে না গিয়া ছাড়িবেই না। তাহার ঝুঁকি লইতে কেহই রাজী নয়। সকলেই বলিল–তোমার ও ছেলেকে কে দেখাশুনো করবে বাপু, অত ছোট ছেলে আর সেখানে নানা ঝক্কি–তাহলে তোমার যাওয়া হয় না।

হাজারির মা ছেলেকে ফেলিয়া গঙ্গাসাগরে যাইতে পারিলেন না বলিয়া তাঁর যাওয়াই হইল না। জীবনে আর কখনোই তাঁর সাগর দেখা হয় নাই, কিন্তু হাজারির মনে মায়ের এই স্বার্থত্যাগের ঘটনাটকু উজ্জ্বল অক্ষরে লেখা হইয়া আছে।

হাজারি ভাবিল-যাক গে, যদি কখনো নিজে হোটেল খুলতে পারি, তবে এই রাণাঘাটের বাজারে বসেই পদ্ম ঝিকে দেখাবো–তুই কোথায় আর আমি কোথায়! হাতে পয়সা থাকলে কালই না হোটেল খুলে দিতাম! কুসুমকে রোজ রোজ ভাল জিনিস খাওয়াবো আমার নিজের হোটেল হলে।

কতকগুলি বিষয় সে যে খুব ভাল শিখিয়াছে, সে বেশ বুঝিতে পারে। বাজার-করা হোটেলওয়ালার একটি অত্যন্ত দরকারী কাজ এবং শক্ত কাজ। ভাল বাজার করার উপরে হোটেলের সাফল্য অনেকখানি নির্ভর করে এবং ভাল বাজার করার মানেই হইতেছে সস্তায় ভাল জিনিস কেনা। ভাল জিনিসের বদলে সস্তা জিনিস–অথচ দেখিলে তাহাকে মোটেই খেলো বলিয়া মনে হইবে না–এমন দ্রব্য খুঁজিয়া বাহির করা। যেমন বাটা মাছ যেদিন বাজারে আক্রা–সেদিন ছ’আনা সের রেল-চালানী রাস মাছের পোনা কিনিয়া তাহাকে বাটা বলিয়া চালাইতে হইবে–হঠাৎ ধরা বড় কঠিন, কোনটা বাটার পোনা, কোনটা রাসের পোনা।

.

পরদিন হাজারি চূর্ণীর ঘাটে গিয়া অনেকক্ষণ বসিয়া রহিল। তাহার মন কাল হইতে ভাল নয়। পদ্ম ঝির নিকট ভাল ব্যবহার কখনও সে পায় নাই, পাইবার প্রত্যাশাও করে না। কিন্তু তবুও কাল সামান্য একটু রাধা মাংস লইয়া পদ্ম ঝি যে কাণ্ডটি করিল, তাহাতে সে মনোকষ্ট পাইয়াছে খুব বেশী। পরের চাকরি করিতে গেলে এমন হয়। কুসুমকে একটুখানি মাংস না দিতে পারিয়া তাহার কষ্ট হইয়াছে বেশী–অমন ভাল রান্না সে অনেক দিন করে নাই–অত আশার জিনিসটা কুসুমকে দিতে পারিলে তাহার মনটা খুশি হইত।

ভাল কাজ করিলেও চাকুরির উন্নতি তো দূরের কথা, ইহারা সুখ্যাতি পর্যন্ত করিতে জানে না। বরঞ্চ পদে পদে হেনস্থা করে। এক একবার ইচ্ছা হয় যদুবাবুর হোটেলে কাজ লইতে। কিন্তু সেখানেও যে এরকম হইবে না তাহার প্রমাণ কিছুই নাই। সেখানেও পদ্ম ঝি জুটিতে বিলম্ব হইবে না। কি করা যায়।

বেলা পড়িয়া আসিতেছে। আর বেশীক্ষণ বসা যায় না। বহু পাপ না করিলে আর কেহ হোটেলের রাঁধুনীগিরি করিতে আসে না। এখনি গিয়া ডেকচি না চড়াইলে পদ্ম ঝি এক ঝুড়ি কথা শুনাইয়া দিবে, এতক্ষণ উনুনে আঁচ দেওয়া হইয়া গিয়াছে।…কিন্তু ফিরিবার পথে সে কি মনে করিয়া কুসুমের বাড়ী গেল!

কুসুম আসন পাতিয়া দিয়া বলিল–বাবাঠাকুর আসুন, বড় সৌভাগ্য অসময়ে আপনার পায়ের ধূলো পড়লো।

হাজারি বলিল–দ্যাখ, কুসুম, তোর সঙ্গে একটা পরামর্শ করতে এলাম।

কুসুম সাগ্রহ-দৃষ্টিতে মুখের দিকে চাহিয়া বলিল–কি বাবাঠাকুর?

–আমার বয়েস ছেচল্লিশ হয়েছে বটে, কিন্তু আমার তত বয়েস দেখায় না, কি বলিস কুসুম? আমার এখনও বেশ খাটবার ক্ষমতা আছে, তুই কি বলিস?

হাজারির কথাবার্তার গতি কোনদিকে বুঝিতে না পারিয়া কুসুম কিছু বিস্ময়, কিছু কৌতুকের সুরে বলিল–তা–বাবাঠাকুর, তা তো বটেই। বয়েস আপনার এমন আর কি–কেন বাবাঠাকুর?

কুসুমের মনে একটা কথা উঁকি মারিতে লাগিল–বাবাঠাকুর আবার বিয়ে-টিয়ে করবার কথা ভাবচেন নাকি?

হাজারি বলিল–আমার বড় ইচ্ছে আছে কুসুম, একটা হোটেল করব নিজের নামে। পয়সা যদি হাতে কোনদিন জমাতে পারি, এ আমি নিশ্চয়ই করবো, তুই জানিস! পরের ঝাঁটা খেয়ে কাজ করতে আর ইচ্ছে করে না। আমি আজ দশ বছর হোটেলে কাজ করছি, বাজার কি করে করতে হয় ভাল করে শিখে ফেলেছি। চক্কত্তি মশায়ের চেয়েও আমি ভাল বাজার করতে পারি। মাখমপুরের হাট থেকে ফি হাটরা যদি তরিতরকারী কিনে আনি তবে রাণাঘাটের বাজারের চেয়ে টাকায় চার আনা ছ’আনা সস্তা পড়ে। এ ধরো কম লাভ নয় একটা হোটেলের ব্যাপারে। বাজার করবার মধ্যেই হোটেলের কাজের আদ্ধেক লাভ। আমার খুব মনে জোর আছে কুসুম, টাকা পয়সা হাতে যদি কখনো পড়ে, তবে হোটেল যা চালাবো, বাজারের সেরা হোটেলে হবে, তুই দেখে নিস।

কুসুম হাজারি ঠাকুরের এ দীর্ঘ বক্তৃতা অবাক হইয়া শুনিতেছিল–সে হাজারিকে বাবার মত দেখে বলিয়াই মেয়ের মত বাবার প্রতি সর্বপ্রকার কাল্পনিক গুণ ও জ্ঞানের আরোপ করিয়া আসিতেছে। হোটেলের ব্যাপারে সে বিশেষ কিছু বুঝুক না বুঝুক, বাবাঠাকুর যে বুদ্ধিমান, তাহা সে হাজারির বক্তৃতা হইতে ধারণা করিয়া লইল।

কিছুক্ষণ পরে কি ভাবিয়া সে বলিল–আমার এক জোড়া রুলি ছিল, এক গাছা বিক্রী ক’রে দিয়েছি আমার ছোট ছেলের অসুখের সময় আর বছর। আর এক গাছা আছে। বিক্রী করলে যাট-সত্তর টাকা হবে। আপনি নেবেন বাবাঠাকুর? ওই টাকা নিয়ে হোটেল খোলা হবে আপনার।

হাজারি হাসিয়া বলিল–দূর পাগলী! ষাট টাকায় হোটেল হবে কি রে?

–কত টাকা হলে হয়?

–অন্ততঃ দুশো টাকার কম তো নয়। তাতেও হবে না।

–আচ্ছা, হিসেব করে দেখুন না বাবাঠাকুর।

–হিসেব করে দেখব কি, হিসেব আমার মুখে মুখে। ধরো গিয়ে দুটো বড় ডেকচি, ছোট ডেকচি তিনটে। থালা-বাসন এক প্রস্থ। হাতা, খুন্তি, বেড়ি, চামচে, চায়ের বাসন। বাইরে গদির ঘরের একখানা তক্তপোশ, বিছানা, তাকিয়া। বাক্স, খেরো বাঁধানো খাতা দুখানা। বালতি, লণ্ঠন, চাকি, বেলুন–এই সব নানান নটখটি জিনিস কিনতেই তো দুশো টাকার ওপর বেরিয়ে যাবে। পাঁচদিনের বাজার খরচ হাতে করে নিয়ে নামতে হবে। চাকর ঠাকুরের দু’মাসের মাইনে হাতে রেখে দিতে হয়–যদি প্রথম দু’মাস না হলো কিছু, ঠাকুর চাকরের মাইনে আসবে কোথা থেকে? সে-সব যাক-গে, তা ছাড়া তোর টাকা নেবোই বা কেন?

কুসুম রিদ্ধ স্বরে বলিল–আমার থাকতো যদি তবে আপনি নিতেন না কেন–ব্রাহ্মণের সেবায় যদি লাগে ও-টাকা, তবে ও-টাকার ভাগ্যি বাবাঠাকুর। সে ভাগ্যি থাকলে তো হবে, আমার অত টাকা যখন নেই, তখন আর সে কথা বলচি কি করে বলুন। যা আছে, ওতে যদি কখনো-সখনো কোন দরকার পড়ে আপনার মেয়েকে জানাবেন।

হাজারি উঠিল। আর এখানে বসিয়া দেরি করিলে চলিবে না। বলিল–না রে কুসুম, এতে আর কি হবে। আমি যাই এখন।

কুসুম বলিল– একটু কিছু মুখে না দিলে মেয়ের বাড়ী থেকে কি করে উঠবেন বাবাঠাকুর, বসুন আর একটু। আমি আসছি।

কুসুম এত দ্রুত ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল, যে হাজারি ঠাকুর প্রতিবাদ করিবার অবসর পর্যন্ত পাইল না। একটু পরে কুসুম ঘরের মধ্যে একখানা আসন আনিয়া পাতিল এবং মেজের উপর জলের হাত বুলাইয়া লইয়া আবার বাহিরে গেল। কিছুক্ষণ পরে একবাটি দুধ ও একখানা রেকাবিতে পেঁপে কাটা, আমের টিকলি ও দুটি সন্দেশ তানিয়া আসনের সামনে মেজের উপর রাখিয়া বলিল–একটু জল খান, বসুন এসে, আমি খাবার জল আনি। হাজারি আসনের উপর বসিল। কুসুম ঝকঝকে করিয়া মাজা একটা কাঁচের গেলাসে জল আনিয়া রেকাবির পাশে রাখিয়া সামনে দাঁড়াইয়া রহিল।

খাইতে খাইতে হাজারির মনে পড়িল সেদিনকার সেই মাংসের কথা। মেয়ের মত স্নেহ-যত্ন করে কুসুম, তাহারই জন্য তুলিয়া রাখা মাংস কিনা খাওয়াইতে হইল চক্কত্তি মহাশয়ের গাঁজাখোর শালাকে দিয়া শুধু ওই পদ্ম ঝিয়ের জন্যে। দাসত্বের এই তো সুখ!

হাজারি বলিল–তুই আমার মেয়ের মতন কুসুম-মা।

কুসুম হাসিয়া বলিল–মেয়ের মতন কেন বাবাঠাকুর, মেয়েই তো।

–ঠিক, মেয়েই তো। মেয়ে না হোলে বাপের এত যত্ন কে করে?

–যত্ন আর কি করেছি, সে ভাগ্যি ভগবান কি আমায় দিয়েছেন। একে কি যত্ন করা বলে? কাঁথাখানা পেতে শুচ্চেন বাবাঠাকুর?

–তা শুচ্চি বই কি রে। রোজ তোর কথা মনে হয় শোবার সময়। মনে ভাবি কুসুম এখানা দিয়েছে। ছেঁড়া মাদুরের কাটি ফুটে ফুটেঁপিঠে দাগ হয়ে গিয়েছিল। পেতে শুয়ে বেঁচেছি।

–আহা, কি যে বলেন! না, সন্দেশ দুটোই খেয়ে ফেলুন, পায়ে পড়ি। ও ফেলতে পারবেন না।

–কুসুম, তোর জন্যে না রেখে খেতে পারি কিছু মা? ওটা তোর কাছে রেখে দিলাম।

কুসুম লজায় চুপ করিয়া বহিল। হাজারি আসন হইতে উঠিয়া পড়িলে বলিল–পান আনি, দাঁড়ান।

তাহার পর সামনে দরজা পর্যন্ত আগাইয়া দিতে আসিয়া বলিল–আমার ও রুলি গাছা রইল তোলা আপনার জন্যে, বাবাঠাকুর। যখন দরকার হয়, মেয়ের কাছ থেকে নেবেন কিন্তু।

সেদিন হোটেলে ফিরিয়া হাজারি দেখিল, প্রায় পনেরো সের কি আধ মণ ময়দা চাকর আর পদ্ম ঝি মিলিয়া মাখিতেছে।

ব্যাপার কি! এত লুচির ময়দা কে খাইবে?

পদ্ম ঝি কথার সঙ্গে বেশ খানিকটা ঝাঁজ মিশাইয়া বলিল–হাজারি ঠাকুর, তোমার যা যা রাঁধবার আগে সেরে নাও–তারপর এই লুচিগুলো ভেযে ফেলতে হবে। আচার্য-পাড়ায় মহাদেব ঘোষালের বাড়ীতে খাবার যাবে, তারা অর্ডার দিয়ে গেছে সাড়ে ন’টার মধ্যে চাই, বুঝলে।

হাজারি ঠাকুর অবাক হইয়া বলিল–সাড়ে ন’টার মধ্যে ওই আধ মণ ময়দা ভেজে পাঠিয়ে দেবো, আবার হোটেলের রান্না রাঁধবো! কি যে বল পদ্মদিদি, তা কি করে হবে? রতন ঠাকুকে বল না লুচি ভেঙে দিক, আমি হোটেলের রান্না বাঁধবো।

পদ্ম ঝি চোখ রাঙাইয়া ছাড়া কথা বলে না। সে গরম হইয়া ঝঙ্কার দিয়া বলিল– তোমার ইচ্ছে বা খুশিতে এখানকার কাজ চলবে না। কর্তা মশায়ের হুকুম। আমায় যা বলে গেছেন তোমায় বললাম, তিনি বড় বাজারে বেরিয়ে গেলেন–আসতে রাত হবে। এখন তোমার মর্জি–করো আর না করো।

অর্থাৎ না করিয়া উপায় নাই। কিন্তু ইহাদের এই অবিচারে হাজারির চোখে প্রায় জল আসিল। নিছক অবিচার ছাড়া ইহা অন্য কিছু নহে। রতন ঠাকুরকে দিয়া ইহারা সাধারণ রান্না অনায়াসেই করাইতে পারিত, কিন্তু পদ্ম ঝি তাহা হইলে খুশি হইবে না। সে যে কি বিষ-চক্ষে পড়িয়াছে পদ্ম ঝিয়ের! উহাকে জব্দ করিবার কোনো ফাঁকই পদ্ম ছাড়ে না।

ভীষণ আগুনের তাতের মধ্যে বসিয়া রতন ঠাকুরের সঙ্গে দৈনিক রান্না কাৰ্যেতেই প্রায় ন’টা বাজিয়া গেল। পদ্ম ঝি তাহার পর ভীষণ তাগাদা লাগাইল লুচি ভাজাতে হাত দিবার জন্য। পদ্ম নিজে খাটিতে রাজি নয়, সে গেল খরিদ্দারদের খাওয়ার তদারক করিতে। আজ আবার হাটবার, বহু ব্যাপারী খরিদ্দার। রতন ঠাকুর তাহাদের পরিবেশন করিতে লাগিল। হাজারি এক ছিলিম তামাক খাইয়া লইয়াই আবার আগুনের তাতে বসিয়া গেল লুচি ভাজিতে।

আধঘণ্টা পরে–তখন পাঁচ সের ময়দাও ভাজা হয় নাই–পদ্ম আসিয়া বলিল–ও ঠাকুর, লুচি হয়েছে? ওদের লোক এসেছে নিতে।

হাজারি বলিল–না এখনো হয়নি পদ্মদিদি। একটু ঘুরে আসতে বল।

–ঘুরে আসতে বললে চলবে কেন? সাড়ে ন’টার মধ্যে ওদের খাবার তৈরি করে রাখতে হবে বলে গেছে। তোমায় বলিনি সেকথা?

–বল্লে কি হবে পদ্মদিদি? মন্তরে ভাজা হবে আধ মণ ময়দা? ন’টার সময় তো উনুনে ব্ৰহ্মার নেচি ফেলেচি–জিগ্যেস করো মতিকে।

–সে সব আমি জানিনে। যদি ওরা অর্ডার ফেরত দেয়, বোঝাপড়া ক’রো কর্তার সঙ্গে, তোমার মাইনে থেকে আধ মন ময়দা আর দশ সের ঘি র দাম একমাসে তো উঠবে না, তিন মাসে ওঠাতে হবে।

হাজারি দেখিল, কথা কাটাকাটি করিয়া লাভ নাই। সে নীরবে লুচি ভাজিয়া যাইতে লাগিল। হাজারি ফাঁকি দেওয়া অভ্যাস করে নাই–কাজ করিতে বসিয়া শুধু ভাবে কাজ করিয়া যাওয়াই তাহার নিয়ম–কেউ দেখুক বা না-ই দেখুক। লুচি ঘিয়ে ডুবাইয়া তাড়াতাড়ি তুলিয়া ফেলিলে শীঘ্র শীঘ্র কাজ চুকিয়া যায় বটে, কিন্তু তাহাতে লুচি কাঁচা থাকিয়া যাইবে। এজন্য সে ধীরে ধীরে সময় লইয়া লুচি তুলিতে লাগিল। পদ্ম ঝি একবার বলিল– অত দেরি করে খোলা নামাচ্ছ কেন ঠাকুর? হাত চালাও না–অত লুচি ডুবিয়ে রাখলে কড়া হয়ে যাবে–

হাজারি ভাবিল, একবার সে বলে যে রান্নার কাজ পদ্ম ঝিয়ের কাছে তাহাকে শিখিতে হইবে না, লুচি ডুবাইলে কড়া কি নরম হয় সে ভালই জানে, কিন্তু তখনই সে বুঝিল, পদ্ম ঝি কেন একথা বলিতেছে।

দশ সের ঘি হইতে জলতি বাদে যাহা বাকী থাকিবে পদ্ম ঝিয়ের লাভ। সে বাড়ী লইয়া যাইবে লুকাইয়া। কর্তামশায় পদ্ম ঝিয়ের বেলায় অন্ধ। দেখিয়াও দেখেন না।

হাজাৰি ভাবিল, এই সব জুয়াচুরির জন্য হোটেলের দুর্নাম হয়। খদ্দেরে পয়সা দেবে, তারা কাঁচা লুচি খাবে কেন? দশ সের ঘিয়ের দাম তো তাদের কাছ থেকে আদায় হয়েছে, তবে তা থেকে বাঁচানোই বা কেন? তাদের জিনিসটা যাতে ভাল হয় তাই তো দেখতে হবে? পদ্ম ঝি বাড়ী নিয়ে যাবে বলে তারা দশ সের ঘিয়ের ব্যবস্থা করে নি।

পরক্ষণেই তাহার নিজের স্বপ্নে সে ভোর হইয়া গেল।

এই রেল-বাজারেই সে হোটেল খুলিবে। তাহার নিজের হোটেল। ফাঁকি কাহাকে বলে, তাহার মধ্যে থাকিবে না। খদ্দের যে জিনিসের অর্ডার দিবে, তাহার মধ্যে চুরি সে করিবে না। খদ্দের সন্তুষ্ট করিয়া ব্যবসা। নিজের হাতে রাঁধিবে, খাওয়াইয়া সকলকে সন্তুষ্ট রাখিবে। চুরি-জুয়াচুরির মধ্যে সে নাই।

লুচি ভাজা ঘিয়ের বুদ্বুদের মধ্যে হাজারি ঠাকুর যেন সেই ভবিষ্যৎ হোটেলের ছবি দেখিতে পাইতেছে। প্রত্যেক ঘিয়ের বুদ্বুদটাতে। পদ্ম ঝি সেখানে নাই, বেচু চক্কত্তির গাঁজাখোর ও মাতাল শালাও নাই। বাহিরে গদির ঘরে দিব্য ফর্সা বিছানা পাতা, খদ্দের যতক্ষণ ইচ্ছা বিশ্রাম করুক, তামাক খাইতে ইচ্ছা করে থাক, বাড়তি পয়সা আর একটিও দিতে হইবে না। দুইটা করিয়া মাছ, হপ্তায় তিন দিন মাংস বাঁধা-খদ্দেরদের। এসব না করিয়া শুধু ইষ্টিশনের প্লাটফর্মে–হি-ই-ইন্দু হোটেল, হি-ই-ই-ন্দু হোটেল, বলিয়া মতি চাকরের মত চেঁচাইয়া গলা ফাটাইলে কি খদ্দের ভিড়িবে?

পদ্ম ঝি আসিয়া বলিল–ও ঠাকুর, তোমার হোল? হাত চালিয়ে নিতে পাচ্ছ না? বাবুদের নোক যে বসে আছে।

বলিয়াই ময়দার বারকোশের দিকে চাহিয়া দেখিল, বেলা লুচি যতগুলি ছিল, হাজারি প্রায় সব খোলায় চাপাইয়া দিয়াছে–খান পনেরো কুড়ির বেশী বারকোশে নাই। মতি চাকর পদ্ম ঝিকে আসিতে দেখিয়া তাড়াতাড়ি হাত চালাইতে লাগিল।

পদ্ম ঝি বলিল–তোমার হাত চলচে না, না? এখনো দশ সের ময়দার তাল ডাঙায়, ওই রকম করে লুচি বেললে কখন কি হবে?

হাজারি বলিল–পদ্মদিদি, রাত এগারোটা বাজবে ওই লুচি বেলতে আর এক হাতে ভাজতে। তুমি বেলবার লোক দাও।

পদ্ম ঝি মুখ নাড়িয়া বলিল–আমি ভাড়া করে আনি বেলবার লোক তোমার জন্যে। ও আমার বাবু রে! ভাজতে হয় ভাজো, না হয় না ভাজো গে–ফেরত গেলে তখন কর্তামশায় তোমার সঙ্গে বোঝাপড়া করবেন এখন।

পদ্ম ঝি চলিয়া গেল।

মতি চাকর বলিল–ঠাকুর, তুমি লুচি ভেজে উঠতে পারবে কি করে? লুচি পোড়াবে না। এত ময়দার তাল আমি বেলবো কখন বলো।

হঠাৎ হাজারির মনে হইল, একজন মানুষ এখনি তাহাকে সাহায্য করিতে বসিয়া যাইত–কুসুম! কিন্তু সে গৃহস্থের মেয়ে, গৃহস্থের ঘরের বৌ–তাহাকে তো এখানে আনা যায় না। যদিও ইহা ঠিক, খবর পাঠাইয়া তাহার বিপদ জানাইলে কুসুম এখনি ছুটিয়া আসিত।

তারপর একঘণ্টা হাজারি অন্য কিছু ভাবে নাই, কিছু দেখে নাই–দেখিয়াছে শুধু লুচির কড়া, ফুটন্ত ঘি, ময়দার তাল আর বাখারির সরু আগায় ভাজিয়া তোলা রাঙ্গা রাঙ্গা লুচির গোছা–তাহা হইতে গরম ঘি ঝরিয়া পড়িতেছে। ভীষণ আগুনের তাত, মাজা পিঠ বিষম টনটন করিতেছে, ঘাম ঝরিয়া কাপড় ও গামছা ভিজিয়া গিয়াছে, এক ছিলিম তামাক খাইবারও অবকাশ নাই–শুধু কাঁচা লুচি কড়ায় ফেলা এবং ভাজিয়া তুলিয়া ঘি ঝরাইয়া পাশের ধামাতে রাখা।

রাত দশটা।

মুর্শিদাবাদের গাড়ী আসিবার সময় হইল।

মতি চাকর বলিল–আমি একবার ইষ্টিশনে যাই ঠাকুরমশায়। টেরেনের টাইম হয়েছে। খদ্দের না আনলে কাল কর্তামশায়ের কাছে মার খেতে হবে। একটা বিড়ি খেয়ে যাই।

ঠিক কথা, সে খানিকক্ষণ প্লাটফর্মে পায়চারি করিতে করিতে ‘হি-ই-ই- হোটেল’ ‘হি-ই-ই-দু হোটেল’ বলিয়া চেঁচাইবে। মুর্শিদাবাদের ট্রেন আসিতে আর মিনিট পনেরো বাকী।

হাজারি বলিল–একা আমি বেলবো আর ভাজবো। তুই কি খেপলি মতি? দেখলি তো এদের কাণ্ড। রতনঠাকুর সরে পড়েছে, পদ্মদিদিও বোধ হয় সরে পড়েছে। আমি একা কি করি?

মতি বলিল–তোমাকে পদ্মদিদি দুচোখে দেখতে পারে না। কারো কাছে বোলো না ঠাকুর–এ সব তারই কারসাজি। তোমাকে জব্দ করবার মতলবে এ কাজ করেচে। আমি যাই, নইলে আমার চাকরি থাকবে না।

মতি চলিয়া গেল। অন্ততঃ পাঁচ সের ময়দার তাল তখনও বাকী। লেচি পাকানো সে-ও প্রায় দেড় সের–হাজারি গুণিয়া দেখিল ষোল গণ্ডা লেচি। অসম্ভব! একজন মানুষের দ্বারা কি করিয়া রাত বারোটার কমে বেলা এবং ভাজা দুই কাল হইতে পারে!

মতি চলিয়া যাইবার সময় যে বিড়িটা দিয়া গিয়াছিল সেটি তখনও ফুরায় নাই–এমন সময় পদ্ম উঁকি মারিয়া বলিল–কেবল বিড়ি খাওয়া আর কেবল বিড়ি খাওয়া! ওদিকে বাবুর বাড়ী থেকে নোক দুবার ফিরে গেল–তখনি তো বলেচি হাজারি ঠাকুরকে দিয়ে এ কাজ হবে না–বলি বিড়িটা ফেলে কাজে হাত দেও না, রাত কি আর আছে?

হাজারি ঠাকুর সত্যই কিছু অপ্রতিভ হইয়া বিড়ি ফেলিয়া দিল। পদ্ম ঝিয়ের সামনে সে একথা বলিতে পারিল না যে, লুচি বেলিবার লোক নই। আবার সে লুচি ভাজিতে আরম্ভ করিয়া দিল একাই।

রাত এগারোটার বেশী দেরি নাই। হাজারির এখন মনে হইল যে, সে আর বসিতে পারিতেছে না। কেবলই এই সময়টা মনে আসিতেছিল দুটি মুখ। একটি মুখ তাহার নিজের মেয়ে টেঁপির–বছর বারো বয়স, বাড়ীতে আছে; প্রায় পাঁচ ছ’মাস তার সঙ্গে দেখা হয় নাই–আর একটি মুখ কুসুমের। ওবেলা কুসুমের সেই যত্ন করিয়া বসাইয়া জল খাওয়ানো…তার সেই হাসিমুখ …টেঁপির মুখ আর কুসুমের মুখ এক হইয়া গিয়াছে…লুচি ও ঘিয়ের বুদ্বুদে সে তখনও যেন একখানা মুখই দেখিতে পাইতেছে–টেঁপি ও কুসুম দুইয়ে মিলিয়া এক…ওরা আজ যদি দু’জনে এখানে থাকিত। ওদিকে কুসুম বসিয়া হাসিমুখে লুচি বেলিতেছে এদিকে টেঁপি…

–ঠাকুর!

স্বয়ং কর্তামশায়, বেচু চক্কত্তি। পিছনে পদ্ম ঝি। পদ্ম ঝি বলিল–ও গাঁজাখোর ঠাকুরকে দিয়ে হবে না আপনাকে তখুনি বলিনি বাবু? ও গাঁজা খেয়ে বুঁদ হয়ে আছে, দেখচো না? কাজ এগুবে কোত্থেকে!

হাজারি তটস্থ হইয়া আরও তাড়াতাড়ি লুচি খোলা হইতে তুলিতে লাগিল। বাবুদের লোক আসিয়া বসিয়া ছিল। পদ্ম ঝি যে লুচি ভাজা হইয়াছিল, তাহাদের ওজন করিয়া দিল কর্তাবাবুর সামনে। পাঁচ সের ময়দার লুচি বাকী থাকিলেও তাহারা লইল না, এত রাত্রে লইয়া গিয়া কোনো কাজ হইবে না।

বেচু চক্কত্তি হাজৰিকে বলিলেন–এই ঘি আর ময়দার দাম তোমার মাইনে থেকে কাটা যাবে। গাঁজাখোর মানুষকে দিয়ে কি কাজ হয়?

হাজারি বলিল–আপনার হোটেলে সব উল্টো বন্দোবস্ত বাবু। কেউ তো বেলে দিতে আসেনি এক মতি চাকর ছাড়া। সেও গাড়ীর টাইমে ইষ্টিশনে খদ্দের আনতে গেল, আমি কি করব বাবু।

বেচু চক্কত্তি বলিলেন–সে সব শুনচি নে ঠাকুর। ওর দাম তুমি দেবে। খদ্দের অর্ডার ফেরত দিলে সে মাল আমি নিজের ঘর থেকে লোকসান দিতে পারিনে, আর মাখা নেচি কাটা ময়দা।

হাজারি ভাবিল, বেশ, তাহাকে যদি এদের দাম দিতে হয়, লুচি ভাজিয়া সে নিজে লইবে। রাত সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত খাটিয়া ও মতি চাকরকে কিছু অংশ দিবার জন্য লোভ দেখাইয়া তাহাকে দিয়া লুচি বেলাইয়া সব ময়দা ভাজিয়া তুলিল। মতি তাহার অংশ লইয়া চলিয়া গেল। এখনও তিন চার বুড়ি লুচি মজুত।

পদ্ম ঝি উঁকি মারিয়া বলিল–লুচি ভাজচো এখনও বসে? আমাকে খানকতক দাও দিকি–

বলিয়া নিজেই একখানা গামছা পাতিয়া নিজের হাতে খান পঁচিশ-ত্রিশ গরম লুচি তুলিয়া লইল। হাজারি মুখ ফুটিয়া বারণ করিতে পারিল না। সাহসে কুলাইল না।

অনেক রাত্রে সুপ্তোত্থিতা কুসুম চোখ মুছিতে মুছিতে বাহিরের দরজা খুলিয়া সম্মুখে মস্ত এক পোঁটলা-হাতে-ঝোলানো অবস্থায় হাজারি ঠাকুরকে দেখিয়া বিস্ময়ের সুরে বলিল–কি বাবাঠাকুর, কি মনে করে এত রাত্রে?…

হাজারি বলিল–এতে লুচি আছে মা কুসুম। হোটেলে লুচি ভাজতে দিয়েছিল খদ্দেরে। বেলে দেবার লোক নেই–শেষকালে খদ্দের পাঁচ সের ময়দার লুচি নিলে না, কর্তাবাবু বলেন আমায় তার দাম দিতে হবে। বেশ আমায় দাম দিতে হয় আমিই নিয়ে নিই। তাই তোমার জন্যে বলি নিয়ে যাই, কুসুমকে তো কিছু দেওয়া হয় না কখনো। রাত বড্ড হয়ে গিয়েচে– ঘুমিয়েছিলে বুঝি? ধর তো মা বোঁচকাটা রাখো গে যাও।

কুসুম বোঁচকাটা হাজারির হাত হইতে নামাইয়া লইল। সে একটু অবাক হইয়া গিয়াছে, বাবাঠাকুর পাগল, নতুবা এত রাত্রে–(তাহার এক ঘুম হইয়া গিয়াছে–), এখন আসিয়াছে লুচির বোঁচকা লইয়া।

হাজারি বলিল, আমি যাই মা–লুচি গরম আর টাটকা, এই ভেজে তুলিচি। তুমি খানকতক খেয়ে ফেলো গিয়ে এখনি। কাল সকালে বাসি হয়ে যাবে। আর ছেলেপিলেদের দাও গিয়ে। কত আর রাত হয়েচে– সাড়ে বারোটার বেশী নয়।

দিন দুই পরে একদিন সকালে পদ্মঝি বলিল–ও ঠাকুর, শুনে রাখো, আজ কোথাও যেও না সব ছুটির পরে। আজ ও-বেলা সত্যনারায়ণের সিন্নি–খদ্দেরদের ভাত দেবার সময় বলে দিও ও-বেলা যেন থাকে–আর তোমরা খেয়ে-দেয়ে আমার সঙ্গে বেরুবে সত্যনারায়ণের বাজার করতে।

বংশী ঠাকুর হাজারির দিকে চাহিয়া হাসিল–অবশ্য পদ্মঝি চলিয়া গেলে।

ব্যাপারটা এই, হোটেলের এই যে সত্যনারায়ণের পূজা, ইহা ইহাদের একটি ব্যবসা। যাহারা মাসিক হিসাবে হোটেলে খায় তাহাদের নিকট হইতে পূজার নাম করিয়া চাঁদা বা প্রণামী আদায় হয়। আদায়ী টাকার সব অংশ ব্যয় করা হয় না বলিয়াই হাজারি বা বংশীর ধারণা। অথচ, সত্যনারায়ণের প্রসাদের লোভ দেখাইয়া দৈনিক নগদ খরিদ্দার যাহারা তাহাদেরও রাত্রে আনিবার চেষ্টা করা হয়–কারণ এমন অনেক নগদ খরিদ্দার আছে, যাহারা একবেলা হোটেলে খাইয়া যায়, দু-বেলা আসে না।

বংশী ঠাকুর পরিবেশনের সময় প্রত্যেক ঠিকা খরিদ্দারকে মোলায়েম হাসি হাসিয়া বলিতে লাগি—আজ্ঞে বাবু, ও-বেলা সত্যনারাণ হবে হোটেলে, আসবেন ও-বেলা–অবিশ্যি করে আসবেন–

বাহিরে গদির ধরে বেচু চক্কত্তিও খরিদ্দারদিগকে ঠিক অমনি বলিতে লাগিল।

বংশী ঠাকুর হাজারিকে আড়ালে বলিল–সব ফাঁকির কাজ, এক চিলতে কলার পাতার আগায় এক হাত করে গুড় গোলা আটা আর তার ওপর দুখানা বাতাসা–হয়ে গেল এর নাম তোমার সত্যনারাণের সিন্নি। চামার কোথাকার–

সন্ধ্যার সময় পূর্ণ ভটচাজ সত্যনারায়ণের পূজা করিতে আসিলেন। বাসনের ঘরে সত্য নারায়ণের পিঁড়ি পাতা হইয়াছে। হোটেলের দুই চার মিলিয়া ঘড়ি ও কাঁসর পিটাইতেছে, পদ্মঝি ঘন ঘন শাঁকে ফুঁ পাড়িতেছে–খানিকটা খরিদ্দার আকৃষ্ট করিবার চেষ্টাতেও বটে।

স্টেশনে যে চাকর ‘হি-ই-ই-ন্দু হো-টে-ল-ল’ বলিয়া চেঁচায়, তাহাকেও বলিয়া দেওয়া হইয়াছে, সে যাত্রীদের প্রত্যেককে বলিতেছে–‘আসুন বাবু, সিমি পেশাদ হচ্চেন হোটেলে, খাওয়ার বড্ড জুৎ আজগে–আসুন বাবু–’

যাহারা নগদ পয়সার খরিদ্দার, তাহারা ভাবিতেছে–অন্য হোটেলেও তো পয়সা দিয়া খাইবে যখন তখন সত্যনারায়ণের প্রসাদ ফাউ যদি পাওয়া যায়, বেচু চকত্তির হোটেলেই যাওয়া যাক না কেন। ফলে যদু বাঁড়ুয্যের হোটেলের দৈনিক নগদ খরিদ্দার যাহারা, তাহারাও অনেকে আসিয়া জুটিতেছে এই হোটেলে। এদিকে নগদ খরিদ্দারদের জন্য ব্যবস্থা এই যে, তাহাদের সিন্নি খাইতে দেওয়া হইবে ভাতের পাতে অর্থাৎ টিকিট কিনিয়া ভাত খাইতে ঢুকিলে তবে। নতুবা সিন্নিটুকু খাইয়া লইয়াই যদি খরিদ্দার পালায়?

মাসিক খরিদ্দারের জন্য অন্য প্রকার ব্যবস্থা। তাঁহারা চাঁদা দিয়াছে, বিশেষতঃ তাহাদের খাতির করাও দরকার। পূজা সাঙ্গ হইলে তাহাদের সকলকে একত্র বসাইয়া প্রাসাদ খাইতে দেওয়া হইল–বেচু চক্কত্তি নিজে প্রত্যেকের কাছে গিয়া জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন তাহারা আর একটু করিয়া প্রসাদ লইবে কি না।

যখন ওদিকে মাসিক খরিদ্দাগণকে সিন্নি বিতরণ করা হইতেছে, সে সময় হাজারি দেখিল রাস্তার উপর যতীন মজুমদার দাঁড়াইয়া হাঁ করিয়া তাহাদের হোটেলের দিকে চাহিয়া আছে। সেই যতীন…

হাজারির মনে হইল লোকটার অবস্থা আরও খারাপ হইয়া গিয়াছে, কেমন যেন অনাহার-শীর্ণ চেহারা। সে ডাকিয়া বলিল–ও যতীনবাবু, কেমন আছেন?

যতীন মজুমদার অবাক হইয়া বলিল–কে হাজারি নাকি? তুমি আবার কবে এলে এখানে।

–সে অনেক কথা বলবো এখন। আসুন না—আসুন—

যতীন ইতস্ততঃ করিয়া রান্নাঘরের পাশে বেড়ার গায়ের দরজা দিয়া হোটেলে ঢুকিয়া রান্নাঘরের দোরে আসিয়া দাঁড়াইল।

হাজারি দেখিল তাহার পায়ে জুতা নাই, গায়ে অতি মলিন উড়ানি, পরনের ধুতিখানিও তদ্রূপ। আগের চেয়ে রোগাও হইয়া গিয়াছে লোকটা। দারিদ্র্য ও অভাবের ছাপ চোখে মুখে বেশ পরিস্ফূট।

যতীন কাষ্ঠহাসি হাসিয়া বলিল–আরে, তোমাদের এখানে বুঝি সত্যনারায়ণ হচ্চে আজগে? আগে আমিও কত এসেছি খেয়েছি–

–তা খাবেন না? আপনি তো ছিলেন বারোমাসের বাঁধা খদ্দের–তা আসুন পেরসাদ খেয়ে যান–

যতীন ভদ্ৰতা করিয়া বলিল–না না, থাক থাক–তার জন্যে আর কি হয়েচে–

হাজারি একবার এদিক ওদিক চাহিয়া দেখিল কেহ কোনোদিকে নাই। সবাই খাবার ঘরে মাসিক খরিদ্দারের আদর আপ্যায়ন করিতে ব্যস্ত–সে কলার পাত পাতিয়া যতীনকে বসাইল এবং পাশে বাসনের ঘর হইতে বড় বাটির একবাটি সত্যনারায়ণের সিন্নি, একমুঠা বাতাসা ও দুটি পাকা কলা আনিয়া যতীনের পাতে দিয়া বলিল–একটু পেরসাদ খেয়ে নিন–

যতীন মজুমদার দ্বিরুক্তি না করিয়া সিন্নির সহিত কলাদুটি চটকাইয়া মাখিয়া লইয়া যেভাবে গোগ্রাসে গিলিতে লাগিল, তাহাতে হাজারিরও মনে হইল লোকটা সত্যই যথেষ্ট ক্ষুধার্ত ছিল, বোধ হয় ওবেলা আহার জোটে নাই। তিন চার গ্রাসে অতখানি সিন্নি সে নিঃশেষে উড়াইয়া দিল।

হাজারি বলিল–আর একটু নেবেন?

যতীন পূর্বের মত ভদ্রতার সুরে বলিল–না না, থাক থাক আর কেন–

হাজারি আরও এক বাটি সিন্নি আনিয়া পাতে ঢালিয়া দিতে যতীনের মুখচোখ যেন উজ্জল হইয়া উঠিল।

তাহার খাওয়া অর্ধেক হয়েছে এমন সময় পদ্মঝি রান্নাঘরের দোরে আসিয়া হাজারিকে কি একটা বলতে গেল এবং গোগ্রাসে ভোজনরত যতীন মজুমদারকে দেখিয়া হঠাৎ থমকিয়া দাঁড়াইল বলিল–ও কে?

হাজারি হাসিয়া বলিল–ও যতীনবাবু, চিনতে পাচ্ছ না পদ্মদিদি? আমাদের পুরোনো বাবু। যাচ্ছিলেন রাস্তা দিয়ে, তা আমি বল্লাম আজ পুজোর দিনটা একটু পেরসাদ পেয়ে যান বাবু–

পদ্মঝি বলিল—বেশ–বলিয়াই সে ফিরিয়া আবার গিয়া মাসিক খরিদ্দারদের খাবার ঘরে ঢুকিল।

যতীন ততক্ষণ পদ্মঝিকে কি একটা কথা বলিতে যাইতেছিল, কিন্তু সে কথা বলিবার সুযোগ ঘটিল না তাহার। সে খাওয়া শেষ করিয়া এক ঘটি জল চাহিয়া লইয়া খাইয়া চোরের মত খিড়কি দরজা দিয়া বাহির হইয়া গেল।

অল্পক্ষণ পরেই গোবরা চাকর আসিয়া বলিল–ঠাকুর, কৰ্ত্তা তোমাকে ডাকছেন—

হাজারি বুঝিয়াছিল কর্তা কি জন্য তাহাকে জরুরী তলব দিয়াছেন। সে গিয়া বুঝিল তাহার অনুমান সত্য–কারণ পদ্মঝি মুখ ভার করিয়া গদির ঘরে বেচু চক্কত্তির সামনে দাঁড়াইয়া। বেচু চক্কত্তি বললেন–হাজারি, তুমি যতনেটাকে হোটেলে ঢুকিয়ে তাকে বসিয়ে সিন্নি খাওয়াচ্ছিলে?

পদ্মঝি হাত নাড়িয়া বলিল–আর খাওয়ানো বলে খাওয়ানো! এক এক গামলা সিন্নি দিয়েছে তার পাতে–ইচ্ছে ছিল নুকিয়ে খাওয়াবে, ধর্মের ঢাক বাতাসে নড়ে, আমি গিয়ে পড়েছি সেই সময় বড় ডেক নামলো কি না তাই দেখতে–আমায় দেখে–

হাজারি বিনীত ভাবে বলিল–সত্যনারাণের পেশাদ বলেই বাবু দিয়েছিলাম–আমাদের পুরোনো খদ্দের–

বেচু চক্কত্তি দাঁত খিঁচাইয়া বলিলেন–পুরোনো খদ্দের? ভারি আমার পুরোনো খদ্দের রে? হোটেলের একটি মুঠো টাকা ফাঁকি দিয়ে চলে গিয়েছে, ভারি খদ্দের আমার! চার মাস বিনি পয়সায় খেয়ে গেল একটি আধলা উপুড়-হাত করলে না, পয়লা নম্বরের জুয়াচার কোথাকার-খদ্দের! তুমি কার হুকুমে তাকে হোটেলে ঢুকতে দিলে শুনি?

পদ্মঝি বলিল–আমি কোনো কথা বল্লেই তো পদ্ম বড় মন্দ। এই হাজারি ঠাকুর কি কম শয়তান নাকি–বাবু? আপনি জানেন না সব কথা, সব কথা আপনার কানে তুলতেও আমার ইচ্ছে করে না। নুকিয়ে নুকিয়ে হোটেলের আদ্ধেক জিনিস ওঠে ওর এয়ার বকশীদের বাড়ী। যতনে ঠাকুর ওর এয়ার, বুঝলেন না আপনি? বহাল করেন লোক, তখন আমি কেউ নই– কিন্তু হাতে হাতে ধরে দেবার বেলা এই জনা না হোলেও দেখি চলে না–এই দেখুন আবার চুরি-চামারি শুরু যদি না হয় হোটেলে, তবে আমার নাম–

বেচু চক্কত্তি বলিলেন–এটা তোমার নিজের হোটেল নয় যে তুমি হাজারি ঠাকুর এখানে যা খুশি করবে। নিজের মত এখানে খাটালে চলবে না জেনো। তোমার আট আনা জরিমানা হোল।

হাজারি বলিল–বেশ বাবু, আপনার বিচারে যদি তাই হয়, করুন জরিমানা। তবে যতীন বাবু আমার এয়ারও নয় বা সে সব কিছুই নয়। এই হোটেলেই ওঁর সঙ্গে আমার আলাপ–ওঁকে দেখিনিও কতদিন। পদ্মদিদি অনেক অনেয্য কথা লাগায় আপনার কাছে–আমি আসছে মাস থেকে আর এখানে চাকরি করবো না।

পদ্মঝি এ কথায় অনর্থ বাধাইল। হাত পা নাড়িয়া চীৎকার করিয়া বলিল–লাগায়? লাগায় তোমার নামে? তুমি যে বড় লাগাবার যুগ্যি লোক। তাই পদ্ম লাগিয়ে লাগিয়ে বেড়াচ্ছে তোমার নামে। যত বড় মুখ নয় তত বড় কথা। তোমার মত লোককে পদ্ম গেরায্যির মধ্যে আনে না তা তুমি ভাল করে বুঝো ঠাকুর। যাও না, তুমি আজই চলে যাও। সামনের মাসে কেন, মাইনেপত্তর চুকিয়ে আজই বিদেয় হও না–তোমার মত ঠাকুর রেল-বাজারে গণ্ডায় গণ্ডায় মিলবে–

বেচু চক্কত্তি বলিলেন–চুপ চুপ পদ্ম, চুপ করো। খদ্দেরপত্র আসচে যাচ্চে, ওকথা এখন থাক। পরে হবে–আচ্ছা তুমি যাও এখন হাজারি ঠাকুর–

অনেক রাতে হোটেলের কাজ মিটিল।

শুইবার সময় হাজারি বংশীকে বলিল–দেখলে তো কি রকম অপমানটা আমার করলে পলদিদি? তুমিও ছাড়, চল দুজনে বেরিয়ে যাই। দ্যাখো একটা কথা বংশী, এই হোটেলের ওপর কেমন একটা মায়া পড়ে গিয়েছিল, মুখে বলি বটে যাই যাই–কিন্তু যেতে মন সরে না। কতকাল ধরে তুমি আর আমি এখানে আছি ভেবে দ্যাখো তো? এ যেন আপনার ঘর বাড়ী হয়ে গিয়েছে–তাই না? কিন্তু এরা–বিশেষ করে পদ্মদিদি এখানে টিকতে দিলে না–এবার সত্যিই যাবো।

বংশী বলিল–ষতীনকে তুমি ডেকে দিলে না ও আপনি এসেছিল?

–আমি ডেকেছিলাম। ওর অবস্থা খারাপ হয়ে গিয়েচে, আজকাল খেতেই পায় না। তাই ডাকলাম। বলি পুরোনো খদ্দের তো, কত লোক খেয়ে যাচ্চে, ও একটু সিন্নি খেয়ে যাক। এই তো আমার অপরাধ।

.

পরের মাসের শুভ পয়লা তারিখে রেলবাজারে গোপাল ঘোষের তামাকের দোকানের পাশেই নূতন হোটেলটা খুলিল! টিনের সাইনবোর্ড লেখা আছে—

আদর্শ হিন্দু-হোটেল হাজারি ঠাকুর নিজের হাতে রান্না করিয়া থাকেন। ভাত, ডাল, মাছ, মাংস সব রকম প্রস্তুত থাকে। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ও সস্তা। আসুন! দেখুন!! পরীক্ষা করুন!!!

বেচু চক্কত্তির হোটেলের অনুকরণে সামনেই গদির ঘর। সেখানে বংশী ঠাকুরের ভাগ্নে সেই ছেলেটি কাঠের বাক্সের উপর খাতা ফেলিয়া খরিদ্দারগণের আনাগোনার হিসাব রাখিতেছে। ভিতরে রান্না করিতেছে বংশী ও হাজারি–বেচু চক্কত্তির হোটেলের মতই তিনটি শ্রেণী করা হইয়াছে, সেই রকম টিকিট কিনিয়া ঢুকিতে হয়।

তা নিতান্ত মন্দ নয়। খুলিবার দিন দুপুরের খরিদ্দার হইল ভালই! বংশী খাইবার ঘরে ভাত দিতে আসিয়া ফিরিয়া গিয়া হাজারিকে বলিল–থাড কেলাস ত্রিশ খানা। প্রথম দিনের পক্কে যথেষ্ট হয়েছে। ওবেলা মাংস লাগিয়ে দাও।

বহুদিনের বাসনা ঠাকুর রাধাবল্লভ পূর্ণ করিয়াছেন। হাজারি এখন হোটেলের মালিক। বেচু চক্কত্তির সমান দরের লোক সে আজ। অত্যন্ত ইচ্ছা হইল, যত জানাশোনা পরিচিত লোক যে যেখানে আছে–সকলকেই কথাটা বলিয়া বেড়ায়। মনের আনন্দ চাপিতে না পারিয়া বৈকালে কুসুমের বাড়ী গিয়া হাজির হইল। কুসুম বলিল–কেমন চললো হোটেল জ্যাঠামশায়?

–বেশ খদ্দের পাচ্চি। আমার বড্ড ইচ্ছে তুমি একবার এসে দেখে যাও–তুমি তো অংশীদার–

–যাবো এখন। কাল সকালে যাবে। আপনার মনিব কি বল্লে?

–রেগে কাই। ও মাসের মাইনে দেয় নি–না দিকগে, সত্যিই বলচি কুসুম মা, আমার বয়েস কে বলে আটচল্লিশ হয়েচে? আমার যেন মনে হচ্চে আমার বয়েস পনের বছর কমে গিয়েচে। হাতপায়ে বল এসেচে কত! তুমি আর আমার অতসী মা–তোমরা আর জন্মে আমার কি ছিলে জানিনে—তোমাদের–

কুসুম বাধা দিয়া বলিল–আবার ওই সব কথা বলছেন জ্যাঠামশায়? আমার টাকা দিইচি সুদ পাবো বলে। এ তো ব্যবসায় টাকা ফেলা–টাকা কি তোরঙ্গের মধ্যে থেকে আমার স্বগগে পিদিম দিতো? বলি নি আমি আপনাকে? তবে হ্যাঁ, আমাদের বাবুর মেয়ের কথা যা বল্লেন, সে দিয়েছে বটে কোন খাঁই না করে। তার কথা, হাজার বার বলতে পারেন। তার বিয়ের কি হোল?

–সামনের সোমবার বিয়ে। চিঠি পেয়েছি–যাচ্ছি ওদিন সকালে।

–আমার কাকার সঙ্গে যদি দেখা হয় তবে এসব টাকাকড়ির কথা যেন বলবেন না সেখানে।

–তোমাকে শিখিয়ে দিতে হবে না মা, যতবার দেখা হয়েচে তোমার নামটি পর্যন্ত কখনো সেখানে ঘূণাক্ষরে করি নি। আমারও বাড়ী এঁড়োশোলা, আমায় তোমার কিছু শেখাতে হবে না।

কথামত পরদিন সকালে কুসুম হোটেল দেখতে গেল। সে দুধ দই লইয়া অনেক বেলা পৰ্য্যন্ত পাড়ায় পাড়ায় বেড়ায়– তাহার পক্ষে ইহা আশ্চর্যের কথা কিছুই নহে।

হাজারি তাহাকে রান্নাঘরে যত্ন করিয়া বসাইতে গেল–সে কিন্তু দোরের কাছে দাঁড়াইয়া রহিল, বলিল–আমি গুরুঠাকরুন কিছু আসি নি যে আসন পেতে যত্ন করে বসাতে হবে।

হাজারি বলিল–তোমারও তো হোটেল কুসুম-মা–তুমি এর অংশীদারও বটে, মহাজনও বটে। নিজের জিনিস ভাল করে দেখে শোনো। কি হচ্ছে না হচ্চে তদারক করো–এতে লজ্জা কি? বংশী, চিনে রাখো এ একজন অংশীদার।

এ কথায় কুসুম খুব খুশি হইল–মুখে তাহার আহ্লাদের চিহ্ন ফুটিয়া উঠিল। এমন একটা হোটেলের সে অংশীদার ও মহাজন–এ একটা নতুন জিনিস তাহার জীবনে। এ ভাবে ব্যাপারটা বোধ হয় ভাবিয়া দেখে নাই। হাজারি বলিল–আজ মাছ রান্না হয়েছে বেশ পাকা রুই। তুমি একটু বোসো মা, মুড়োটা নিয়ে যাও।

–না না জ্যাঠামশায়।–ওসব আপনাকে বারণ করে দিইচি না! সকলের মুখ বঞ্চিত করে আমি মাছের মুড়ো খাবো–বেশ মজার কথা!

–আমি তোমার বুড়ো বাবা, তোমাকে খাইয়ে আমার যদি তৃপ্তি হয়, কেন খাবে না বুঝিয়ে দাও।

হোটেলের চাকর হাঁকিল–থাড কেলাস তিন থালা–-

হাজারি বলল–খদ্দের আসছে বোসো মা একটু। আমি আসছি, বংশী ভাত বেড়ে ফেলো।

আসিবার সময় কুসুম সলজ্জ সঙ্কোচের সহিত হাজারির দেওয়া এক কাঁসি মাছ তরকারি লইয়া আসিল।

.

এক বছর কাটিয়া গিয়াছে।

হাজারি এঁডোশোলা হইতে গরুর গাড়ীতে রাণাঘাট ফিরিতেছে, সঙ্গে টেঁপির মা, টেঁপি ও ছেলেমেয়ে। তাহার হোটেলের কাজ আজকাল খুব বাড়িয়া গিয়াছে। রাণাঘাটে বাসা না করিলে আর চলে না।

টেঁপির মা বলিল–আর কতটা আছে হ্যাঁ গা?

–ওই তো সেগুন বাগান দেখা দিয়েছে–এইবার পৌঁছে যাবো

টেঁপি বলিল–বাবা, সেখানে নাইবো কোথায়? পুকুর আছে না গাঙ?

–গাঙ আছে, বাসায় টিউব কল আছে।

টেঁপির মা বলিল–তাহোলে জল টানতে হবে না পুকুর থেকে। বেঁচে যাই–

ইহারা কখনো শহরে আসে নাই–টেঁপির মার বাপের বাড়ী এঁডোশোলার দু ক্রোশ উত্তরে মণিরামপুর গ্রামে। জন্ম সেখানে, বিবাহ এঁড়োশোলায়, শহর দেখিবার একবার সুযোগ হইয়াছিল অনেকদিন আগে, অগ্রহায়ণ মাসে গ্রামের য়েদের সঙ্গে একবার নবদ্বীপে রাস দেখিতে গিয়াছিল।

হোটেলের কাছেই একখানা একতলা বাড়ী পূৰ্ব্ব হইতে ঠিক করা ছিল। টেঁপির মা বাড়ী দেখিয়া খুব খুশি হইল। চিরকাল খড়ের ঘরে বাস করিয়া অভ্যাস, কোঠাঘরে বাস এই তাহার প্রথম।

–কখানা ঘর গা? রান্নাঘর কোন্ দিকে? কই তোমার সেই টিউকল দেখি? জল বেশ ও তো? ওরে টেঁপি, গাড়ীর কাপড়গুলো আলাদা করে রেখে দে–একপাশে। ও-সব নিয়ে ছিষ্টি ছোঁয়ানেপা করো না যেন, বস্তার মধ্যে থেকে একটা ঘটি আগে বের করে দাও না গো, এক ঘটি জল আগে তুলে নিয়ে আসি।

একটু পরে কুসুম আসিয়া ঢুকিয়া বলিল–ও জেঠিমা, এলেন সব? বাসা পছন্দ হয়েছে তো?

টেঁপির মা কুসুমকে চেনে। গ্রামে তাহাকে কুমারী অবস্থা হইতেই দেখিয়াছে। বলিল– এসো মা কুসুম, এসো এসো! ভাল আছ তো? এসো এসো কল্যেণ হোক।

হোটেলের চাকর রাখাল এই সময় আসিল। তাহার পিছনে মুটের মাথায় এক বস্তা পাথুরে কয়লা। হাজারিকে বলিল–কয়লা কোনদিকে নামাবো বাবু?

হাজারি বলিল–কয়লা আনলি কেন রে? তোকে যে বলে দিলাম কাঠ আনতে? এর কয়লার আঁচ দিতে জানে না।

কুসুম বলিল–কয়লার উনুন আছে? আমি আঁচ দিয়ে দিচ্ছি। আর শিখে নিতে তো হবে জেঠিমাকে। কয়লা সস্তা পড়বে কাঠের চেয়ে এ শহর-বাজার জায়গায়। আমি একদিনে শিখিয়ে দেবো জেঠিমাকে।

রাখাল কয়লা নামাইয়া বলিল–বাবু, আর কি করতে হবে এখন?

হাজারি বলিল–তুই এখন যাসনে–জলটলগুলো তুলে দিয়ে জিনিসপত্তর গুছিয়ে রেখে তবে যাবি। হোটেলের বাজার এসেছে?

–এসেছে বাবু।

–তা থেকে এবেলার মত মাছ-তরকারি চার-পাঁচ জনের মত নিয়ে আয়। ওবেলা আলাদা বাজার করলেই হবে। আগে জল তুলে দে দিকি।

টেঁপির মা বলিল–ও কে গো?

–ও আমাদের হোটেলের চাকর। বাসার কাজও ও করবে, বলে দিইছি।

টেঁপির মা অবাক হইল। তাহাদের নিজেদের চাকর, সে আবার হাজারিকে ‘বাবু’ সম্বোধন করিতেছে–এ সব ব্যাপার এতই অভিনব যে বিশ্বাস করা শক্ত। গ্রামের মধ্যে তাহারা ছিল অতি গরীব গৃহস্থ, বিবাহ হইয়া পৰ্য্যন্ত বাসন-মাজা, জল-তোলা, ক্ষার-কাঁচা, এমন কি ধান ভানা পর্যন্ত সৰ্বরকম গৃহকৰ্ম্ম সে একা করিয়া আসিয়াছে। মাস চার পাঁচ হইল দুটি সচ্ছল অন্নের মুখ সে দেখিয়া আসিতেছে, নতুবা আগে আগে পেট ভরিয়া দুটি ভাত খাইতে পাওয়াও সব সময় ঘটিত না।

আর আজ এ কি ঐশ্বর্যের দ্বার হঠাৎ তাহার সম্মুখে উন্মুক্ত হইয়া গেল। কোঠাবাড়ী, চাকর, কলের জল–এ সব স্বপ্ন না সত্য?

রাখাল আসিয়া বলিল–দেখুন তো মা এই মাছ-তরকারিতে হবে না আর কিছু আনবো?

বড় বড় পোনা মাছের দাগা দশ-বারো খানা। টেঁপির মা খুশির সহিত বলিল–না বাবা আর আনতে হবে না। রাখো ওখানে।

–ওগুলো কুটে দিই মা?

মাছ কুটিয়াও দিতে চায় যে! এ সৌভাগ্যও তাহার অদৃষ্টে ছিল।

হাজারি বলিল–আগে জল তুলে দে তারপর কুটবি এখন। আগে সব নেয়ে নিই।

কুসুম কয়লার উনুনে আঁচ দিয়া আসিয়া বলিল–জেঠিমা আপনিও নেয়ে নিন। ততক্ষণ আঁচ ধরে যাক। বেলা প্রায় এগারোটা বাজে। রান্না চড়িয়ে দেবার আর দেরি করবার দরকার কি? আমি এবার যাই।

টেঁপির মা বলিল–তুমি এখানে এবেলা খাবে কুসুম।

কুসুম ব্যস্তভাবে বলিল–না না, আপনারা এলেন তেতেপুড়ে এই দুপুরের সময়। এখন কোনোরকমে দুটো ঝোলভাত রেঁধে আপনারা এবেলা খেয়ে নিন–তার মধ্যে আবার আমার খাওয়ার হাংনামায়–

–কিছু হাংনামা হবে না মা। তুমি না খেয়ে যেতে পারবে না। ভাল বেগুন এনেছি গাঁ থেকে, তোমাদের শহরে তেমন বেগুন মিলবে না–বেগুন পোড়াবো এখন। বাপের বাড়ীর বেগুন খেয়ে যাও আজ। কাল শুটকে যাবে।

হাজারি স্নান সারিয়া বলিল–আমি একবার হোটেলে চল্লাম। তোমরা রান্না চাপাও। আমি দেখে আসি।

আধঘণ্টা পরে হাজারি ফিরিয়া দেখিল টেঁপি ও টেঁপির মা দুজনে উনুনে পরিত্রাহি ফুঁ পাড়িতেছে। আঁচ নামিয়া গিয়াছে, তনও মাছের ঝোল বাকি।

টেঁপির মা বিপন্নমুখে বলিল–ওগো, এ আবার কি হোল, উনুন যে নিবে আসছে। কি করি এখন?

কুসুম বাড়ীতে স্নান করিতে গিয়াছে, রাখাল গিয়াছে হোটেলে, কারণ এই সময়টা সেখানে খরিদ্দারের ভিড় অত্যন্ত। এবেলা অন্ততঃ একশত জন খায়। বেচু চক্কত্তি ও যদু বাঁড়ুয্যের হোটেল কানা হইয়া পড়িয়াছে। হাজারি নিজের হাতে রান্না করে, তাহার রান্নার গুণে–রেলবাজারের যত খরিদ্দার সব ঝুঁকিয়াছে তাহার হোটেলে। তিনজন ঠাকুর ও চারিজন চাকরে হিমসিম খাইয়া যায়। ইহারা কেহই কয়লার উনুনে আঁচ দেওয়া দূরের কথা, কয়লার উনুনই দেখে নাই। আঁচ কমিয়া যাইতে বিষম বিপদে পড়িয়া গিয়াছে। ইহাদের অবস্থা দেখিয়া হাজারির হাসি পাইল। বলিল-শেখো, পাড়াগেঁয়ে ভূত হয়ে কতকাল থাকবে? সরে দিকি? ওর ওপর আর চাট্টি কয়লা দিতে হয়–এই দেখিয়ে দিই।

টেঁপির মা বলিল–আর তুমি বড্ড শহুরে মানুষ! তবুও যদি এঁডোশোলা বাড়ী না হোত!

–আমি? আমি আজ সাত বছর এই রাণাঘাটের রেলবাজারে আছি। আমাকে পাড়াগেঁয়ে বলবে কে? ওকথা তুলে রাখোগে ছিকেয়।

টেঁপি বলিল–বাবা এখানে টকি আছে? তুমি দেখেছ?

হাজারি বিশ হাত জলে পড়িয়া গেল। টকি বাইস্কোপ এখানে আছে বটে কিন্তু বাইস্কোপ দেখার শখ কখনও তাহার হয় নাই। কিন্তু টেঁপি আধুনিকা, এঁড়োশোলায় থাকিলে কি হয়, বাংলার কোন্ পাড়াগাঁয়ে আধুনিকতার ঢেউ যায় নাই?…বিশেষত অতসী তার বন্ধু…অতসীর কাছে অনেক জিনিস সে শুনিয়াছে বা শিখিয়াছে যাহা তাহার বাবা (মা তো নয়ই) জানেও না।

টেঁপির মা বলিল–টকি কি গা?

হাজারি আধুনিক হইবার চেষ্টায় গম্ভীর ভাবে বলিল–ছবিতে কথা কয়, এই। দেখেছি অনেকবার। দেখবো না আর কেন? হুঁ–

বলিয়া তাচ্ছিল্যের ভাবে সবটা উড়াইয়া দিবার চেষ্টা করিতে গেল–কিন্তু টেঁপি পরক্ষণেই জিজ্ঞাসা করিল–কি পালা দেখেছিলে বাবা?

–পালা! তা কি আর মনে আছে। লক্ষণের শক্তিশেল বোধহয়, হাঁ–লক্ষণের শক্তিশেল।

মনের মধ্যে বহু কষ্টে হাতড়াইয়া ছেলেবেলায় দেখা এক যাত্রার পালার নামটা হাজারি করিয়া দিল। টেঁপি বলিল–লপের শক্তিশেল আবার কি পালার নাম? ওর নাম তো টকি, পালার থাকে না? তাদের নাম আমি শুনেছি অতসীদির কাছে, সে তো

–হাঁ হাঁ–তুই আর অতসীদি ভারি সব জানিস আর কি! যা–সর দিকি–ওই কয়লার ঝুড়িটা–

–ও মামাবাবু, খাওয়া-দাওয়া হোল–বলিয়া বংশীর ভাগ্নে সেই সুন্দর ছেলেটি বাড়ীর মধ্যে ঢুকিতেই টেঁপির মা, পাড়াগেঁয়ে বউ, তাড়াতাড়ি মাথায় ঘোমটা টানিয়া দিতে গেল। টেঁপি কিন্তু নবাগত লোকটির দিকে কৌতূহলের দৃষ্টিতে চাহিয়া রহিল।

হাজারি বলিল–এসো বাবা এসো–ঘোমটা দিচ্ছ কাকে দেখে? ও হোল বংশীর ভাগ্নে। আমার হোটেলে খাতাপত্র রাখে। ছেলেমানুষ–ওকে দেখে আবার ঘোমটা–

বংশীর ভাগিনেয় আসিয়া টেঁপির মার পায়ের ধূলা লইয়া প্রণাম করিল।

হাজারি মেয়েকে বলিল–তোর নরেন দাদাকে প্রণাম কর টেঁপি। এইটি আমার মেয়ে, বাবা নরেন। ও বেশ লেখাপড়া জানে–সেলাইয়ের কাজটাজ ভাল শিখেছে আমাদের গাঁয়ের বাবুর মেয়ের কাছে।

টেঁপির হঠাৎ কেমন লজ্জা করিতে লাগিল। ছেলেটি দেখিতে যেমন, এমন চেহারার ছেলে সে কখনো দেখে নাই–কেবল ইহার সঙ্গে খানিকটা তুলনা করা যায় অতসীদি’র বরের। অনেকটা মুখের আদল যেন সেই রকম।

বংশীর ভাগ্নেও তাহার স্বচ্ছন্দ হৃদ্যতার ভাব হারাইয়া ফেলিয়াছে। চোখ তুলিয়া ভাল করিয়া চাওয়া যেন একটু কষ্টকর হইয়া উঠিতেছে। টেঁপির দিকে তো তেমন চাহিতেই পারিল না।

হাজারি বলিল–মুর্শিদাবাদের গাড়ী থেকে ক’জন নামলো আজ?

–নেমেছিল জনদশেক, তার মধ্যে তিনজনকে বেচু চক্কত্তির চাকর একরকম হাত ধরে জোর করেই টেনে নিয়ে গেল। বাকি সাতজন আমরা পেয়েছি–আর বনগাঁর ট্রেন থেকে এসেছিল পাঁচজন।

–ইস্টিশানে গিয়েছিল কে।

–ব্রজ ছিল, রাখালও ছিল বনগাঁর গাড়ীর সময়। ব্ৰজ বল্লে বেচু চক্কত্তির চাকরের সঙ্গে খদ্দের নিয়ে তার হাতাহাতি হয়ে যেতো আজ।

–না না, দরকার নেই বাবা ওসব। হাজার হোক, আমার পুরোনো মনিব। ওদের খেয়েই এতকাল মানুষ–হোটেলের কাজ শিখেছিও ওদের কাছে। শুধু রাঁধতে জানলে তো হোটেল চালানো যায় না বাবা, এ একটা ব্যবসা। কি করে হাট-বাজার করতে হয়, কি করে খদ্দের তুষ্ট করতে হয়, কি করে হিসেবপত্র রাখতে হয়–এও তো জানতে হবে। আমি দু’বছর ওদের ওখানে থেকে কেবল দেখতাম ওরা কি করে চালাচ্ছে। দেখে দেখে শেখা। এখন সব পারি।

বংশীর ভাগ্নে বলি–আচ্ছা মামীমা, খাওয়া দাওয়া করুন, আমি আসবো এখন ওবেলা।

হাজারি বালল–তুমি কাল দুপুরে হোটেলে খেও না–বাসাতে খাবে এখানে। বুঝলে?

বংশীর ভাগ্নে চলিয়া গেলে টেঁপির অনুপস্থিতিতে হাজারি বলিল–কেমন ছেলেটি দেখলে?

–বেশ ভাল। চমৎকার দেখতে।

–ওর সঙ্গে টেঁপির বেশ মানায় না?

–চমৎকার মানায়। তা কি আর হবে। আমাদের অদৃষ্টে কি অমন ছেলে জুটবে?

–জুটবে না কেন, জুটে আছে। ওকে আনিয়ে রেখেচি হোটেলে তবে কি জন্যে? তোমাদের রাণাঘাটের বাসায় আনলাম তবে কি জন্যে?…টেঁপিকে যেন এখন কিছু–বোঝ তো? কাল ওকে একটু যত্ন-আত্যি করো। আমার অনেক দিনের ইচ্ছে ওর সঙ্গে টেঁপির–তা এখন অনেকটা ভরসা পাচ্ছি। ওর বাপের অবস্থা বেশ ভাল, ছেলেটাও ম্যাট্রিক পাস। বিয়ে দিয়ে হোটেলেই বসিয়ে দেবো–থাক আমার অংশীদার হয়ে। কাজ শিখে নিক–টেঁপিও কাছেই রইল আমাদের–বুঝলে না, অনেক মতলব আছে।

টেঁপির মা বোকাসোকা মানুষ–অবাক হইয়া স্বামীর মুখের দিকে চাহিয়া তাহার কথা শুনিতে লাগিল।

.

সন্ধ্যার পরে খবর আসিল স্টেশনে বেচু চক্কত্তির হোটেলের লোকের সঙ্গে হাজারির চাকরে খরিদ্দার লইয়া মারামারি হইয়া গিয়াছে। হাজারির চাকর নাথনি বলিল–বাবু, ওদের হোটেলের চাকর খদ্দেরের হাত ধরে টানাটানি করে– আমাদের খদ্দের, আমাদের হোটেলে আসচে–তার হাত ধরে টানবে আর আমাদের হোটেলের নিন্দে করবে। তাই আমার সঙ্গে হাতাহাতি হয়ে গিয়েছে।

–খদ্দের কোথায় গেল?

–খদ্দের সেচে আমাদের এখানে। ওদের হোটেলের লোকের আমাদের ওপর আকচ আছে, আমরাই সব খদ্দের পাই, ওরা পায় না–এই নিয়েই ঝগড়া বাবু। ওদের হোটেলের হয়ে এল বাবু। একটা গাড়ীতেও খদ্দের পায় না।

রাত আটটার সময়ে হাজারি সবে মাছের ঝোল উনুনে চাপাইয়াছে, এমন সময় বংশী বলিল–হাজারি-দা, জবর খবর আছে। তোমার আগের কর্তা তোমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন কেন দেখে এসো গে। বোধ হয় মারামারি নিয়ে–

–ঝোলটা তুমি দেখো। আমি এসে মাংস চাপাবো–দেখি কি খবর।

অনেকদিন পরে হাজারি বেচু চক্কত্তির হোটেলের সেই গদির ঘরটিতে গিয়া দাঁড়াইল। সেই পুরোনো দিনের মনের ভাব সেই মুহূর্তেই তাহাকে পাইয়া বসিল যেন ঢুকিবার সঙ্গে সঙ্গেই। যেন সে রাঁধুনী বামুন, বেচু চক্কত্তি আজও মনিব।

বেচু চক্কত্তি তাহাকে দেখিয়া খাতির করিবার সুরে বলিলেন–আরে এস এস হাজারি এস–এখানে বসো।

বলিয়া গদির এক পাশে হাত দিয়া ঝাড়িয়া দিলেন, যদিও ঝড়িবার কোন আবশ্যক ছিল না। হাজারি দাঁড়াইয়াই রহিল। বলিল–না বাবু, আমি বসবো না। আমায় ডেকেচেন কেন?

–এসো, বসোই এসে আগে। বলচি।

হাজারি জিভ কাটিয়া বলিল–না বাবু, আপনি আমার মনিব ছিলেন এতদিন। আপনার সামনে কি বসতে পারি? বলুন, কি বলবেন–আমি ঠিক আছি।

হাজারির চোখ আপনা-আপনি খাওয়ার ঘরের দিকে গেল। হোটেলের অবস্থা সত্যই খুব খারাপ হইয়া গিয়াছে। রাত ন’টা বাজে, আগে আগে এসময় খরিদ্দারের ভিড়ে ঘরে জায়গা থাকিত না। আর এখন লোক কই? হোটেলের জলুসও আগের চেয়ে অনেক কমিয়া গিয়াছে।

বেচু চক্কত্তি বলিলেন–না, বোসো হাজারি। চা খাও, ওরে কাঙালী, চা নিয়ে আয় আমাদের।

হাজারি তবুও বসিতে চাহিল না। চাকর চা দিয়া গেল, হাজারি আড়ালে গিয়া চা খাইয়া আসিল।

বেচু চক্কত্তি দেখিয়া শুনিয়া খুব খুশি হইলেন। হাজারির মাথা ঘুরিয়া যায় নাই হঠাৎ অবস্থাপন্ন হইয়া। কারণ অবস্থাপন্ন যে হাজারি হইয়া উঠিয়াছে, তাহা তিনি এতদিন হোটেল চালানোর অভিজ্ঞতা হইতে বেশ বুঝিতে পারেন।

হাজারি বলিল–বাবু, আমায় কিছু বলচিলেন?

–হ্যাঁ-বলচিলাম কি জানো, এক জায়গায় ব্যবসা যখন আমাদের তখন তোমার সঙ্গে আমার কোন শত্রুতা নেই তো–তোমার চাকর আজ আমার চাকরকে মেরেছে ইস্টিশনে। এ কেমন কথা?

এই সময় পদ্মঝি দোরের কাছে আসিয়া দাঁড়াইল। হোটেলের চাকরও আসিল।

হাজারি বলিল–আমি তো শুনলাম বাবু আপনার চাকরটা আগে আমার চাকরকে মারে। নাথনি খদ্দের নিয়ে আসছিল এমন সময়–

পদ্মঝি বলিল–হ্যাঁ তাই বৈকি! তোমাদের নাথনি আমাদের খদ্দের ভাগাবার চেষ্টা করে–আমাদের হোটেলে আসছিল খদ্দের, তোমাদের হোটেলে যেতে চায় নি–

একথা বিশ্বাস করা যেন বেচু চক্কত্তির পক্ষেও শক্ত হইয়া উঠিল। তিনি বলিলেন–যাক, ও নিয়ে আর ঝগড়া করে কি হবে হাজারির সঙ্গে। হাজারি তো সেখানে ছিল না, দেখেও নি, তবে তোমায় বল্লাম হাজারি, যাতে আর এমন না হয়–

হাজারি বলিল–বাবু, বেশ আমি রাজী আছি। আপনার হোটেলের সঙ্গে আমার কোনো বিবাদ করলে চলবে না। আপনি আমার পুরোনো মনিব। আসুন, আমরা গাড়ী ভাগ করে নিই। আপনি যে গাড়ীর সময় ইস্টিশানে চাকর পাঠাবেন, আমার হোটেলের চাকর সে সময় যাবে না।

বেচু চক্কত্তি বিস্মিত হইলেন। ব্যবসা জিনিসটাই রেষারেষির উপর, আড়াআড়ির উপর চলে–তিনি বেশ ভালই জানেন। মাথার চুল পাকাইয়া ফেলিলেন তিনি এই ব্যবসা করিয়া। এস্থলে হাজারির প্রস্তাব যে কতদূর উদার, তাহা বুঝিতে বেচুর বিলম্ব হইল না। তিনি আমতা আমতা করিয়া বলিলেন–না তা কেন, ইস্টিশান তো আমার একলার নয়–

–না বাবু, এখন থেকে তাই রইল। মুর্শিদাবাদ আর বনগাঁর গাড়ীর মধ্যে আপনি কি নেবেন বলুন মুর্শিদাবাদ চান, না বনগাঁ চান? আমি সে সময় চাকর পাঠাবো না ইস্টিশানে।

পদ্মঝি দোর হইতে সরিয়া গেল।

বেচু চক্কত্তি বলিলেন–তা তুমি যেমন বলো। মুর্শিদাবাদখানাই তবে রাখো আমার। তা আর একটু চা খেয়ে যাবে না?–আচ্ছা, এসো তবে।

হাজারি মনিবকে প্রণাম করিয়া চলিয়া আসিল।

পদ্মঝি পুনরায় দোরের কাছে আসিয়া জিজ্ঞাসা করিল—হাঁ বাবু, কি বলে গেল?

–গাড়ী ভাগ করে নিয়ে গেল। মুর্শিদাবাদখানা আমি রেখেছি। যা কিছু লোক আসে, মুর্শিদাবাদ থেকেই আসে–বনগাঁর গাড়ীতে কটা লোক আসে? লোকটা বোকা, লোক মন্দ নয়। দুষ্টু নয়।

–আমি আজ সাত বছর দেখে আসছি আমি জানিনে? গাঁজা খেয়ে বুঁদ হয়ে থাকে, হোটেলের ছাই দেখাশুনো করে। রেঁধেই মরে, মজা লুটচে বংশী আর বংশীর ভাগ্নে। ক্যাশ তার হাতে। আমি সব খবর নিইচি তলায় তলায়। বংশীকে আবার এখানে আনুন বাবু, ও হোটেল এক দিনে ভুস্যিনাশ হয়ে বসে রয়েচে। বংশীকে ভাঙাবার লোক লাগান আপনি–আর ওর ভাগ্নেটাকেও—

.

পরদিন দুপুরে বংশীর ভাগ্নে সসঙ্কোচে হাজারির বাসায় নিমন্ত্রণ রক্ষা করিতে আসিল। হাজারি হোটেল হইতে তাহাকে পাঠাইয়া দিল বটে, কিন্তু নিজে তখন আসিতে পারিল না, অত্যন্ত ভিড় লাগিয়াছে খরিদ্দারের, কারণ সেদিন হাটবার।

মায়ের আদেশে টেঁপিকে অতিথির সামনে অনেকবার বাহির হইতে হইল। কখনও বা আসন পাতা, কখনও জলের গ্লাসে জল দেওয়া ইত্যাদি। টেঁপি খুব চটপটে চালাকচতুর মেয়ে, অতসীর শিষ্যা–কিন্তু হঠাৎ তাও কেমন যেন একটু লজ্জা করিতে লাগিল এই সুন্দর ছেলেটির সামনে বার বার বাহির হইতে।

বংশীর ভাগ্নেটিও একটু বিস্মিত হইল। হাজারি-মামারা পাড়াগাঁয়ের লোক সে জানে– অবস্থাও এতদিন বিশেষ ভাল ছিল না। আজই না হয় হোটেলের ব্যবসায়ে দু-পয়সার মুখ দেখিতেছে। কিন্তু হাজারি-মামার মেয়ে তো বেশ দেখিতে, তাহার উপর তার চালচলন ধরন-ধারণ যেন স্কুলে পড়া আধুনিক মেয়েছেলের মত। সে কাপড় গুছাইয়া পরিতে জানে, সাজিতে গুজিতে জানে, তার কথাবার্তার ভঙ্গিটাও বড় চমৎকার।

তাহার খাওয়া প্রায় শেষ হইয়াছে এমন সময় হাজারি আসিল। বলিল–খাওয়া হয়েছে বাবা, আমি আসতে পারলাম না–আজ আবার ভিড় বড্ড বেশী।

–ও টেঁপি আমায় একটু তেল দে মা, নেয়ে নিই, আর তোর ঐ দাদার শোওয়ার জায়গা করে দে দিকি–-পাশের ঘরটাতে একটু গড়িয়ে নাও বাবা।

বংশীর ভাগ্নে গিয়া শুইয়াছে–এমন সময় টেঁপি পান দিতে আসিল। পানের ডিবা নাই, একখানা ছোট রেকাবিতে পান আনিয়াছে। ছেলেটি দেখিল চুন নাই রেকাবিতে। লাজুক মুখে বলিল–একটু চুন দিয়ে যাবেন?

টেঁপির সারা দেহ লজ্জার আনন্দে কেমন যেন শিহরিয়া উঠিল। তাহার প্রথম কারণ তাহার প্রতি সম্ভ্রমসূচক ক্রিয়াপদের ব্যবহার এই হইল প্রথম। জীবনে ইতিপূর্বে তাহাকে কেহ ‘আপনি’ ‘আজ্ঞে’ করিয়া কথা বলে নাই। দ্বিতীয়ত: কোনও অনাত্মীয় তরুণ যুবকও তাহার সহিত ইতিপূৰ্ব্বে কথা বলে নাই। বলে নাই কি একেবারে! গাঁয়ের রামু-দা, গোপাল-দা, জহর-দা-ইহারাও তাহার সঙ্গে তো কথা বলিত! কিন্তু তাহাতে এমন আনন্দ তাহার হয় নাই তো কোনোদিন? চুন আনিয়া রেকাবিতে রাখিয়া বলিল–এতে হবে?

–খুব হবে। থাক ওখানেই–ইয়ে, এক গেলাস জল দিয়ে যাবেন?

টেঁপির বেশ লাগিল ছেলেটিকে। কথাবার্তার ধরন যেমন ভাল, গলার সুরটিও তেমনি মিষ্ট। যখন জলের গ্লাস আনিল, তখন ইচ্ছা হইতেছিল ছেলেটি তাহার সঙ্গে আর একবার কিছু বলে। কিন্তু ছেলেটি এবার আর কিছু বলল না। টেঁপি জলের গ্লাস নামাইয়া রাখিয়া চলিয়া গেল।

বেলা যখন প্রায় পাঁচটা, বৈকাল অনেক দূর গড়াইয়া গিয়াছে –টেঁপি তখন একবার উঁকি মারিয়া দেখিল, ছেলেটি অঘোরে ঘুমাইতেছে।

হঠাৎ টেঁপির কেমন একটা অহেতুক স্নেহ আসিল ছেলেটির প্রতি।

আহা, হোটেলে কত রাত পর্যন্ত জাগে। ভাল ঘুম হয় না রাত্রে!

টেঁপি আসিয়া মাকে বলিল–মা সেই লোকটা এখনও ঘুমুচ্ছে। ডেকে দেবো, না ঘুমুবে।

টেঁপির মা বলিল–ঘুমুচ্ছে ঘুমুক না। ডাকবার দরকার কি? চাকরটা কোথায় গেল? ঘুম থেকে উঠলে ওকে কিছু খেতে দিতে হবে। খাবার আনতে দিতাম। উনিও তো বাড়ী নেই।

টেঁপি বলিল–লোকটা চা খায় কিনা জানিনে, তাহলে ঘুম থেকে উঠলে একটু চা করে দিতে পারলে ভাল হোত।

টেঁপির মা চা নিজে কখনো খায় নাই, করিতেও জানে না। আধুনিকা মেয়ের এ প্রস্তাব তাহার মন্দ লাগিল না।

মেয়েকে বলিল–তুই করে দিতে পারবি তো?

মেয়ে খিল খিল করিয়া হাসিয়া বলিল–তুমি যে কি বল মা, হেসে প্রাণ বেরিয়ে যায়– পরে কেমন একটি অপূৰ্ব ভঙ্গিতে হাত নাড়িয়া নাড়িয়া হাসিভরা মুখের চিবুকখানি বার বার উঠাইয়া-নামাইয়া বলিতে লাগিল–চা কই? চিনি কই? কেটলি কই? চায়ের জল ফুটবে কিসে? ডিস-পেয়ালা কই? সে সব আছে কিছু?

টেঁপির মায়ের বড় ভাল লাগিল টেঁপির এই ভঙ্গি। সে সস্নেহে মুগ্ধদৃষ্টিতে মেয়ের দিকে হাঁ করিয়া চাহিয়া রহিল। এমন ভাবে এমন সুন্দর ভঙ্গিতে কথা টেঁপি আর কখনও বলে নাই।

এই সময় হাজারি বাড়ীর মধ্যে ঢুকিল, হোটেলেই ছিল। বলিল–নরেন কোথায়? ঘুমুচ্ছে নাকি?

টেঁপির মা বলিল–তুমি এতক্ষণ ছিলে কোথায়? ওকে একটু খাবার আনিয়ে দিতে হবে। আর টেঁপি বলছে চা করে দিলে হোত।

হাজারির বড় স্নেহ হইল টেঁপির উপর। সে না জানিয়া যাহাকে আজ যত্ন করিয়া চা খাওয়াইতে চাহিতেছে, তাহারই সঙ্গে তার বাবা-মা যে বিবাহের ষড়যন্ত্র করিতেছে–বেচারী কি জানে?

বলিল–আমি সব এনে দিচ্ছি। হোটেলেই আছে। হোটেলে বড় ব্যস্ত আছি, কলকাতা থেকে দশ-বারো জন বাবু এসেছে শিকার করতে। ওর। অনেকদিন আগে একবার এসে আমার রান্না মাংস খেয়ে খুব খুশি হয়েছিল। সেই আগের হোটেলে গিয়েছিল, সেখানে নেই শুনে খুঁজে খুঁজে এখানে এসেছে। ওরা রাত্রে মাংস আর পোলাও খাবে। তোমরা এবেলা রান্না কোরো না–আমি হোটেল থেকে আলাদা করে পাঠিয়ে দেবো এখন। নরেনকে যে একবার দরকার, বাবুদের সঙ্গে ইংরিজিতে কথাবার্তা কইতে হবে, সে তো আমি পারবো না, নরেনকে ওঠাই দাঁড়াও–

টেঁপির মা বলিল–ঘুম থেকে উঠিয়ে কিছু না খাইয়ে ছাড়া ভাল দেখায় না। টেঁপি চায়ের কথা বলচিল–তা হোলে সেগুলো আগে পাঠিয়ে দেওগে, এখন জাগিও না।

.

বৈকালের দিকে নরেন ঘুম ভাঙিয়া উঠিল। অত্যন্ত বেলা গিয়াছে, পাঁচিলের ধারে সজনে গাছটার গায়ে রোদ হলদে হইয়া আসিয়াছে। নরেনের লজ্জা হইল– পরের বাড়ী কি ঘুমটাই ঘুমাইয়াছে। কে কি–বিশেষ করিয়া হাজারি-মামার মেয়েটি কি মনে করিল। বেশ মেয়েটি। হাজারি-মামার মেয়ে যে এমন চালাক-চতুর, চটপটে, এমন দেখিতে, এমন কাপড়-চোপড় পরিতে জানে তাহা কে ভাবিয়া ছিল?

অপ্রতিভ মুখে সে গায়ে জামা পরিয়া বাহির হইবার উদ্যোগ করিতেছে, এমন সময় টেঁপি আসিয়া বলিল–আপনি উঠেছেন? মুখ ধোবার জল দেবো?

নরেন থতমত খাইয়া বলিল–না, না, থাক আমি হোটেলেই–

–মা বললে আপনি চা খেয়ে যাবেন, আমি মাকে বলে আসি—

ইতিমধ্যে হাজারি চায়ের আসবাব হোটেলের চাকর দিয়া পাঠাইয়া দিয়াছিল, টেঁপি নিজেই চা করিতে বসিয়া গেল। তাহার মা জলখাবারের জন্য ফল কাটিতে লাগিল।

টেঁপি বলিল–মা চায়ের সঙ্গে শসা-টসা দেয় না। তুমি বরং ঐ নিমকি আর রসগোল্লা দাও রেকাবিতে–

–শসা দেয় না? একটা ডাব কাটবো? বাড়ীর ভাব আছে—

টেঁপি হাসিতে হাসিতে গড়াইয়া পড়ে আর কি। মুখে আঁচল চাপা দিয়া বলিল–হি হি, তুমি মা যে কি!…চায়ের সঙ্গে বুঝি ডাব খায়?

টেঁপির মা অপ্রসন্ন মুখে বলিল–কি জানি তোদের একেলে ঢং কিছু বুঝিনে বাপু। যা বোঝো তাই করো। ঘুম থেকে উঠলে তো নতুন জামাইদের ডাব দিতে দেখেছি চিরকাল দেশেঘরে-

কথাটা বলিয়া ফেলিয়াই টেঁপির মা মনে মনে জিভ কাটিয়া চুপ করিয়া গেল। মানুষটা একটু বোকা ধরনের, কি ভাবিয়া কি বলে, সব সময় তলাইয়া দেখিতে জানে না।

টেঁপি আশ্চর্য্য হইয়া বলিল–নতুন জামাই? কে নতুন জামাই?

–ও কিছু না; দেশে দেখেছি তাই বলচি। তুই নে, চা করা হোল?

টেঁপির মনে কেমন যেন খটকা লাগিল। সে খুব বুদ্ধিমতী, তাহার উপর নিতান্ত ছেলে মানুষটিও নয়, যখন চা ও খাবার লইয়া পুনরায় ছেলেটির সামনে গেল তখন তাহার কি জানি কেন যে লজ্জা করিতেছে তাহা সে নিজেই ভাল ধরিতে পারিল না।

ছেলেটি তাহাকে দেখিয়া বলিল–ও কি! এই এত খাবার কেন এখন, চা একটু হোলেই–

টেঁপি কোনো রকমে খাবারের রেকাবি লোকটার সামনে রাখিয়া পলাইয়া আসিলে যেন বাঁচে।

ছেলেটি ডাকিয়া বলিল–পান একটা যদি দিয়ে যান—

পান সাজিতে বসিয়া টেঁপি ভাবিল–বাবা খাটিয়ে মারলে আমায়! চা দেও–পান সাজো–আমার যেন যত গরজ পড়েছে, বাবার হোটেলের লোক তা আমার কি?

টেঁপি একটা চায়ের পিরিচে পান রাখিয়া দিতে গেল। ছেলেটি দেখিতে বেশ কিন্তু। কথাবার্তা বেশ, হাসি-হাসি মুখ। কি কাজ করে হোটেলে কে জানে?

পান লইয়া ছেলেটি চলিয়া গেল। যাইবার সময় বলিয়া গেল–মামীমা আমি যাচ্ছি, কষ্ট দিয়ে গেলাম অনেক, কিছু মনে করবেন না। এত ঘুমিয়েছি, বেলা আর নেই আজ।

বেশ ছেলেটি।

নতুন জামাই? কে নতুন জামাই? কাহাদের নতুন জামাই?

মা এক-একটা কথা বলে কি যে, তার মানে হয় না।

.

টেঁপির মা কখনও এত বড় শহর দেখে নাই।

এখানকার কাণ্ডকারখানা দেখিয়া সে অবাক হইয়া গিয়াছে। মোটর গাড়ী, ঘোড়ার গাড়ী, ইস্টিশানে বিদ্যুতের আলো, লোকজনই বা কত! আর তাদের এঁড়োশোলায় দিনমানেই শেয়াল তাকে বাড়ীর পিছনকার ঘন বাঁশবনে। সেদিন তো দিনদুপুরে জেলেপাড়ার কেষ্ট জেলের তিন মাসের ছেলেকে শেয়ালে লইয়া গেল।

ইতিমধ্যে কুসুম আসিয়া একদিন উহাদের বেড়াইতে লইয়া গেল। কুসুমের সঙ্গে তাহার রাধাবল্পভতলা, সিদ্ধেশ্বরীতলা, চূর্ণীর ঘাট, পালচৌধুরীদের বাড়ী–সব ঘুরিয়া ঘুরিয়া দেখিল। পালচৌধুরীদের প্রকাণ্ড বাড়ী দেখিয়া টেঁপির মা ও টেঁপি দু-জনেই অবাক। এত বড় বাড়ী জীবনে তাহারা দেখে নাই। অতসীদের বাড়ীটাই এতদিন বড়লোকের বাড়ীর চরম নিদর্শন বলিয়া ভাবিয়া আসিয়াছে যাহারা, তাহাদের পক্ষে অবাক হইবার কথা বটে।

টেঁপির মা বলিল–না, শহর জায়গা বটে কুসুম! গায়ে গায়ে বাড়ী আর সব কোঠাবাড়ী এদেশে। সবাই বড়লোক। ছেলেমেয়েদের কি চেহারা, দেখে চোখ জুড়ায়। হাঁরে, এদের বাড়ী ঠাকুর হয় না? পুজোর সময় একদিন আমাদের এনো মা, ঠাকুর দেখে যাবো।

সে আর ইহার বেশী কিছুই বোঝে না।

একটা বাড়ীর সামনে কত কি বড় বড় ছবি টাঙানো, লোকজন ঢুকিতেছে, রাস্তার ধারে কি কাগজ বিলি করিতেছে। টেঁপির মনে হইল এই বোধ হয় সেই টকি যাকে বলে, তাহাই। কুসুমকে বলিল–কুসুম দি, এই টকি না?

–হ্যাঁ দিদি। একদিন দেখবে?

-–এক দিন এনো না আমাদের। মা-ও কখনো দেখে নি–সবাই আসবো।

একখানা ধাবমান মোটর গাড়ীর দিকে টেঁপির মা হাঁ করিয়া চাহিয়া দেখিতে লাগিল, যতক্ষণ সেখানা রাস্তার মোড় ঘুরিয়া অদৃশ্য না হইয়া গেল।

কুসুম বলিল–আমার বাড়ী একটু পায়ের ধূলো দিন এবার জ্যাঠাইমা

কুসুমের বাড়ী যাইতে পথের ধারে রেলের লাইন পড়ে। টেঁপির মা বলিল–কুসুম, দাঁড়া মা একখানা রেলের গাড়ী দেখে যাই–

বলিতে বলিতে একখানা প্রকাণ্ড-মালগাড়ী আসিয়া হাজির। টেঁপি ও টেঁপির মা দুজনেই একদৃষ্টে দেখিতে লাগিল। গাড়ী চলিয়াছে তো চলিয়াছে–তাহার আর শেষ নাই।

উঃ, কি বড় গাড়ীটা!

কুসুম বলিল–জ্যাঠাইমা, রাণাঘাট ভাল লাগছে?

-লাগচে বৈকি, বেশ জায়গা মা।

আসলে কিন্তু এঁড়োশোলার জন্য টেঁপির মায়ের মন কেমন করে। শহরে নিজেকে সে এখনও খাপ খাওয়াইতে পারে নাই। সেখানকার তালপুকুরের ঘাট, সদা বোষ্টমের বাড়ীর পাশ দিয়া যে ছোট নিভৃত পথটি বাঁশবনের মধ্য দিয়া বাঁড়ুয্যে-পাড়ার দিকে গিয়াছে, দুপুর বেলা তাহাদের বাড়ীর কাছে বড় শিরীষ গাছটায় এই সময় শিরীষের সুঁটি শুকাইয়া ঝুন ঝুন শব্দ করে, তাহাদের উঠানের বড় লাউমাচায় এতদিন কত লাউ ফলিয়াছে, পেঁপে গাছটায় কত পেঁপের ফুল ও জালি দেখিয়া আসিয়াছিল–সে সবের জন্য মন কেমন করে বৈকি।

তবে এখানে যাহা সে পাইয়াছে টেঁপির মা জীবনে সে রকম সুখের মুখ দেখে নাই। চাকরের ওপর হুকুম চালাইয়া কাজ করাইয়া লওয়া, সকলে মানে, খাতির করে–অমন সুন্দর ছেলেটি তাহাদের হোটেলের মূহুরী– এ ধরনের ব্যাপারে কল্পনাও কখনও সে করিয়াছিল?

কুমের বাড়ী সকলে গিয়া পৌঁছিল। কুসুম ভারি খুশি হইয়া উঠিয়াছে–তাহার বাপের বাড়ী দেশের ব্রাহ্মণ-পরিবারকে এখানে পাইয়া। কুসুমের শাশুড়ী আসিয়া টেঁপির মায়ের পায়ের ধূলা লইয়া প্রণাম করিয়া বলিল–আমাদের বড্ড ভাগ্যি মা, আপনাদের চরণ-ধূলো পড়লো এ বাড়ীতে।

টেঁপির মাকে এত খাতির কবিয়া কেহ কখনো কথা বলে নাই–এত সুখও তাহার কপালে লেখা ছিল! হায় মা ঝিটকিপোতার বনবিবি, কি জাগ্রত দেবতাই তুমি! সেবার ঝিটকিপোতায় চৈত্র মাসে মেলায় গিয়া টেঁপির মা বনবিবিতলায় স-পাঁচ আনার সিন্নি দিয়া স্বামীপুত্রের মঙ্গলকামনা করিয়াছিল, এখনও যে বছর পার হয় নাই! তবুও লোকে ঠাকুর দেবতা মানিতে চায় না।

কুসুম সকলকে জলযোগ করাইল। পান সাজিয়া দিল। কুসুমের শাশুড়ী আসিয়া কতক্ষণ গল্পগুজব করিল। কুসুম গ্রামের কথাই কেবল শুনিতে চায়। কতদিন বাপের বাড়ী যায় নাই, বাবা-মা মরিয়া গিয়াছে, জ্যাঠামশায় আছে, কাকারা আছে–তাহারা কোনো দিন খোঁজও নেয় না। খোঁজ করিত অবশ্যই, যদি তাহার নিজের অবস্থা ভাল হইত। গরীব লোকের আদর কে করে?…এই সব অনেক দুঃখ কৰিল। আরও কিছুক্ষণ বসিবার পরে কুসুম উহাদের বাসায় পৌঁছিয়া দিয়া গেল।

দিন দুই পরে একদিন সকালে পদ্মঝি বলিল–ও ঠাকুর, শুনে রাখো, আজ কোথাও যেও না সব ছুটির পরে। আজ ও-বেলা সত্যনারায়ণের সিন্নি–খদ্দেরদের ভাত দেবার সময় বলে দিও ও-বেলা যেন থাকে–আর তোমরা খেয়ে-দেয়ে আমার সঙ্গে বেরুবে সত্যনারায়ণের বাজার করতে।

বংশী ঠাকুর হাজারির দিকে চাহিয়া হাসিল–অবশ্য পদ্মঝি চলিয়া গেলে।

ব্যাপারটা এই, হোটেলের এই যে সত্যনারায়ণের পূজা, ইহা ইহাদের একটি ব্যবসা। যাহারা মাসিক হিসাবে হোটেলে খায় তাহাদের নিকট হইতে পূজার নাম করিয়া চাঁদা বা প্রণামী আদায় হয়। আদায়ী টাকার সব অংশ ব্যয় করা হয় না বলিয়াই হাজারি বা বংশীর ধারণা। অথচ, সত্যনারায়ণের প্রসাদের লোভ দেখাইয়া দৈনিক নগদ খরিদ্দার যাহারা তাহাদেরও রাত্রে আনিবার চেষ্টা করা হয়–কারণ এমন অনেক নগদ খরিদ্দার আছে, যাহারা একবেলা হোটেলে খাইয়া যায়, দু-বেলা আসে না।

বংশী ঠাকুর পরিবেশনের সময় প্রত্যেক ঠিকা খরিদ্দারকে মোলায়েম হাসি হাসিয়া বলিতে লাগি—আজ্ঞে বাবু, ও-বেলা সত্যনারাণ হবে হোটেলে, আসবেন ও-বেলা–অবিশ্যি করে আসবেন–

বাহিরে গদির ধরে বেচু চক্কত্তিও খরিদ্দারদিগকে ঠিক অমনি বলিতে লাগিল।

বংশী ঠাকুর হাজারিকে আড়ালে বলিল–সব ফাঁকির কাজ, এক চিলতে কলার পাতার আগায় এক হাত করে গুড় গোলা আটা আর তার ওপর দুখানা বাতাসা–হয়ে গেল এর নাম তোমার সত্যনারাণের সিন্নি। চামার কোথাকার–

সন্ধ্যার সময় পূর্ণ ভটচাজ সত্যনারায়ণের পূজা করিতে আসিলেন। বাসনের ঘরে সত্য নারায়ণের পিঁড়ি পাতা হইয়াছে। হোটেলের দুই চার মিলিয়া ঘড়ি ও কাঁসর পিটাইতেছে, পদ্মঝি ঘন ঘন শাঁকে ফুঁ পাড়িতেছে–খানিকটা খরিদ্দার আকৃষ্ট করিবার চেষ্টাতেও বটে।

স্টেশনে যে চাকর ‘হি-ই-ই-ন্দু হো-টে-ল-ল’ বলিয়া চেঁচায়, তাহাকেও বলিয়া দেওয়া হইয়াছে, সে যাত্রীদের প্রত্যেককে বলিতেছে–‘আসুন বাবু, সিমি পেশাদ হচ্চেন হোটেলে, খাওয়ার বড্ড জুৎ আজগে–আসুন বাবু–’

যাহারা নগদ পয়সার খরিদ্দার, তাহারা ভাবিতেছে–অন্য হোটেলেও তো পয়সা দিয়া খাইবে যখন তখন সত্যনারায়ণের প্রসাদ ফাউ যদি পাওয়া যায়, বেচু চকত্তির হোটেলেই যাওয়া যাক না কেন। ফলে যদু বাঁড়ুয্যের হোটেলের দৈনিক নগদ খরিদ্দার যাহারা, তাহারাও অনেকে আসিয়া জুটিতেছে এই হোটেলে। এদিকে নগদ খরিদ্দারদের জন্য ব্যবস্থা এই যে, তাহাদের সিন্নি খাইতে দেওয়া হইবে ভাতের পাতে অর্থাৎ টিকিট কিনিয়া ভাত খাইতে ঢুকিলে তবে। নতুবা সিন্নিটুকু খাইয়া লইয়াই যদি খরিদ্দার পালায়?

মাসিক খরিদ্দারের জন্য অন্য প্রকার ব্যবস্থা। তাঁহারা চাঁদা দিয়াছে, বিশেষতঃ তাহাদের খাতির করাও দরকার। পূজা সাঙ্গ হইলে তাহাদের সকলকে একত্র বসাইয়া প্রাসাদ খাইতে দেওয়া হইল–বেচু চক্কত্তি নিজে প্রত্যেকের কাছে গিয়া জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন তাহারা আর একটু করিয়া প্রসাদ লইবে কি না।

যখন ওদিকে মাসিক খরিদ্দাগণকে সিন্নি বিতরণ করা হইতেছে, সে সময় হাজারি দেখিল রাস্তার উপর যতীন মজুমদার দাঁড়াইয়া হাঁ করিয়া তাহাদের হোটেলের দিকে চাহিয়া আছে। সেই যতীন…

হাজারির মনে হইল লোকটার অবস্থা আরও খারাপ হইয়া গিয়াছে, কেমন যেন অনাহার-শীর্ণ চেহারা। সে ডাকিয়া বলিল–ও যতীনবাবু, কেমন আছেন?

যতীন মজুমদার অবাক হইয়া বলিল–কে হাজারি নাকি? তুমি আবার কবে এলে এখানে।

–সে অনেক কথা বলবো এখন। আসুন না—আসুন—

যতীন ইতস্ততঃ করিয়া রান্নাঘরের পাশে বেড়ার গায়ের দরজা দিয়া হোটেলে ঢুকিয়া রান্নাঘরের দোরে আসিয়া দাঁড়াইল।

হাজারি দেখিল তাহার পায়ে জুতা নাই, গায়ে অতি মলিন উড়ানি, পরনের ধুতিখানিও তদ্রূপ। আগের চেয়ে রোগাও হইয়া গিয়াছে লোকটা। দারিদ্র্য ও অভাবের ছাপ চোখে মুখে বেশ পরিস্ফূট।

যতীন কাষ্ঠহাসি হাসিয়া বলিল–আরে, তোমাদের এখানে বুঝি সত্যনারায়ণ হচ্চে আজগে? আগে আমিও কত এসেছি খেয়েছি–

–তা খাবেন না? আপনি তো ছিলেন বারোমাসের বাঁধা খদ্দের–তা আসুন পেরসাদ খেয়ে যান–

যতীন ভদ্ৰতা করিয়া বলিল–না না, থাক থাক–তার জন্যে আর কি হয়েচে–

হাজারি একবার এদিক ওদিক চাহিয়া দেখিল কেহ কোনোদিকে নাই। সবাই খাবার ঘরে মাসিক খরিদ্দারের আদর আপ্যায়ন করিতে ব্যস্ত–সে কলার পাত পাতিয়া যতীনকে বসাইল এবং পাশে বাসনের ঘর হইতে বড় বাটির একবাটি সত্যনারায়ণের সিন্নি, একমুঠা বাতাসা ও দুটি পাকা কলা আনিয়া যতীনের পাতে দিয়া বলিল–একটু পেরসাদ খেয়ে নিন–

যতীন মজুমদার দ্বিরুক্তি না করিয়া সিন্নির সহিত কলাদুটি চটকাইয়া মাখিয়া লইয়া যেভাবে গোগ্রাসে গিলিতে লাগিল, তাহাতে হাজারিরও মনে হইল লোকটা সত্যই যথেষ্ট ক্ষুধার্ত ছিল, বোধ হয় ওবেলা আহার জোটে নাই। তিন চার গ্রাসে অতখানি সিন্নি সে নিঃশেষে উড়াইয়া দিল।

হাজারি বলিল–আর একটু নেবেন?

যতীন পূর্বের মত ভদ্রতার সুরে বলিল–না না, থাক থাক আর কেন–

হাজারি আরও এক বাটি সিন্নি আনিয়া পাতে ঢালিয়া দিতে যতীনের মুখচোখ যেন উজ্জল হইয়া উঠিল।

তাহার খাওয়া অর্ধেক হয়েছে এমন সময় পদ্মঝি রান্নাঘরের দোরে আসিয়া হাজারিকে কি একটা বলতে গেল এবং গোগ্রাসে ভোজনরত যতীন মজুমদারকে দেখিয়া হঠাৎ থমকিয়া দাঁড়াইল বলিল–ও কে?

হাজারি হাসিয়া বলিল–ও যতীনবাবু, চিনতে পাচ্ছ না পদ্মদিদি? আমাদের পুরোনো বাবু। যাচ্ছিলেন রাস্তা দিয়ে, তা আমি বল্লাম আজ পুজোর দিনটা একটু পেরসাদ পেয়ে যান বাবু–

পদ্মঝি বলিল—বেশ–বলিয়াই সে ফিরিয়া আবার গিয়া মাসিক খরিদ্দারদের খাবার ঘরে ঢুকিল।

যতীন ততক্ষণ পদ্মঝিকে কি একটা কথা বলিতে যাইতেছিল, কিন্তু সে কথা বলিবার সুযোগ ঘটিল না তাহার। সে খাওয়া শেষ করিয়া এক ঘটি জল চাহিয়া লইয়া খাইয়া চোরের মত খিড়কি দরজা দিয়া বাহির হইয়া গেল।

অল্পক্ষণ পরেই গোবরা চাকর আসিয়া বলিল–ঠাকুর, কৰ্ত্তা তোমাকে ডাকছেন—

হাজারি বুঝিয়াছিল কর্তা কি জন্য তাহাকে জরুরী তলব দিয়াছেন। সে গিয়া বুঝিল তাহার অনুমান সত্য–কারণ পদ্মঝি মুখ ভার করিয়া গদির ঘরে বেচু চক্কত্তির সামনে দাঁড়াইয়া। বেচু চক্কত্তি বললেন–হাজারি, তুমি যতনেটাকে হোটেলে ঢুকিয়ে তাকে বসিয়ে সিন্নি খাওয়াচ্ছিলে?

পদ্মঝি হাত নাড়িয়া বলিল–আর খাওয়ানো বলে খাওয়ানো! এক এক গামলা সিন্নি দিয়েছে তার পাতে–ইচ্ছে ছিল নুকিয়ে খাওয়াবে, ধর্মের ঢাক বাতাসে নড়ে, আমি গিয়ে পড়েছি সেই সময় বড় ডেক নামলো কি না তাই দেখতে–আমায় দেখে–

হাজারি বিনীত ভাবে বলিল–সত্যনারাণের পেশাদ বলেই বাবু দিয়েছিলাম–আমাদের পুরোনো খদ্দের–

বেচু চক্কত্তি দাঁত খিঁচাইয়া বলিলেন–পুরোনো খদ্দের? ভারি আমার পুরোনো খদ্দের রে? হোটেলের একটি মুঠো টাকা ফাঁকি দিয়ে চলে গিয়েছে, ভারি খদ্দের আমার! চার মাস বিনি পয়সায় খেয়ে গেল একটি আধলা উপুড়-হাত করলে না, পয়লা নম্বরের জুয়াচার কোথাকার-খদ্দের! তুমি কার হুকুমে তাকে হোটেলে ঢুকতে দিলে শুনি?

পদ্মঝি বলিল–আমি কোনো কথা বল্লেই তো পদ্ম বড় মন্দ। এই হাজারি ঠাকুর কি কম শয়তান নাকি–বাবু? আপনি জানেন না সব কথা, সব কথা আপনার কানে তুলতেও আমার ইচ্ছে করে না। নুকিয়ে নুকিয়ে হোটেলের আদ্ধেক জিনিস ওঠে ওর এয়ার বকশীদের বাড়ী। যতনে ঠাকুর ওর এয়ার, বুঝলেন না আপনি? বহাল করেন লোক, তখন আমি কেউ নই– কিন্তু হাতে হাতে ধরে দেবার বেলা এই জনা না হোলেও দেখি চলে না–এই দেখুন আবার চুরি-চামারি শুরু যদি না হয় হোটেলে, তবে আমার নাম–

বেচু চক্কত্তি বলিলেন–এটা তোমার নিজের হোটেল নয় যে তুমি হাজারি ঠাকুর এখানে যা খুশি করবে। নিজের মত এখানে খাটালে চলবে না জেনো। তোমার আট আনা জরিমানা হোল।

হাজারি বলিল–বেশ বাবু, আপনার বিচারে যদি তাই হয়, করুন জরিমানা। তবে যতীন বাবু আমার এয়ারও নয় বা সে সব কিছুই নয়। এই হোটেলেই ওঁর সঙ্গে আমার আলাপ–ওঁকে দেখিনিও কতদিন। পদ্মদিদি অনেক অনেয্য কথা লাগায় আপনার কাছে–আমি আসছে মাস থেকে আর এখানে চাকরি করবো না।

পদ্মঝি এ কথায় অনর্থ বাধাইল। হাত পা নাড়িয়া চীৎকার করিয়া বলিল–লাগায়? লাগায় তোমার নামে? তুমি যে বড় লাগাবার যুগ্যি লোক। তাই পদ্ম লাগিয়ে লাগিয়ে বেড়াচ্ছে তোমার নামে। যত বড় মুখ নয় তত বড় কথা। তোমার মত লোককে পদ্ম গেরায্যির মধ্যে আনে না তা তুমি ভাল করে বুঝো ঠাকুর। যাও না, তুমি আজই চলে যাও। সামনের মাসে কেন, মাইনেপত্তর চুকিয়ে আজই বিদেয় হও না–তোমার মত ঠাকুর রেল-বাজারে গণ্ডায় গণ্ডায় মিলবে–

বেচু চক্কত্তি বলিলেন–চুপ চুপ পদ্ম, চুপ করো। খদ্দেরপত্র আসচে যাচ্চে, ওকথা এখন থাক। পরে হবে–আচ্ছা তুমি যাও এখন হাজারি ঠাকুর–

অনেক রাতে হোটেলের কাজ মিটিল।

শুইবার সময় হাজারি বংশীকে বলিল–দেখলে তো কি রকম অপমানটা আমার করলে পলদিদি? তুমিও ছাড়, চল দুজনে বেরিয়ে যাই। দ্যাখো একটা কথা বংশী, এই হোটেলের ওপর কেমন একটা মায়া পড়ে গিয়েছিল, মুখে বলি বটে যাই যাই–কিন্তু যেতে মন সরে না। কতকাল ধরে তুমি আর আমি এখানে আছি ভেবে দ্যাখো তো? এ যেন আপনার ঘর বাড়ী হয়ে গিয়েছে–তাই না? কিন্তু এরা–বিশেষ করে পদ্মদিদি এখানে টিকতে দিলে না–এবার সত্যিই যাবো।

বংশী বলিল–ষতীনকে তুমি ডেকে দিলে না ও আপনি এসেছিল?

–আমি ডেকেছিলাম। ওর অবস্থা খারাপ হয়ে গিয়েচে, আজকাল খেতেই পায় না। তাই ডাকলাম। বলি পুরোনো খদ্দের তো, কত লোক খেয়ে যাচ্চে, ও একটু সিন্নি খেয়ে যাক। এই তো আমার অপরাধ।

.

পরের মাসের শুভ পয়লা তারিখে রেলবাজারে গোপাল ঘোষের তামাকের দোকানের পাশেই নূতন হোটেলটা খুলিল! টিনের সাইনবোর্ড লেখা আছে—

আদর্শ হিন্দু-হোটেল হাজারি ঠাকুর নিজের হাতে রান্না করিয়া থাকেন। ভাত, ডাল, মাছ, মাংস সব রকম প্রস্তুত থাকে। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ও সস্তা। আসুন! দেখুন!! পরীক্ষা করুন!!!

বেচু চক্কত্তির হোটেলের অনুকরণে সামনেই গদির ঘর। সেখানে বংশী ঠাকুরের ভাগ্নে সেই ছেলেটি কাঠের বাক্সের উপর খাতা ফেলিয়া খরিদ্দারগণের আনাগোনার হিসাব রাখিতেছে। ভিতরে রান্না করিতেছে বংশী ও হাজারি–বেচু চক্কত্তির হোটেলের মতই তিনটি শ্রেণী করা হইয়াছে, সেই রকম টিকিট কিনিয়া ঢুকিতে হয়।

তা নিতান্ত মন্দ নয়। খুলিবার দিন দুপুরের খরিদ্দার হইল ভালই! বংশী খাইবার ঘরে ভাত দিতে আসিয়া ফিরিয়া গিয়া হাজারিকে বলিল–থাড কেলাস ত্রিশ খানা। প্রথম দিনের পক্কে যথেষ্ট হয়েছে। ওবেলা মাংস লাগিয়ে দাও।

বহুদিনের বাসনা ঠাকুর রাধাবল্লভ পূর্ণ করিয়াছেন। হাজারি এখন হোটেলের মালিক। বেচু চক্কত্তির সমান দরের লোক সে আজ। অত্যন্ত ইচ্ছা হইল, যত জানাশোনা পরিচিত লোক যে যেখানে আছে–সকলকেই কথাটা বলিয়া বেড়ায়। মনের আনন্দ চাপিতে না পারিয়া বৈকালে কুসুমের বাড়ী গিয়া হাজির হইল। কুসুম বলিল–কেমন চললো হোটেল জ্যাঠামশায়?

–বেশ খদ্দের পাচ্চি। আমার বড্ড ইচ্ছে তুমি একবার এসে দেখে যাও–তুমি তো অংশীদার–

–যাবো এখন। কাল সকালে যাবে। আপনার মনিব কি বল্লে?

–রেগে কাই। ও মাসের মাইনে দেয় নি–না দিকগে, সত্যিই বলচি কুসুম মা, আমার বয়েস কে বলে আটচল্লিশ হয়েচে? আমার যেন মনে হচ্চে আমার বয়েস পনের বছর কমে গিয়েচে। হাতপায়ে বল এসেচে কত! তুমি আর আমার অতসী মা–তোমরা আর জন্মে আমার কি ছিলে জানিনে—তোমাদের–

কুসুম বাধা দিয়া বলিল–আবার ওই সব কথা বলছেন জ্যাঠামশায়? আমার টাকা দিইচি সুদ পাবো বলে। এ তো ব্যবসায় টাকা ফেলা–টাকা কি তোরঙ্গের মধ্যে থেকে আমার স্বগগে পিদিম দিতো? বলি নি আমি আপনাকে? তবে হ্যাঁ, আমাদের বাবুর মেয়ের কথা যা বল্লেন, সে দিয়েছে বটে কোন খাঁই না করে। তার কথা, হাজার বার বলতে পারেন। তার বিয়ের কি হোল?

–সামনের সোমবার বিয়ে। চিঠি পেয়েছি–যাচ্ছি ওদিন সকালে।

–আমার কাকার সঙ্গে যদি দেখা হয় তবে এসব টাকাকড়ির কথা যেন বলবেন না সেখানে।

–তোমাকে শিখিয়ে দিতে হবে না মা, যতবার দেখা হয়েচে তোমার নামটি পর্যন্ত কখনো সেখানে ঘূণাক্ষরে করি নি। আমারও বাড়ী এঁড়োশোলা, আমায় তোমার কিছু শেখাতে হবে না।

কথামত পরদিন সকালে কুসুম হোটেল দেখতে গেল। সে দুধ দই লইয়া অনেক বেলা পৰ্য্যন্ত পাড়ায় পাড়ায় বেড়ায়– তাহার পক্ষে ইহা আশ্চর্যের কথা কিছুই নহে।

হাজারি তাহাকে রান্নাঘরে যত্ন করিয়া বসাইতে গেল–সে কিন্তু দোরের কাছে দাঁড়াইয়া রহিল, বলিল–আমি গুরুঠাকরুন কিছু আসি নি যে আসন পেতে যত্ন করে বসাতে হবে।

হাজারি বলিল–তোমারও তো হোটেল কুসুম-মা–তুমি এর অংশীদারও বটে, মহাজনও বটে। নিজের জিনিস ভাল করে দেখে শোনো। কি হচ্ছে না হচ্চে তদারক করো–এতে লজ্জা কি? বংশী, চিনে রাখো এ একজন অংশীদার।

এ কথায় কুসুম খুব খুশি হইল–মুখে তাহার আহ্লাদের চিহ্ন ফুটিয়া উঠিল। এমন একটা হোটেলের সে অংশীদার ও মহাজন–এ একটা নতুন জিনিস তাহার জীবনে। এ ভাবে ব্যাপারটা বোধ হয় ভাবিয়া দেখে নাই। হাজারি বলিল–আজ মাছ রান্না হয়েছে বেশ পাকা রুই। তুমি একটু বোসো মা, মুড়োটা নিয়ে যাও।

–না না জ্যাঠামশায়।–ওসব আপনাকে বারণ করে দিইচি না! সকলের মুখ বঞ্চিত করে আমি মাছের মুড়ো খাবো–বেশ মজার কথা!

–আমি তোমার বুড়ো বাবা, তোমাকে খাইয়ে আমার যদি তৃপ্তি হয়, কেন খাবে না বুঝিয়ে দাও।

হোটেলের চাকর হাঁকিল–থাড কেলাস তিন থালা–-

হাজারি বলল–খদ্দের আসছে বোসো মা একটু। আমি আসছি, বংশী ভাত বেড়ে ফেলো।

আসিবার সময় কুসুম সলজ্জ সঙ্কোচের সহিত হাজারির দেওয়া এক কাঁসি মাছ তরকারি লইয়া আসিল।

.

এক বছর কাটিয়া গিয়াছে।

হাজারি এঁডোশোলা হইতে গরুর গাড়ীতে রাণাঘাট ফিরিতেছে, সঙ্গে টেঁপির মা, টেঁপি ও ছেলেমেয়ে। তাহার হোটেলের কাজ আজকাল খুব বাড়িয়া গিয়াছে। রাণাঘাটে বাসা না করিলে আর চলে না।

টেঁপির মা বলিল–আর কতটা আছে হ্যাঁ গা?

–ওই তো সেগুন বাগান দেখা দিয়েছে–এইবার পৌঁছে যাবো

টেঁপি বলিল–বাবা, সেখানে নাইবো কোথায়? পুকুর আছে না গাঙ?

–গাঙ আছে, বাসায় টিউব কল আছে।

টেঁপির মা বলিল–তাহোলে জল টানতে হবে না পুকুর থেকে। বেঁচে যাই–

ইহারা কখনো শহরে আসে নাই–টেঁপির মার বাপের বাড়ী এঁডোশোলার দু ক্রোশ উত্তরে মণিরামপুর গ্রামে। জন্ম সেখানে, বিবাহ এঁড়োশোলায়, শহর দেখিবার একবার সুযোগ হইয়াছিল অনেকদিন আগে, অগ্রহায়ণ মাসে গ্রামের য়েদের সঙ্গে একবার নবদ্বীপে রাস দেখিতে গিয়াছিল।

হোটেলের কাছেই একখানা একতলা বাড়ী পূৰ্ব্ব হইতে ঠিক করা ছিল। টেঁপির মা বাড়ী দেখিয়া খুব খুশি হইল। চিরকাল খড়ের ঘরে বাস করিয়া অভ্যাস, কোঠাঘরে বাস এই তাহার প্রথম।

–কখানা ঘর গা? রান্নাঘর কোন্ দিকে? কই তোমার সেই টিউকল দেখি? জল বেশ ও তো? ওরে টেঁপি, গাড়ীর কাপড়গুলো আলাদা করে রেখে দে–একপাশে। ও-সব নিয়ে ছিষ্টি ছোঁয়ানেপা করো না যেন, বস্তার মধ্যে থেকে একটা ঘটি আগে বের করে দাও না গো, এক ঘটি জল আগে তুলে নিয়ে আসি।

একটু পরে কুসুম আসিয়া ঢুকিয়া বলিল–ও জেঠিমা, এলেন সব? বাসা পছন্দ হয়েছে তো?

টেঁপির মা কুসুমকে চেনে। গ্রামে তাহাকে কুমারী অবস্থা হইতেই দেখিয়াছে। বলিল– এসো মা কুসুম, এসো এসো! ভাল আছ তো? এসো এসো কল্যেণ হোক।

হোটেলের চাকর রাখাল এই সময় আসিল। তাহার পিছনে মুটের মাথায় এক বস্তা পাথুরে কয়লা। হাজারিকে বলিল–কয়লা কোনদিকে নামাবো বাবু?

হাজারি বলিল–কয়লা আনলি কেন রে? তোকে যে বলে দিলাম কাঠ আনতে? এর কয়লার আঁচ দিতে জানে না।

কুসুম বলিল–কয়লার উনুন আছে? আমি আঁচ দিয়ে দিচ্ছি। আর শিখে নিতে তো হবে জেঠিমাকে। কয়লা সস্তা পড়বে কাঠের চেয়ে এ শহর-বাজার জায়গায়। আমি একদিনে শিখিয়ে দেবো জেঠিমাকে।

রাখাল কয়লা নামাইয়া বলিল–বাবু, আর কি করতে হবে এখন?

হাজারি বলিল–তুই এখন যাসনে–জলটলগুলো তুলে দিয়ে জিনিসপত্তর গুছিয়ে রেখে তবে যাবি। হোটেলের বাজার এসেছে?

–এসেছে বাবু।

–তা থেকে এবেলার মত মাছ-তরকারি চার-পাঁচ জনের মত নিয়ে আয়। ওবেলা আলাদা বাজার করলেই হবে। আগে জল তুলে দে দিকি।

টেঁপির মা বলিল–ও কে গো?

–ও আমাদের হোটেলের চাকর। বাসার কাজও ও করবে, বলে দিইছি।

টেঁপির মা অবাক হইল। তাহাদের নিজেদের চাকর, সে আবার হাজারিকে ‘বাবু’ সম্বোধন করিতেছে–এ সব ব্যাপার এতই অভিনব যে বিশ্বাস করা শক্ত। গ্রামের মধ্যে তাহারা ছিল অতি গরীব গৃহস্থ, বিবাহ হইয়া পৰ্য্যন্ত বাসন-মাজা, জল-তোলা, ক্ষার-কাঁচা, এমন কি ধান ভানা পর্যন্ত সৰ্বরকম গৃহকৰ্ম্ম সে একা করিয়া আসিয়াছে। মাস চার পাঁচ হইল দুটি সচ্ছল অন্নের মুখ সে দেখিয়া আসিতেছে, নতুবা আগে আগে পেট ভরিয়া দুটি ভাত খাইতে পাওয়াও সব সময় ঘটিত না।

আর আজ এ কি ঐশ্বর্যের দ্বার হঠাৎ তাহার সম্মুখে উন্মুক্ত হইয়া গেল। কোঠাবাড়ী, চাকর, কলের জল–এ সব স্বপ্ন না সত্য?

রাখাল আসিয়া বলিল–দেখুন তো মা এই মাছ-তরকারিতে হবে না আর কিছু আনবো?

বড় বড় পোনা মাছের দাগা দশ-বারো খানা। টেঁপির মা খুশির সহিত বলিল–না বাবা আর আনতে হবে না। রাখো ওখানে।

–ওগুলো কুটে দিই মা?

মাছ কুটিয়াও দিতে চায় যে! এ সৌভাগ্যও তাহার অদৃষ্টে ছিল।

হাজারি বলিল–আগে জল তুলে দে তারপর কুটবি এখন। আগে সব নেয়ে নিই।

কুসুম কয়লার উনুনে আঁচ দিয়া আসিয়া বলিল–জেঠিমা আপনিও নেয়ে নিন। ততক্ষণ আঁচ ধরে যাক। বেলা প্রায় এগারোটা বাজে। রান্না চড়িয়ে দেবার আর দেরি করবার দরকার কি? আমি এবার যাই।

টেঁপির মা বলিল–তুমি এখানে এবেলা খাবে কুসুম।

কুসুম ব্যস্তভাবে বলিল–না না, আপনারা এলেন তেতেপুড়ে এই দুপুরের সময়। এখন কোনোরকমে দুটো ঝোলভাত রেঁধে আপনারা এবেলা খেয়ে নিন–তার মধ্যে আবার আমার খাওয়ার হাংনামায়–

–কিছু হাংনামা হবে না মা। তুমি না খেয়ে যেতে পারবে না। ভাল বেগুন এনেছি গাঁ থেকে, তোমাদের শহরে তেমন বেগুন মিলবে না–বেগুন পোড়াবো এখন। বাপের বাড়ীর বেগুন খেয়ে যাও আজ। কাল শুটকে যাবে।

হাজারি স্নান সারিয়া বলিল–আমি একবার হোটেলে চল্লাম। তোমরা রান্না চাপাও। আমি দেখে আসি।

আধঘণ্টা পরে হাজারি ফিরিয়া দেখিল টেঁপি ও টেঁপির মা দুজনে উনুনে পরিত্রাহি ফুঁ পাড়িতেছে। আঁচ নামিয়া গিয়াছে, তনও মাছের ঝোল বাকি।

টেঁপির মা বিপন্নমুখে বলিল–ওগো, এ আবার কি হোল, উনুন যে নিবে আসছে। কি করি এখন?

কুসুম বাড়ীতে স্নান করিতে গিয়াছে, রাখাল গিয়াছে হোটেলে, কারণ এই সময়টা সেখানে খরিদ্দারের ভিড় অত্যন্ত। এবেলা অন্ততঃ একশত জন খায়। বেচু চক্কত্তি ও যদু বাঁড়ুয্যের হোটেল কানা হইয়া পড়িয়াছে। হাজারি নিজের হাতে রান্না করে, তাহার রান্নার গুণে–রেলবাজারের যত খরিদ্দার সব ঝুঁকিয়াছে তাহার হোটেলে। তিনজন ঠাকুর ও চারিজন চাকরে হিমসিম খাইয়া যায়। ইহারা কেহই কয়লার উনুনে আঁচ দেওয়া দূরের কথা, কয়লার উনুনই দেখে নাই। আঁচ কমিয়া যাইতে বিষম বিপদে পড়িয়া গিয়াছে। ইহাদের অবস্থা দেখিয়া হাজারির হাসি পাইল। বলিল-শেখো, পাড়াগেঁয়ে ভূত হয়ে কতকাল থাকবে? সরে দিকি? ওর ওপর আর চাট্টি কয়লা দিতে হয়–এই দেখিয়ে দিই।

টেঁপির মা বলিল–আর তুমি বড্ড শহুরে মানুষ! তবুও যদি এঁডোশোলা বাড়ী না হোত!

–আমি? আমি আজ সাত বছর এই রাণাঘাটের রেলবাজারে আছি। আমাকে পাড়াগেঁয়ে বলবে কে? ওকথা তুলে রাখোগে ছিকেয়।

টেঁপি বলিল–বাবা এখানে টকি আছে? তুমি দেখেছ?

হাজারি বিশ হাত জলে পড়িয়া গেল। টকি বাইস্কোপ এখানে আছে বটে কিন্তু বাইস্কোপ দেখার শখ কখনও তাহার হয় নাই। কিন্তু টেঁপি আধুনিকা, এঁড়োশোলায় থাকিলে কি হয়, বাংলার কোন্ পাড়াগাঁয়ে আধুনিকতার ঢেউ যায় নাই?…বিশেষত অতসী তার বন্ধু…অতসীর কাছে অনেক জিনিস সে শুনিয়াছে বা শিখিয়াছে যাহা তাহার বাবা (মা তো নয়ই) জানেও না।

টেঁপির মা বলিল–টকি কি গা?

হাজারি আধুনিক হইবার চেষ্টায় গম্ভীর ভাবে বলিল–ছবিতে কথা কয়, এই। দেখেছি অনেকবার। দেখবো না আর কেন? হুঁ–

বলিয়া তাচ্ছিল্যের ভাবে সবটা উড়াইয়া দিবার চেষ্টা করিতে গেল–কিন্তু টেঁপি পরক্ষণেই জিজ্ঞাসা করিল–কি পালা দেখেছিলে বাবা?

–পালা! তা কি আর মনে আছে। লক্ষণের শক্তিশেল বোধহয়, হাঁ–লক্ষণের শক্তিশেল।

মনের মধ্যে বহু কষ্টে হাতড়াইয়া ছেলেবেলায় দেখা এক যাত্রার পালার নামটা হাজারি করিয়া দিল। টেঁপি বলিল–লপের শক্তিশেল আবার কি পালার নাম? ওর নাম তো টকি, পালার থাকে না? তাদের নাম আমি শুনেছি অতসীদির কাছে, সে তো

–হাঁ হাঁ–তুই আর অতসীদি ভারি সব জানিস আর কি! যা–সর দিকি–ওই কয়লার ঝুড়িটা–

–ও মামাবাবু, খাওয়া-দাওয়া হোল–বলিয়া বংশীর ভাগ্নে সেই সুন্দর ছেলেটি বাড়ীর মধ্যে ঢুকিতেই টেঁপির মা, পাড়াগেঁয়ে বউ, তাড়াতাড়ি মাথায় ঘোমটা টানিয়া দিতে গেল। টেঁপি কিন্তু নবাগত লোকটির দিকে কৌতূহলের দৃষ্টিতে চাহিয়া রহিল।

হাজারি বলিল–এসো বাবা এসো–ঘোমটা দিচ্ছ কাকে দেখে? ও হোল বংশীর ভাগ্নে। আমার হোটেলে খাতাপত্র রাখে। ছেলেমানুষ–ওকে দেখে আবার ঘোমটা–

বংশীর ভাগিনেয় আসিয়া টেঁপির মার পায়ের ধূলা লইয়া প্রণাম করিল।

হাজারি মেয়েকে বলিল–তোর নরেন দাদাকে প্রণাম কর টেঁপি। এইটি আমার মেয়ে, বাবা নরেন। ও বেশ লেখাপড়া জানে–সেলাইয়ের কাজটাজ ভাল শিখেছে আমাদের গাঁয়ের বাবুর মেয়ের কাছে।

টেঁপির হঠাৎ কেমন লজ্জা করিতে লাগিল। ছেলেটি দেখিতে যেমন, এমন চেহারার ছেলে সে কখনো দেখে নাই–কেবল ইহার সঙ্গে খানিকটা তুলনা করা যায় অতসীদি’র বরের। অনেকটা মুখের আদল যেন সেই রকম।

বংশীর ভাগ্নেও তাহার স্বচ্ছন্দ হৃদ্যতার ভাব হারাইয়া ফেলিয়াছে। চোখ তুলিয়া ভাল করিয়া চাওয়া যেন একটু কষ্টকর হইয়া উঠিতেছে। টেঁপির দিকে তো তেমন চাহিতেই পারিল না।

হাজারি বলিল–মুর্শিদাবাদের গাড়ী থেকে ক’জন নামলো আজ?

–নেমেছিল জনদশেক, তার মধ্যে তিনজনকে বেচু চক্কত্তির চাকর একরকম হাত ধরে জোর করেই টেনে নিয়ে গেল। বাকি সাতজন আমরা পেয়েছি–আর বনগাঁর ট্রেন থেকে এসেছিল পাঁচজন।

–ইস্টিশানে গিয়েছিল কে।

–ব্রজ ছিল, রাখালও ছিল বনগাঁর গাড়ীর সময়। ব্ৰজ বল্লে বেচু চক্কত্তির চাকরের সঙ্গে খদ্দের নিয়ে তার হাতাহাতি হয়ে যেতো আজ।

–না না, দরকার নেই বাবা ওসব। হাজার হোক, আমার পুরোনো মনিব। ওদের খেয়েই এতকাল মানুষ–হোটেলের কাজ শিখেছিও ওদের কাছে। শুধু রাঁধতে জানলে তো হোটেল চালানো যায় না বাবা, এ একটা ব্যবসা। কি করে হাট-বাজার করতে হয়, কি করে খদ্দের তুষ্ট করতে হয়, কি করে হিসেবপত্র রাখতে হয়–এও তো জানতে হবে। আমি দু’বছর ওদের ওখানে থেকে কেবল দেখতাম ওরা কি করে চালাচ্ছে। দেখে দেখে শেখা। এখন সব পারি।

বংশীর ভাগ্নে বলি–আচ্ছা মামীমা, খাওয়া দাওয়া করুন, আমি আসবো এখন ওবেলা।

হাজারি বালল–তুমি কাল দুপুরে হোটেলে খেও না–বাসাতে খাবে এখানে। বুঝলে?

বংশীর ভাগ্নে চলিয়া গেলে টেঁপির অনুপস্থিতিতে হাজারি বলিল–কেমন ছেলেটি দেখলে?

–বেশ ভাল। চমৎকার দেখতে।

–ওর সঙ্গে টেঁপির বেশ মানায় না?

–চমৎকার মানায়। তা কি আর হবে। আমাদের অদৃষ্টে কি অমন ছেলে জুটবে?

–জুটবে না কেন, জুটে আছে। ওকে আনিয়ে রেখেচি হোটেলে তবে কি জন্যে? তোমাদের রাণাঘাটের বাসায় আনলাম তবে কি জন্যে?…টেঁপিকে যেন এখন কিছু–বোঝ তো? কাল ওকে একটু যত্ন-আত্যি করো। আমার অনেক দিনের ইচ্ছে ওর সঙ্গে টেঁপির–তা এখন অনেকটা ভরসা পাচ্ছি। ওর বাপের অবস্থা বেশ ভাল, ছেলেটাও ম্যাট্রিক পাস। বিয়ে দিয়ে হোটেলেই বসিয়ে দেবো–থাক আমার অংশীদার হয়ে। কাজ শিখে নিক–টেঁপিও কাছেই রইল আমাদের–বুঝলে না, অনেক মতলব আছে।

টেঁপির মা বোকাসোকা মানুষ–অবাক হইয়া স্বামীর মুখের দিকে চাহিয়া তাহার কথা শুনিতে লাগিল।

.

সন্ধ্যার পরে খবর আসিল স্টেশনে বেচু চক্কত্তির হোটেলের লোকের সঙ্গে হাজারির চাকরে খরিদ্দার লইয়া মারামারি হইয়া গিয়াছে। হাজারির চাকর নাথনি বলিল–বাবু, ওদের হোটেলের চাকর খদ্দেরের হাত ধরে টানাটানি করে– আমাদের খদ্দের, আমাদের হোটেলে আসচে–তার হাত ধরে টানবে আর আমাদের হোটেলের নিন্দে করবে। তাই আমার সঙ্গে হাতাহাতি হয়ে গিয়েছে।

–খদ্দের কোথায় গেল?

–খদ্দের সেচে আমাদের এখানে। ওদের হোটেলের লোকের আমাদের ওপর আকচ আছে, আমরাই সব খদ্দের পাই, ওরা পায় না–এই নিয়েই ঝগড়া বাবু। ওদের হোটেলের হয়ে এল বাবু। একটা গাড়ীতেও খদ্দের পায় না।

রাত আটটার সময়ে হাজারি সবে মাছের ঝোল উনুনে চাপাইয়াছে, এমন সময় বংশী বলিল–হাজারি-দা, জবর খবর আছে। তোমার আগের কর্তা তোমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন কেন দেখে এসো গে। বোধ হয় মারামারি নিয়ে–

–ঝোলটা তুমি দেখো। আমি এসে মাংস চাপাবো–দেখি কি খবর।

অনেকদিন পরে হাজারি বেচু চক্কত্তির হোটেলের সেই গদির ঘরটিতে গিয়া দাঁড়াইল। সেই পুরোনো দিনের মনের ভাব সেই মুহূর্তেই তাহাকে পাইয়া বসিল যেন ঢুকিবার সঙ্গে সঙ্গেই। যেন সে রাঁধুনী বামুন, বেচু চক্কত্তি আজও মনিব।

বেচু চক্কত্তি তাহাকে দেখিয়া খাতির করিবার সুরে বলিলেন–আরে এস এস হাজারি এস–এখানে বসো।

বলিয়া গদির এক পাশে হাত দিয়া ঝাড়িয়া দিলেন, যদিও ঝড়িবার কোন আবশ্যক ছিল না। হাজারি দাঁড়াইয়াই রহিল। বলিল–না বাবু, আমি বসবো না। আমায় ডেকেচেন কেন?

–এসো, বসোই এসে আগে। বলচি।

হাজারি জিভ কাটিয়া বলিল–না বাবু, আপনি আমার মনিব ছিলেন এতদিন। আপনার সামনে কি বসতে পারি? বলুন, কি বলবেন–আমি ঠিক আছি।

হাজারির চোখ আপনা-আপনি খাওয়ার ঘরের দিকে গেল। হোটেলের অবস্থা সত্যই খুব খারাপ হইয়া গিয়াছে। রাত ন’টা বাজে, আগে আগে এসময় খরিদ্দারের ভিড়ে ঘরে জায়গা থাকিত না। আর এখন লোক কই? হোটেলের জলুসও আগের চেয়ে অনেক কমিয়া গিয়াছে।

বেচু চক্কত্তি বলিলেন–না, বোসো হাজারি। চা খাও, ওরে কাঙালী, চা নিয়ে আয় আমাদের।

হাজারি তবুও বসিতে চাহিল না। চাকর চা দিয়া গেল, হাজারি আড়ালে গিয়া চা খাইয়া আসিল।

বেচু চক্কত্তি দেখিয়া শুনিয়া খুব খুশি হইলেন। হাজারির মাথা ঘুরিয়া যায় নাই হঠাৎ অবস্থাপন্ন হইয়া। কারণ অবস্থাপন্ন যে হাজারি হইয়া উঠিয়াছে, তাহা তিনি এতদিন হোটেল চালানোর অভিজ্ঞতা হইতে বেশ বুঝিতে পারেন।

হাজারি বলিল–বাবু, আমায় কিছু বলচিলেন?

–হ্যাঁ-বলচিলাম কি জানো, এক জায়গায় ব্যবসা যখন আমাদের তখন তোমার সঙ্গে আমার কোন শত্রুতা নেই তো–তোমার চাকর আজ আমার চাকরকে মেরেছে ইস্টিশনে। এ কেমন কথা?

এই সময় পদ্মঝি দোরের কাছে আসিয়া দাঁড়াইল। হোটেলের চাকরও আসিল।

হাজারি বলিল–আমি তো শুনলাম বাবু আপনার চাকরটা আগে আমার চাকরকে মারে। নাথনি খদ্দের নিয়ে আসছিল এমন সময়–

পদ্মঝি বলিল–হ্যাঁ তাই বৈকি! তোমাদের নাথনি আমাদের খদ্দের ভাগাবার চেষ্টা করে–আমাদের হোটেলে আসছিল খদ্দের, তোমাদের হোটেলে যেতে চায় নি–

একথা বিশ্বাস করা যেন বেচু চক্কত্তির পক্ষেও শক্ত হইয়া উঠিল। তিনি বলিলেন–যাক, ও নিয়ে আর ঝগড়া করে কি হবে হাজারির সঙ্গে। হাজারি তো সেখানে ছিল না, দেখেও নি, তবে তোমায় বল্লাম হাজারি, যাতে আর এমন না হয়–

হাজারি বলিল–বাবু, বেশ আমি রাজী আছি। আপনার হোটেলের সঙ্গে আমার কোনো বিবাদ করলে চলবে না। আপনি আমার পুরোনো মনিব। আসুন, আমরা গাড়ী ভাগ করে নিই। আপনি যে গাড়ীর সময় ইস্টিশানে চাকর পাঠাবেন, আমার হোটেলের চাকর সে সময় যাবে না।

বেচু চক্কত্তি বিস্মিত হইলেন। ব্যবসা জিনিসটাই রেষারেষির উপর, আড়াআড়ির উপর চলে–তিনি বেশ ভালই জানেন। মাথার চুল পাকাইয়া ফেলিলেন তিনি এই ব্যবসা করিয়া। এস্থলে হাজারির প্রস্তাব যে কতদূর উদার, তাহা বুঝিতে বেচুর বিলম্ব হইল না। তিনি আমতা আমতা করিয়া বলিলেন–না তা কেন, ইস্টিশান তো আমার একলার নয়–

–না বাবু, এখন থেকে তাই রইল। মুর্শিদাবাদ আর বনগাঁর গাড়ীর মধ্যে আপনি কি নেবেন বলুন মুর্শিদাবাদ চান, না বনগাঁ চান? আমি সে সময় চাকর পাঠাবো না ইস্টিশানে।

পদ্মঝি দোর হইতে সরিয়া গেল।

বেচু চক্কত্তি বলিলেন–তা তুমি যেমন বলো। মুর্শিদাবাদখানাই তবে রাখো আমার। তা আর একটু চা খেয়ে যাবে না?–আচ্ছা, এসো তবে।

হাজারি মনিবকে প্রণাম করিয়া চলিয়া আসিল।

পদ্মঝি পুনরায় দোরের কাছে আসিয়া জিজ্ঞাসা করিল—হাঁ বাবু, কি বলে গেল?

–গাড়ী ভাগ করে নিয়ে গেল। মুর্শিদাবাদখানা আমি রেখেছি। যা কিছু লোক আসে, মুর্শিদাবাদ থেকেই আসে–বনগাঁর গাড়ীতে কটা লোক আসে? লোকটা বোকা, লোক মন্দ নয়। দুষ্টু নয়।

–আমি আজ সাত বছর দেখে আসছি আমি জানিনে? গাঁজা খেয়ে বুঁদ হয়ে থাকে, হোটেলের ছাই দেখাশুনো করে। রেঁধেই মরে, মজা লুটচে বংশী আর বংশীর ভাগ্নে। ক্যাশ তার হাতে। আমি সব খবর নিইচি তলায় তলায়। বংশীকে আবার এখানে আনুন বাবু, ও হোটেল এক দিনে ভুস্যিনাশ হয়ে বসে রয়েচে। বংশীকে ভাঙাবার লোক লাগান আপনি–আর ওর ভাগ্নেটাকেও—

.

পরদিন দুপুরে বংশীর ভাগ্নে সসঙ্কোচে হাজারির বাসায় নিমন্ত্রণ রক্ষা করিতে আসিল। হাজারি হোটেল হইতে তাহাকে পাঠাইয়া দিল বটে, কিন্তু নিজে তখন আসিতে পারিল না, অত্যন্ত ভিড় লাগিয়াছে খরিদ্দারের, কারণ সেদিন হাটবার।

মায়ের আদেশে টেঁপিকে অতিথির সামনে অনেকবার বাহির হইতে হইল। কখনও বা আসন পাতা, কখনও জলের গ্লাসে জল দেওয়া ইত্যাদি। টেঁপি খুব চটপটে চালাকচতুর মেয়ে, অতসীর শিষ্যা–কিন্তু হঠাৎ তাও কেমন যেন একটু লজ্জা করিতে লাগিল এই সুন্দর ছেলেটির সামনে বার বার বাহির হইতে।

বংশীর ভাগ্নেটিও একটু বিস্মিত হইল। হাজারি-মামারা পাড়াগাঁয়ের লোক সে জানে– অবস্থাও এতদিন বিশেষ ভাল ছিল না। আজই না হয় হোটেলের ব্যবসায়ে দু-পয়সার মুখ দেখিতেছে। কিন্তু হাজারি-মামার মেয়ে তো বেশ দেখিতে, তাহার উপর তার চালচলন ধরন-ধারণ যেন স্কুলে পড়া আধুনিক মেয়েছেলের মত। সে কাপড় গুছাইয়া পরিতে জানে, সাজিতে গুজিতে জানে, তার কথাবার্তার ভঙ্গিটাও বড় চমৎকার।

তাহার খাওয়া প্রায় শেষ হইয়াছে এমন সময় হাজারি আসিল। বলিল–খাওয়া হয়েছে বাবা, আমি আসতে পারলাম না–আজ আবার ভিড় বড্ড বেশী।

–ও টেঁপি আমায় একটু তেল দে মা, নেয়ে নিই, আর তোর ঐ দাদার শোওয়ার জায়গা করে দে দিকি–-পাশের ঘরটাতে একটু গড়িয়ে নাও বাবা।

বংশীর ভাগ্নে গিয়া শুইয়াছে–এমন সময় টেঁপি পান দিতে আসিল। পানের ডিবা নাই, একখানা ছোট রেকাবিতে পান আনিয়াছে। ছেলেটি দেখিল চুন নাই রেকাবিতে। লাজুক মুখে বলিল–একটু চুন দিয়ে যাবেন?

টেঁপির সারা দেহ লজ্জার আনন্দে কেমন যেন শিহরিয়া উঠিল। তাহার প্রথম কারণ তাহার প্রতি সম্ভ্রমসূচক ক্রিয়াপদের ব্যবহার এই হইল প্রথম। জীবনে ইতিপূর্বে তাহাকে কেহ ‘আপনি’ ‘আজ্ঞে’ করিয়া কথা বলে নাই। দ্বিতীয়ত: কোনও অনাত্মীয় তরুণ যুবকও তাহার সহিত ইতিপূৰ্ব্বে কথা বলে নাই। বলে নাই কি একেবারে! গাঁয়ের রামু-দা, গোপাল-দা, জহর-দা-ইহারাও তাহার সঙ্গে তো কথা বলিত! কিন্তু তাহাতে এমন আনন্দ তাহার হয় নাই তো কোনোদিন? চুন আনিয়া রেকাবিতে রাখিয়া বলিল–এতে হবে?

–খুব হবে। থাক ওখানেই–ইয়ে, এক গেলাস জল দিয়ে যাবেন?

টেঁপির বেশ লাগিল ছেলেটিকে। কথাবার্তার ধরন যেমন ভাল, গলার সুরটিও তেমনি মিষ্ট। যখন জলের গ্লাস আনিল, তখন ইচ্ছা হইতেছিল ছেলেটি তাহার সঙ্গে আর একবার কিছু বলে। কিন্তু ছেলেটি এবার আর কিছু বলল না। টেঁপি জলের গ্লাস নামাইয়া রাখিয়া চলিয়া গেল।

বেলা যখন প্রায় পাঁচটা, বৈকাল অনেক দূর গড়াইয়া গিয়াছে –টেঁপি তখন একবার উঁকি মারিয়া দেখিল, ছেলেটি অঘোরে ঘুমাইতেছে।

হঠাৎ টেঁপির কেমন একটা অহেতুক স্নেহ আসিল ছেলেটির প্রতি।

আহা, হোটেলে কত রাত পর্যন্ত জাগে। ভাল ঘুম হয় না রাত্রে!

টেঁপি আসিয়া মাকে বলিল–মা সেই লোকটা এখনও ঘুমুচ্ছে। ডেকে দেবো, না ঘুমুবে।

টেঁপির মা বলিল–ঘুমুচ্ছে ঘুমুক না। ডাকবার দরকার কি? চাকরটা কোথায় গেল? ঘুম থেকে উঠলে ওকে কিছু খেতে দিতে হবে। খাবার আনতে দিতাম। উনিও তো বাড়ী নেই।

টেঁপি বলিল–লোকটা চা খায় কিনা জানিনে, তাহলে ঘুম থেকে উঠলে একটু চা করে দিতে পারলে ভাল হোত।

টেঁপির মা চা নিজে কখনো খায় নাই, করিতেও জানে না। আধুনিকা মেয়ের এ প্রস্তাব তাহার মন্দ লাগিল না।

মেয়েকে বলিল–তুই করে দিতে পারবি তো?

মেয়ে খিল খিল করিয়া হাসিয়া বলিল–তুমি যে কি বল মা, হেসে প্রাণ বেরিয়ে যায়– পরে কেমন একটি অপূৰ্ব ভঙ্গিতে হাত নাড়িয়া নাড়িয়া হাসিভরা মুখের চিবুকখানি বার বার উঠাইয়া-নামাইয়া বলিতে লাগিল–চা কই? চিনি কই? কেটলি কই? চায়ের জল ফুটবে কিসে? ডিস-পেয়ালা কই? সে সব আছে কিছু?

টেঁপির মায়ের বড় ভাল লাগিল টেঁপির এই ভঙ্গি। সে সস্নেহে মুগ্ধদৃষ্টিতে মেয়ের দিকে হাঁ করিয়া চাহিয়া রহিল। এমন ভাবে এমন সুন্দর ভঙ্গিতে কথা টেঁপি আর কখনও বলে নাই।

এই সময় হাজারি বাড়ীর মধ্যে ঢুকিল, হোটেলেই ছিল। বলিল–নরেন কোথায়? ঘুমুচ্ছে নাকি?

টেঁপির মা বলিল–তুমি এতক্ষণ ছিলে কোথায়? ওকে একটু খাবার আনিয়ে দিতে হবে। আর টেঁপি বলছে চা করে দিলে হোত।

হাজারির বড় স্নেহ হইল টেঁপির উপর। সে না জানিয়া যাহাকে আজ যত্ন করিয়া চা খাওয়াইতে চাহিতেছে, তাহারই সঙ্গে তার বাবা-মা যে বিবাহের ষড়যন্ত্র করিতেছে–বেচারী কি জানে?

বলিল–আমি সব এনে দিচ্ছি। হোটেলেই আছে। হোটেলে বড় ব্যস্ত আছি, কলকাতা থেকে দশ-বারো জন বাবু এসেছে শিকার করতে। ওর। অনেকদিন আগে একবার এসে আমার রান্না মাংস খেয়ে খুব খুশি হয়েছিল। সেই আগের হোটেলে গিয়েছিল, সেখানে নেই শুনে খুঁজে খুঁজে এখানে এসেছে। ওরা রাত্রে মাংস আর পোলাও খাবে। তোমরা এবেলা রান্না কোরো না–আমি হোটেল থেকে আলাদা করে পাঠিয়ে দেবো এখন। নরেনকে যে একবার দরকার, বাবুদের সঙ্গে ইংরিজিতে কথাবার্তা কইতে হবে, সে তো আমি পারবো না, নরেনকে ওঠাই দাঁড়াও–

টেঁপির মা বলিল–ঘুম থেকে উঠিয়ে কিছু না খাইয়ে ছাড়া ভাল দেখায় না। টেঁপি চায়ের কথা বলচিল–তা হোলে সেগুলো আগে পাঠিয়ে দেওগে, এখন জাগিও না।

.

বৈকালের দিকে নরেন ঘুম ভাঙিয়া উঠিল। অত্যন্ত বেলা গিয়াছে, পাঁচিলের ধারে সজনে গাছটার গায়ে রোদ হলদে হইয়া আসিয়াছে। নরেনের লজ্জা হইল– পরের বাড়ী কি ঘুমটাই ঘুমাইয়াছে। কে কি–বিশেষ করিয়া হাজারি-মামার মেয়েটি কি মনে করিল। বেশ মেয়েটি। হাজারি-মামার মেয়ে যে এমন চালাক-চতুর, চটপটে, এমন দেখিতে, এমন কাপড়-চোপড় পরিতে জানে তাহা কে ভাবিয়া ছিল?

অপ্রতিভ মুখে সে গায়ে জামা পরিয়া বাহির হইবার উদ্যোগ করিতেছে, এমন সময় টেঁপি আসিয়া বলিল–আপনি উঠেছেন? মুখ ধোবার জল দেবো?

নরেন থতমত খাইয়া বলিল–না, না, থাক আমি হোটেলেই–

–মা বললে আপনি চা খেয়ে যাবেন, আমি মাকে বলে আসি—

ইতিমধ্যে হাজারি চায়ের আসবাব হোটেলের চাকর দিয়া পাঠাইয়া দিয়াছিল, টেঁপি নিজেই চা করিতে বসিয়া গেল। তাহার মা জলখাবারের জন্য ফল কাটিতে লাগিল।

টেঁপি বলিল–মা চায়ের সঙ্গে শসা-টসা দেয় না। তুমি বরং ঐ নিমকি আর রসগোল্লা দাও রেকাবিতে–

–শসা দেয় না? একটা ডাব কাটবো? বাড়ীর ভাব আছে—

টেঁপি হাসিতে হাসিতে গড়াইয়া পড়ে আর কি। মুখে আঁচল চাপা দিয়া বলিল–হি হি, তুমি মা যে কি!…চায়ের সঙ্গে বুঝি ডাব খায়?

টেঁপির মা অপ্রসন্ন মুখে বলিল–কি জানি তোদের একেলে ঢং কিছু বুঝিনে বাপু। যা বোঝো তাই করো। ঘুম থেকে উঠলে তো নতুন জামাইদের ডাব দিতে দেখেছি চিরকাল দেশেঘরে-

কথাটা বলিয়া ফেলিয়াই টেঁপির মা মনে মনে জিভ কাটিয়া চুপ করিয়া গেল। মানুষটা একটু বোকা ধরনের, কি ভাবিয়া কি বলে, সব সময় তলাইয়া দেখিতে জানে না।

টেঁপি আশ্চর্য্য হইয়া বলিল–নতুন জামাই? কে নতুন জামাই?

–ও কিছু না; দেশে দেখেছি তাই বলচি। তুই নে, চা করা হোল?

টেঁপির মনে কেমন যেন খটকা লাগিল। সে খুব বুদ্ধিমতী, তাহার উপর নিতান্ত ছেলে মানুষটিও নয়, যখন চা ও খাবার লইয়া পুনরায় ছেলেটির সামনে গেল তখন তাহার কি জানি কেন যে লজ্জা করিতেছে তাহা সে নিজেই ভাল ধরিতে পারিল না।

ছেলেটি তাহাকে দেখিয়া বলিল–ও কি! এই এত খাবার কেন এখন, চা একটু হোলেই–

টেঁপি কোনো রকমে খাবারের রেকাবি লোকটার সামনে রাখিয়া পলাইয়া আসিলে যেন বাঁচে।

ছেলেটি ডাকিয়া বলিল–পান একটা যদি দিয়ে যান—

পান সাজিতে বসিয়া টেঁপি ভাবিল–বাবা খাটিয়ে মারলে আমায়! চা দেও–পান সাজো–আমার যেন যত গরজ পড়েছে, বাবার হোটেলের লোক তা আমার কি?

টেঁপি একটা চায়ের পিরিচে পান রাখিয়া দিতে গেল। ছেলেটি দেখিতে বেশ কিন্তু। কথাবার্তা বেশ, হাসি-হাসি মুখ। কি কাজ করে হোটেলে কে জানে?

পান লইয়া ছেলেটি চলিয়া গেল। যাইবার সময় বলিয়া গেল–মামীমা আমি যাচ্ছি, কষ্ট দিয়ে গেলাম অনেক, কিছু মনে করবেন না। এত ঘুমিয়েছি, বেলা আর নেই আজ।

বেশ ছেলেটি।

নতুন জামাই? কে নতুন জামাই? কাহাদের নতুন জামাই?

মা এক-একটা কথা বলে কি যে, তার মানে হয় না।

.

টেঁপির মা কখনও এত বড় শহর দেখে নাই।

এখানকার কাণ্ডকারখানা দেখিয়া সে অবাক হইয়া গিয়াছে। মোটর গাড়ী, ঘোড়ার গাড়ী, ইস্টিশানে বিদ্যুতের আলো, লোকজনই বা কত! আর তাদের এঁড়োশোলায় দিনমানেই শেয়াল তাকে বাড়ীর পিছনকার ঘন বাঁশবনে। সেদিন তো দিনদুপুরে জেলেপাড়ার কেষ্ট জেলের তিন মাসের ছেলেকে শেয়ালে লইয়া গেল।

ইতিমধ্যে কুসুম আসিয়া একদিন উহাদের বেড়াইতে লইয়া গেল। কুসুমের সঙ্গে তাহার রাধাবল্পভতলা, সিদ্ধেশ্বরীতলা, চূর্ণীর ঘাট, পালচৌধুরীদের বাড়ী–সব ঘুরিয়া ঘুরিয়া দেখিল। পালচৌধুরীদের প্রকাণ্ড বাড়ী দেখিয়া টেঁপির মা ও টেঁপি দু-জনেই অবাক। এত বড় বাড়ী জীবনে তাহারা দেখে নাই। অতসীদের বাড়ীটাই এতদিন বড়লোকের বাড়ীর চরম নিদর্শন বলিয়া ভাবিয়া আসিয়াছে যাহারা, তাহাদের পক্ষে অবাক হইবার কথা বটে।

টেঁপির মা বলিল–না, শহর জায়গা বটে কুসুম! গায়ে গায়ে বাড়ী আর সব কোঠাবাড়ী এদেশে। সবাই বড়লোক। ছেলেমেয়েদের কি চেহারা, দেখে চোখ জুড়ায়। হাঁরে, এদের বাড়ী ঠাকুর হয় না? পুজোর সময় একদিন আমাদের এনো মা, ঠাকুর দেখে যাবো।

সে আর ইহার বেশী কিছুই বোঝে না।

একটা বাড়ীর সামনে কত কি বড় বড় ছবি টাঙানো, লোকজন ঢুকিতেছে, রাস্তার ধারে কি কাগজ বিলি করিতেছে। টেঁপির মনে হইল এই বোধ হয় সেই টকি যাকে বলে, তাহাই। কুসুমকে বলিল–কুসুম দি, এই টকি না?

–হ্যাঁ দিদি। একদিন দেখবে?

-–এক দিন এনো না আমাদের। মা-ও কখনো দেখে নি–সবাই আসবো।

একখানা ধাবমান মোটর গাড়ীর দিকে টেঁপির মা হাঁ করিয়া চাহিয়া দেখিতে লাগিল, যতক্ষণ সেখানা রাস্তার মোড় ঘুরিয়া অদৃশ্য না হইয়া গেল।

কুসুম বলিল–আমার বাড়ী একটু পায়ের ধূলো দিন এবার জ্যাঠাইমা

কুসুমের বাড়ী যাইতে পথের ধারে রেলের লাইন পড়ে। টেঁপির মা বলিল–কুসুম, দাঁড়া মা একখানা রেলের গাড়ী দেখে যাই–

বলিতে বলিতে একখানা প্রকাণ্ড-মালগাড়ী আসিয়া হাজির। টেঁপি ও টেঁপির মা দুজনেই একদৃষ্টে দেখিতে লাগিল। গাড়ী চলিয়াছে তো চলিয়াছে–তাহার আর শেষ নাই।

উঃ, কি বড় গাড়ীটা!

কুসুম বলিল–জ্যাঠাইমা, রাণাঘাট ভাল লাগছে?

-লাগচে বৈকি, বেশ জায়গা মা।

আসলে কিন্তু এঁড়োশোলার জন্য টেঁপির মায়ের মন কেমন করে। শহরে নিজেকে সে এখনও খাপ খাওয়াইতে পারে নাই। সেখানকার তালপুকুরের ঘাট, সদা বোষ্টমের বাড়ীর পাশ দিয়া যে ছোট নিভৃত পথটি বাঁশবনের মধ্য দিয়া বাঁড়ুয্যে-পাড়ার দিকে গিয়াছে, দুপুর বেলা তাহাদের বাড়ীর কাছে বড় শিরীষ গাছটায় এই সময় শিরীষের সুঁটি শুকাইয়া ঝুন ঝুন শব্দ করে, তাহাদের উঠানের বড় লাউমাচায় এতদিন কত লাউ ফলিয়াছে, পেঁপে গাছটায় কত পেঁপের ফুল ও জালি দেখিয়া আসিয়াছিল–সে সবের জন্য মন কেমন করে বৈকি।

তবে এখানে যাহা সে পাইয়াছে টেঁপির মা জীবনে সে রকম সুখের মুখ দেখে নাই। চাকরের ওপর হুকুম চালাইয়া কাজ করাইয়া লওয়া, সকলে মানে, খাতির করে–অমন সুন্দর ছেলেটি তাহাদের হোটেলের মূহুরী– এ ধরনের ব্যাপারে কল্পনাও কখনও সে করিয়াছিল?

কুমের বাড়ী সকলে গিয়া পৌঁছিল। কুসুম ভারি খুশি হইয়া উঠিয়াছে–তাহার বাপের বাড়ী দেশের ব্রাহ্মণ-পরিবারকে এখানে পাইয়া। কুসুমের শাশুড়ী আসিয়া টেঁপির মায়ের পায়ের ধূলা লইয়া প্রণাম করিয়া বলিল–আমাদের বড্ড ভাগ্যি মা, আপনাদের চরণ-ধূলো পড়লো এ বাড়ীতে।

টেঁপির মাকে এত খাতির কবিয়া কেহ কখনো কথা বলে নাই–এত সুখও তাহার কপালে লেখা ছিল! হায় মা ঝিটকিপোতার বনবিবি, কি জাগ্রত দেবতাই তুমি! সেবার ঝিটকিপোতায় চৈত্র মাসে মেলায় গিয়া টেঁপির মা বনবিবিতলায় স-পাঁচ আনার সিন্নি দিয়া স্বামীপুত্রের মঙ্গলকামনা করিয়াছিল, এখনও যে বছর পার হয় নাই! তবুও লোকে ঠাকুর দেবতা মানিতে চায় না।

কুসুম সকলকে জলযোগ করাইল। পান সাজিয়া দিল। কুসুমের শাশুড়ী আসিয়া কতক্ষণ গল্পগুজব করিল। কুসুম গ্রামের কথাই কেবল শুনিতে চায়। কতদিন বাপের বাড়ী যায় নাই, বাবা-মা মরিয়া গিয়াছে, জ্যাঠামশায় আছে, কাকারা আছে–তাহারা কোনো দিন খোঁজও নেয় না। খোঁজ করিত অবশ্যই, যদি তাহার নিজের অবস্থা ভাল হইত। গরীব লোকের আদর কে করে?…এই সব অনেক দুঃখ কৰিল। আরও কিছুক্ষণ বসিবার পরে কুসুম উহাদের বাসায় পৌঁছিয়া দিয়া গেল।

দিন দুই পরে একদিন সকালে পদ্মঝি বলিল–ও ঠাকুর, শুনে রাখো, আজ কোথাও যেও না সব ছুটির পরে। আজ ও-বেলা সত্যনারায়ণের সিন্নি–খদ্দেরদের ভাত দেবার সময় বলে দিও ও-বেলা যেন থাকে–আর তোমরা খেয়ে-দেয়ে আমার সঙ্গে বেরুবে সত্যনারায়ণের বাজার করতে।

বংশী ঠাকুর হাজারির দিকে চাহিয়া হাসিল–অবশ্য পদ্মঝি চলিয়া গেলে।

ব্যাপারটা এই, হোটেলের এই যে সত্যনারায়ণের পূজা, ইহা ইহাদের একটি ব্যবসা। যাহারা মাসিক হিসাবে হোটেলে খায় তাহাদের নিকট হইতে পূজার নাম করিয়া চাঁদা বা প্রণামী আদায় হয়। আদায়ী টাকার সব অংশ ব্যয় করা হয় না বলিয়াই হাজারি বা বংশীর ধারণা। অথচ, সত্যনারায়ণের প্রসাদের লোভ দেখাইয়া দৈনিক নগদ খরিদ্দার যাহারা তাহাদেরও রাত্রে আনিবার চেষ্টা করা হয়–কারণ এমন অনেক নগদ খরিদ্দার আছে, যাহারা একবেলা হোটেলে খাইয়া যায়, দু-বেলা আসে না।

বংশী ঠাকুর পরিবেশনের সময় প্রত্যেক ঠিকা খরিদ্দারকে মোলায়েম হাসি হাসিয়া বলিতে লাগি—আজ্ঞে বাবু, ও-বেলা সত্যনারাণ হবে হোটেলে, আসবেন ও-বেলা–অবিশ্যি করে আসবেন–

বাহিরে গদির ধরে বেচু চক্কত্তিও খরিদ্দারদিগকে ঠিক অমনি বলিতে লাগিল।

বংশী ঠাকুর হাজারিকে আড়ালে বলিল–সব ফাঁকির কাজ, এক চিলতে কলার পাতার আগায় এক হাত করে গুড় গোলা আটা আর তার ওপর দুখানা বাতাসা–হয়ে গেল এর নাম তোমার সত্যনারাণের সিন্নি। চামার কোথাকার–

সন্ধ্যার সময় পূর্ণ ভটচাজ সত্যনারায়ণের পূজা করিতে আসিলেন। বাসনের ঘরে সত্য নারায়ণের পিঁড়ি পাতা হইয়াছে। হোটেলের দুই চার মিলিয়া ঘড়ি ও কাঁসর পিটাইতেছে, পদ্মঝি ঘন ঘন শাঁকে ফুঁ পাড়িতেছে–খানিকটা খরিদ্দার আকৃষ্ট করিবার চেষ্টাতেও বটে।

স্টেশনে যে চাকর ‘হি-ই-ই-ন্দু হো-টে-ল-ল’ বলিয়া চেঁচায়, তাহাকেও বলিয়া দেওয়া হইয়াছে, সে যাত্রীদের প্রত্যেককে বলিতেছে–‘আসুন বাবু, সিমি পেশাদ হচ্চেন হোটেলে, খাওয়ার বড্ড জুৎ আজগে–আসুন বাবু–’

যাহারা নগদ পয়সার খরিদ্দার, তাহারা ভাবিতেছে–অন্য হোটেলেও তো পয়সা দিয়া খাইবে যখন তখন সত্যনারায়ণের প্রসাদ ফাউ যদি পাওয়া যায়, বেচু চকত্তির হোটেলেই যাওয়া যাক না কেন। ফলে যদু বাঁড়ুয্যের হোটেলের দৈনিক নগদ খরিদ্দার যাহারা, তাহারাও অনেকে আসিয়া জুটিতেছে এই হোটেলে। এদিকে নগদ খরিদ্দারদের জন্য ব্যবস্থা এই যে, তাহাদের সিন্নি খাইতে দেওয়া হইবে ভাতের পাতে অর্থাৎ টিকিট কিনিয়া ভাত খাইতে ঢুকিলে তবে। নতুবা সিন্নিটুকু খাইয়া লইয়াই যদি খরিদ্দার পালায়?

মাসিক খরিদ্দারের জন্য অন্য প্রকার ব্যবস্থা। তাঁহারা চাঁদা দিয়াছে, বিশেষতঃ তাহাদের খাতির করাও দরকার। পূজা সাঙ্গ হইলে তাহাদের সকলকে একত্র বসাইয়া প্রাসাদ খাইতে দেওয়া হইল–বেচু চক্কত্তি নিজে প্রত্যেকের কাছে গিয়া জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন তাহারা আর একটু করিয়া প্রসাদ লইবে কি না।

যখন ওদিকে মাসিক খরিদ্দাগণকে সিন্নি বিতরণ করা হইতেছে, সে সময় হাজারি দেখিল রাস্তার উপর যতীন মজুমদার দাঁড়াইয়া হাঁ করিয়া তাহাদের হোটেলের দিকে চাহিয়া আছে। সেই যতীন…

হাজারির মনে হইল লোকটার অবস্থা আরও খারাপ হইয়া গিয়াছে, কেমন যেন অনাহার-শীর্ণ চেহারা। সে ডাকিয়া বলিল–ও যতীনবাবু, কেমন আছেন?

যতীন মজুমদার অবাক হইয়া বলিল–কে হাজারি নাকি? তুমি আবার কবে এলে এখানে।

–সে অনেক কথা বলবো এখন। আসুন না—আসুন—

যতীন ইতস্ততঃ করিয়া রান্নাঘরের পাশে বেড়ার গায়ের দরজা দিয়া হোটেলে ঢুকিয়া রান্নাঘরের দোরে আসিয়া দাঁড়াইল।

হাজারি দেখিল তাহার পায়ে জুতা নাই, গায়ে অতি মলিন উড়ানি, পরনের ধুতিখানিও তদ্রূপ। আগের চেয়ে রোগাও হইয়া গিয়াছে লোকটা। দারিদ্র্য ও অভাবের ছাপ চোখে মুখে বেশ পরিস্ফূট।

যতীন কাষ্ঠহাসি হাসিয়া বলিল–আরে, তোমাদের এখানে বুঝি সত্যনারায়ণ হচ্চে আজগে? আগে আমিও কত এসেছি খেয়েছি–

–তা খাবেন না? আপনি তো ছিলেন বারোমাসের বাঁধা খদ্দের–তা আসুন পেরসাদ খেয়ে যান–

যতীন ভদ্ৰতা করিয়া বলিল–না না, থাক থাক–তার জন্যে আর কি হয়েচে–

হাজারি একবার এদিক ওদিক চাহিয়া দেখিল কেহ কোনোদিকে নাই। সবাই খাবার ঘরে মাসিক খরিদ্দারের আদর আপ্যায়ন করিতে ব্যস্ত–সে কলার পাত পাতিয়া যতীনকে বসাইল এবং পাশে বাসনের ঘর হইতে বড় বাটির একবাটি সত্যনারায়ণের সিন্নি, একমুঠা বাতাসা ও দুটি পাকা কলা আনিয়া যতীনের পাতে দিয়া বলিল–একটু পেরসাদ খেয়ে নিন–

যতীন মজুমদার দ্বিরুক্তি না করিয়া সিন্নির সহিত কলাদুটি চটকাইয়া মাখিয়া লইয়া যেভাবে গোগ্রাসে গিলিতে লাগিল, তাহাতে হাজারিরও মনে হইল লোকটা সত্যই যথেষ্ট ক্ষুধার্ত ছিল, বোধ হয় ওবেলা আহার জোটে নাই। তিন চার গ্রাসে অতখানি সিন্নি সে নিঃশেষে উড়াইয়া দিল।

হাজারি বলিল–আর একটু নেবেন?

যতীন পূর্বের মত ভদ্রতার সুরে বলিল–না না, থাক থাক আর কেন–

হাজারি আরও এক বাটি সিন্নি আনিয়া পাতে ঢালিয়া দিতে যতীনের মুখচোখ যেন উজ্জল হইয়া উঠিল।

তাহার খাওয়া অর্ধেক হয়েছে এমন সময় পদ্মঝি রান্নাঘরের দোরে আসিয়া হাজারিকে কি একটা বলতে গেল এবং গোগ্রাসে ভোজনরত যতীন মজুমদারকে দেখিয়া হঠাৎ থমকিয়া দাঁড়াইল বলিল–ও কে?

হাজারি হাসিয়া বলিল–ও যতীনবাবু, চিনতে পাচ্ছ না পদ্মদিদি? আমাদের পুরোনো বাবু। যাচ্ছিলেন রাস্তা দিয়ে, তা আমি বল্লাম আজ পুজোর দিনটা একটু পেরসাদ পেয়ে যান বাবু–

পদ্মঝি বলিল—বেশ–বলিয়াই সে ফিরিয়া আবার গিয়া মাসিক খরিদ্দারদের খাবার ঘরে ঢুকিল।

যতীন ততক্ষণ পদ্মঝিকে কি একটা কথা বলিতে যাইতেছিল, কিন্তু সে কথা বলিবার সুযোগ ঘটিল না তাহার। সে খাওয়া শেষ করিয়া এক ঘটি জল চাহিয়া লইয়া খাইয়া চোরের মত খিড়কি দরজা দিয়া বাহির হইয়া গেল।

অল্পক্ষণ পরেই গোবরা চাকর আসিয়া বলিল–ঠাকুর, কৰ্ত্তা তোমাকে ডাকছেন—

হাজারি বুঝিয়াছিল কর্তা কি জন্য তাহাকে জরুরী তলব দিয়াছেন। সে গিয়া বুঝিল তাহার অনুমান সত্য–কারণ পদ্মঝি মুখ ভার করিয়া গদির ঘরে বেচু চক্কত্তির সামনে দাঁড়াইয়া। বেচু চক্কত্তি বললেন–হাজারি, তুমি যতনেটাকে হোটেলে ঢুকিয়ে তাকে বসিয়ে সিন্নি খাওয়াচ্ছিলে?

পদ্মঝি হাত নাড়িয়া বলিল–আর খাওয়ানো বলে খাওয়ানো! এক এক গামলা সিন্নি দিয়েছে তার পাতে–ইচ্ছে ছিল নুকিয়ে খাওয়াবে, ধর্মের ঢাক বাতাসে নড়ে, আমি গিয়ে পড়েছি সেই সময় বড় ডেক নামলো কি না তাই দেখতে–আমায় দেখে–

হাজারি বিনীত ভাবে বলিল–সত্যনারাণের পেশাদ বলেই বাবু দিয়েছিলাম–আমাদের পুরোনো খদ্দের–

বেচু চক্কত্তি দাঁত খিঁচাইয়া বলিলেন–পুরোনো খদ্দের? ভারি আমার পুরোনো খদ্দের রে? হোটেলের একটি মুঠো টাকা ফাঁকি দিয়ে চলে গিয়েছে, ভারি খদ্দের আমার! চার মাস বিনি পয়সায় খেয়ে গেল একটি আধলা উপুড়-হাত করলে না, পয়লা নম্বরের জুয়াচার কোথাকার-খদ্দের! তুমি কার হুকুমে তাকে হোটেলে ঢুকতে দিলে শুনি?

পদ্মঝি বলিল–আমি কোনো কথা বল্লেই তো পদ্ম বড় মন্দ। এই হাজারি ঠাকুর কি কম শয়তান নাকি–বাবু? আপনি জানেন না সব কথা, সব কথা আপনার কানে তুলতেও আমার ইচ্ছে করে না। নুকিয়ে নুকিয়ে হোটেলের আদ্ধেক জিনিস ওঠে ওর এয়ার বকশীদের বাড়ী। যতনে ঠাকুর ওর এয়ার, বুঝলেন না আপনি? বহাল করেন লোক, তখন আমি কেউ নই– কিন্তু হাতে হাতে ধরে দেবার বেলা এই জনা না হোলেও দেখি চলে না–এই দেখুন আবার চুরি-চামারি শুরু যদি না হয় হোটেলে, তবে আমার নাম–

বেচু চক্কত্তি বলিলেন–এটা তোমার নিজের হোটেল নয় যে তুমি হাজারি ঠাকুর এখানে যা খুশি করবে। নিজের মত এখানে খাটালে চলবে না জেনো। তোমার আট আনা জরিমানা হোল।

হাজারি বলিল–বেশ বাবু, আপনার বিচারে যদি তাই হয়, করুন জরিমানা। তবে যতীন বাবু আমার এয়ারও নয় বা সে সব কিছুই নয়। এই হোটেলেই ওঁর সঙ্গে আমার আলাপ–ওঁকে দেখিনিও কতদিন। পদ্মদিদি অনেক অনেয্য কথা লাগায় আপনার কাছে–আমি আসছে মাস থেকে আর এখানে চাকরি করবো না।

পদ্মঝি এ কথায় অনর্থ বাধাইল। হাত পা নাড়িয়া চীৎকার করিয়া বলিল–লাগায়? লাগায় তোমার নামে? তুমি যে বড় লাগাবার যুগ্যি লোক। তাই পদ্ম লাগিয়ে লাগিয়ে বেড়াচ্ছে তোমার নামে। যত বড় মুখ নয় তত বড় কথা। তোমার মত লোককে পদ্ম গেরায্যির মধ্যে আনে না তা তুমি ভাল করে বুঝো ঠাকুর। যাও না, তুমি আজই চলে যাও। সামনের মাসে কেন, মাইনেপত্তর চুকিয়ে আজই বিদেয় হও না–তোমার মত ঠাকুর রেল-বাজারে গণ্ডায় গণ্ডায় মিলবে–

বেচু চক্কত্তি বলিলেন–চুপ চুপ পদ্ম, চুপ করো। খদ্দেরপত্র আসচে যাচ্চে, ওকথা এখন থাক। পরে হবে–আচ্ছা তুমি যাও এখন হাজারি ঠাকুর–

অনেক রাতে হোটেলের কাজ মিটিল।

শুইবার সময় হাজারি বংশীকে বলিল–দেখলে তো কি রকম অপমানটা আমার করলে পলদিদি? তুমিও ছাড়, চল দুজনে বেরিয়ে যাই। দ্যাখো একটা কথা বংশী, এই হোটেলের ওপর কেমন একটা মায়া পড়ে গিয়েছিল, মুখে বলি বটে যাই যাই–কিন্তু যেতে মন সরে না। কতকাল ধরে তুমি আর আমি এখানে আছি ভেবে দ্যাখো তো? এ যেন আপনার ঘর বাড়ী হয়ে গিয়েছে–তাই না? কিন্তু এরা–বিশেষ করে পদ্মদিদি এখানে টিকতে দিলে না–এবার সত্যিই যাবো।

বংশী বলিল–ষতীনকে তুমি ডেকে দিলে না ও আপনি এসেছিল?

–আমি ডেকেছিলাম। ওর অবস্থা খারাপ হয়ে গিয়েচে, আজকাল খেতেই পায় না। তাই ডাকলাম। বলি পুরোনো খদ্দের তো, কত লোক খেয়ে যাচ্চে, ও একটু সিন্নি খেয়ে যাক। এই তো আমার অপরাধ।

.

পরের মাসের শুভ পয়লা তারিখে রেলবাজারে গোপাল ঘোষের তামাকের দোকানের পাশেই নূতন হোটেলটা খুলিল! টিনের সাইনবোর্ড লেখা আছে—

আদর্শ হিন্দু-হোটেল হাজারি ঠাকুর নিজের হাতে রান্না করিয়া থাকেন। ভাত, ডাল, মাছ, মাংস সব রকম প্রস্তুত থাকে। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ও সস্তা। আসুন! দেখুন!! পরীক্ষা করুন!!!

বেচু চক্কত্তির হোটেলের অনুকরণে সামনেই গদির ঘর। সেখানে বংশী ঠাকুরের ভাগ্নে সেই ছেলেটি কাঠের বাক্সের উপর খাতা ফেলিয়া খরিদ্দারগণের আনাগোনার হিসাব রাখিতেছে। ভিতরে রান্না করিতেছে বংশী ও হাজারি–বেচু চক্কত্তির হোটেলের মতই তিনটি শ্রেণী করা হইয়াছে, সেই রকম টিকিট কিনিয়া ঢুকিতে হয়।

তা নিতান্ত মন্দ নয়। খুলিবার দিন দুপুরের খরিদ্দার হইল ভালই! বংশী খাইবার ঘরে ভাত দিতে আসিয়া ফিরিয়া গিয়া হাজারিকে বলিল–থাড কেলাস ত্রিশ খানা। প্রথম দিনের পক্কে যথেষ্ট হয়েছে। ওবেলা মাংস লাগিয়ে দাও।

বহুদিনের বাসনা ঠাকুর রাধাবল্লভ পূর্ণ করিয়াছেন। হাজারি এখন হোটেলের মালিক। বেচু চক্কত্তির সমান দরের লোক সে আজ। অত্যন্ত ইচ্ছা হইল, যত জানাশোনা পরিচিত লোক যে যেখানে আছে–সকলকেই কথাটা বলিয়া বেড়ায়। মনের আনন্দ চাপিতে না পারিয়া বৈকালে কুসুমের বাড়ী গিয়া হাজির হইল। কুসুম বলিল–কেমন চললো হোটেল জ্যাঠামশায়?

–বেশ খদ্দের পাচ্চি। আমার বড্ড ইচ্ছে তুমি একবার এসে দেখে যাও–তুমি তো অংশীদার–

–যাবো এখন। কাল সকালে যাবে। আপনার মনিব কি বল্লে?

–রেগে কাই। ও মাসের মাইনে দেয় নি–না দিকগে, সত্যিই বলচি কুসুম মা, আমার বয়েস কে বলে আটচল্লিশ হয়েচে? আমার যেন মনে হচ্চে আমার বয়েস পনের বছর কমে গিয়েচে। হাতপায়ে বল এসেচে কত! তুমি আর আমার অতসী মা–তোমরা আর জন্মে আমার কি ছিলে জানিনে—তোমাদের–

কুসুম বাধা দিয়া বলিল–আবার ওই সব কথা বলছেন জ্যাঠামশায়? আমার টাকা দিইচি সুদ পাবো বলে। এ তো ব্যবসায় টাকা ফেলা–টাকা কি তোরঙ্গের মধ্যে থেকে আমার স্বগগে পিদিম দিতো? বলি নি আমি আপনাকে? তবে হ্যাঁ, আমাদের বাবুর মেয়ের কথা যা বল্লেন, সে দিয়েছে বটে কোন খাঁই না করে। তার কথা, হাজার বার বলতে পারেন। তার বিয়ের কি হোল?

–সামনের সোমবার বিয়ে। চিঠি পেয়েছি–যাচ্ছি ওদিন সকালে।

–আমার কাকার সঙ্গে যদি দেখা হয় তবে এসব টাকাকড়ির কথা যেন বলবেন না সেখানে।

–তোমাকে শিখিয়ে দিতে হবে না মা, যতবার দেখা হয়েচে তোমার নামটি পর্যন্ত কখনো সেখানে ঘূণাক্ষরে করি নি। আমারও বাড়ী এঁড়োশোলা, আমায় তোমার কিছু শেখাতে হবে না।

কথামত পরদিন সকালে কুসুম হোটেল দেখতে গেল। সে দুধ দই লইয়া অনেক বেলা পৰ্য্যন্ত পাড়ায় পাড়ায় বেড়ায়– তাহার পক্ষে ইহা আশ্চর্যের কথা কিছুই নহে।

হাজারি তাহাকে রান্নাঘরে যত্ন করিয়া বসাইতে গেল–সে কিন্তু দোরের কাছে দাঁড়াইয়া রহিল, বলিল–আমি গুরুঠাকরুন কিছু আসি নি যে আসন পেতে যত্ন করে বসাতে হবে।

হাজারি বলিল–তোমারও তো হোটেল কুসুম-মা–তুমি এর অংশীদারও বটে, মহাজনও বটে। নিজের জিনিস ভাল করে দেখে শোনো। কি হচ্ছে না হচ্চে তদারক করো–এতে লজ্জা কি? বংশী, চিনে রাখো এ একজন অংশীদার।

এ কথায় কুসুম খুব খুশি হইল–মুখে তাহার আহ্লাদের চিহ্ন ফুটিয়া উঠিল। এমন একটা হোটেলের সে অংশীদার ও মহাজন–এ একটা নতুন জিনিস তাহার জীবনে। এ ভাবে ব্যাপারটা বোধ হয় ভাবিয়া দেখে নাই। হাজারি বলিল–আজ মাছ রান্না হয়েছে বেশ পাকা রুই। তুমি একটু বোসো মা, মুড়োটা নিয়ে যাও।

–না না জ্যাঠামশায়।–ওসব আপনাকে বারণ করে দিইচি না! সকলের মুখ বঞ্চিত করে আমি মাছের মুড়ো খাবো–বেশ মজার কথা!

–আমি তোমার বুড়ো বাবা, তোমাকে খাইয়ে আমার যদি তৃপ্তি হয়, কেন খাবে না বুঝিয়ে দাও।

হোটেলের চাকর হাঁকিল–থাড কেলাস তিন থালা–-

হাজারি বলল–খদ্দের আসছে বোসো মা একটু। আমি আসছি, বংশী ভাত বেড়ে ফেলো।

আসিবার সময় কুসুম সলজ্জ সঙ্কোচের সহিত হাজারির দেওয়া এক কাঁসি মাছ তরকারি লইয়া আসিল।

.

এক বছর কাটিয়া গিয়াছে।

হাজারি এঁডোশোলা হইতে গরুর গাড়ীতে রাণাঘাট ফিরিতেছে, সঙ্গে টেঁপির মা, টেঁপি ও ছেলেমেয়ে। তাহার হোটেলের কাজ আজকাল খুব বাড়িয়া গিয়াছে। রাণাঘাটে বাসা না করিলে আর চলে না।

টেঁপির মা বলিল–আর কতটা আছে হ্যাঁ গা?

–ওই তো সেগুন বাগান দেখা দিয়েছে–এইবার পৌঁছে যাবো

টেঁপি বলিল–বাবা, সেখানে নাইবো কোথায়? পুকুর আছে না গাঙ?

–গাঙ আছে, বাসায় টিউব কল আছে।

টেঁপির মা বলিল–তাহোলে জল টানতে হবে না পুকুর থেকে। বেঁচে যাই–

ইহারা কখনো শহরে আসে নাই–টেঁপির মার বাপের বাড়ী এঁডোশোলার দু ক্রোশ উত্তরে মণিরামপুর গ্রামে। জন্ম সেখানে, বিবাহ এঁড়োশোলায়, শহর দেখিবার একবার সুযোগ হইয়াছিল অনেকদিন আগে, অগ্রহায়ণ মাসে গ্রামের য়েদের সঙ্গে একবার নবদ্বীপে রাস দেখিতে গিয়াছিল।

হোটেলের কাছেই একখানা একতলা বাড়ী পূৰ্ব্ব হইতে ঠিক করা ছিল। টেঁপির মা বাড়ী দেখিয়া খুব খুশি হইল। চিরকাল খড়ের ঘরে বাস করিয়া অভ্যাস, কোঠাঘরে বাস এই তাহার প্রথম।

–কখানা ঘর গা? রান্নাঘর কোন্ দিকে? কই তোমার সেই টিউকল দেখি? জল বেশ ও তো? ওরে টেঁপি, গাড়ীর কাপড়গুলো আলাদা করে রেখে দে–একপাশে। ও-সব নিয়ে ছিষ্টি ছোঁয়ানেপা করো না যেন, বস্তার মধ্যে থেকে একটা ঘটি আগে বের করে দাও না গো, এক ঘটি জল আগে তুলে নিয়ে আসি।

একটু পরে কুসুম আসিয়া ঢুকিয়া বলিল–ও জেঠিমা, এলেন সব? বাসা পছন্দ হয়েছে তো?

টেঁপির মা কুসুমকে চেনে। গ্রামে তাহাকে কুমারী অবস্থা হইতেই দেখিয়াছে। বলিল– এসো মা কুসুম, এসো এসো! ভাল আছ তো? এসো এসো কল্যেণ হোক।

হোটেলের চাকর রাখাল এই সময় আসিল। তাহার পিছনে মুটের মাথায় এক বস্তা পাথুরে কয়লা। হাজারিকে বলিল–কয়লা কোনদিকে নামাবো বাবু?

হাজারি বলিল–কয়লা আনলি কেন রে? তোকে যে বলে দিলাম কাঠ আনতে? এর কয়লার আঁচ দিতে জানে না।

কুসুম বলিল–কয়লার উনুন আছে? আমি আঁচ দিয়ে দিচ্ছি। আর শিখে নিতে তো হবে জেঠিমাকে। কয়লা সস্তা পড়বে কাঠের চেয়ে এ শহর-বাজার জায়গায়। আমি একদিনে শিখিয়ে দেবো জেঠিমাকে।

রাখাল কয়লা নামাইয়া বলিল–বাবু, আর কি করতে হবে এখন?

হাজারি বলিল–তুই এখন যাসনে–জলটলগুলো তুলে দিয়ে জিনিসপত্তর গুছিয়ে রেখে তবে যাবি। হোটেলের বাজার এসেছে?

–এসেছে বাবু।

–তা থেকে এবেলার মত মাছ-তরকারি চার-পাঁচ জনের মত নিয়ে আয়। ওবেলা আলাদা বাজার করলেই হবে। আগে জল তুলে দে দিকি।

টেঁপির মা বলিল–ও কে গো?

–ও আমাদের হোটেলের চাকর। বাসার কাজও ও করবে, বলে দিইছি।

টেঁপির মা অবাক হইল। তাহাদের নিজেদের চাকর, সে আবার হাজারিকে ‘বাবু’ সম্বোধন করিতেছে–এ সব ব্যাপার এতই অভিনব যে বিশ্বাস করা শক্ত। গ্রামের মধ্যে তাহারা ছিল অতি গরীব গৃহস্থ, বিবাহ হইয়া পৰ্য্যন্ত বাসন-মাজা, জল-তোলা, ক্ষার-কাঁচা, এমন কি ধান ভানা পর্যন্ত সৰ্বরকম গৃহকৰ্ম্ম সে একা করিয়া আসিয়াছে। মাস চার পাঁচ হইল দুটি সচ্ছল অন্নের মুখ সে দেখিয়া আসিতেছে, নতুবা আগে আগে পেট ভরিয়া দুটি ভাত খাইতে পাওয়াও সব সময় ঘটিত না।

আর আজ এ কি ঐশ্বর্যের দ্বার হঠাৎ তাহার সম্মুখে উন্মুক্ত হইয়া গেল। কোঠাবাড়ী, চাকর, কলের জল–এ সব স্বপ্ন না সত্য?

রাখাল আসিয়া বলিল–দেখুন তো মা এই মাছ-তরকারিতে হবে না আর কিছু আনবো?

বড় বড় পোনা মাছের দাগা দশ-বারো খানা। টেঁপির মা খুশির সহিত বলিল–না বাবা আর আনতে হবে না। রাখো ওখানে।

–ওগুলো কুটে দিই মা?

মাছ কুটিয়াও দিতে চায় যে! এ সৌভাগ্যও তাহার অদৃষ্টে ছিল।

হাজারি বলিল–আগে জল তুলে দে তারপর কুটবি এখন। আগে সব নেয়ে নিই।

কুসুম কয়লার উনুনে আঁচ দিয়া আসিয়া বলিল–জেঠিমা আপনিও নেয়ে নিন। ততক্ষণ আঁচ ধরে যাক। বেলা প্রায় এগারোটা বাজে। রান্না চড়িয়ে দেবার আর দেরি করবার দরকার কি? আমি এবার যাই।

টেঁপির মা বলিল–তুমি এখানে এবেলা খাবে কুসুম।

কুসুম ব্যস্তভাবে বলিল–না না, আপনারা এলেন তেতেপুড়ে এই দুপুরের সময়। এখন কোনোরকমে দুটো ঝোলভাত রেঁধে আপনারা এবেলা খেয়ে নিন–তার মধ্যে আবার আমার খাওয়ার হাংনামায়–

–কিছু হাংনামা হবে না মা। তুমি না খেয়ে যেতে পারবে না। ভাল বেগুন এনেছি গাঁ থেকে, তোমাদের শহরে তেমন বেগুন মিলবে না–বেগুন পোড়াবো এখন। বাপের বাড়ীর বেগুন খেয়ে যাও আজ। কাল শুটকে যাবে।

হাজারি স্নান সারিয়া বলিল–আমি একবার হোটেলে চল্লাম। তোমরা রান্না চাপাও। আমি দেখে আসি।

আধঘণ্টা পরে হাজারি ফিরিয়া দেখিল টেঁপি ও টেঁপির মা দুজনে উনুনে পরিত্রাহি ফুঁ পাড়িতেছে। আঁচ নামিয়া গিয়াছে, তনও মাছের ঝোল বাকি।

টেঁপির মা বিপন্নমুখে বলিল–ওগো, এ আবার কি হোল, উনুন যে নিবে আসছে। কি করি এখন?

কুসুম বাড়ীতে স্নান করিতে গিয়াছে, রাখাল গিয়াছে হোটেলে, কারণ এই সময়টা সেখানে খরিদ্দারের ভিড় অত্যন্ত। এবেলা অন্ততঃ একশত জন খায়। বেচু চক্কত্তি ও যদু বাঁড়ুয্যের হোটেল কানা হইয়া পড়িয়াছে। হাজারি নিজের হাতে রান্না করে, তাহার রান্নার গুণে–রেলবাজারের যত খরিদ্দার সব ঝুঁকিয়াছে তাহার হোটেলে। তিনজন ঠাকুর ও চারিজন চাকরে হিমসিম খাইয়া যায়। ইহারা কেহই কয়লার উনুনে আঁচ দেওয়া দূরের কথা, কয়লার উনুনই দেখে নাই। আঁচ কমিয়া যাইতে বিষম বিপদে পড়িয়া গিয়াছে। ইহাদের অবস্থা দেখিয়া হাজারির হাসি পাইল। বলিল-শেখো, পাড়াগেঁয়ে ভূত হয়ে কতকাল থাকবে? সরে দিকি? ওর ওপর আর চাট্টি কয়লা দিতে হয়–এই দেখিয়ে দিই।

টেঁপির মা বলিল–আর তুমি বড্ড শহুরে মানুষ! তবুও যদি এঁডোশোলা বাড়ী না হোত!

–আমি? আমি আজ সাত বছর এই রাণাঘাটের রেলবাজারে আছি। আমাকে পাড়াগেঁয়ে বলবে কে? ওকথা তুলে রাখোগে ছিকেয়।

টেঁপি বলিল–বাবা এখানে টকি আছে? তুমি দেখেছ?

হাজারি বিশ হাত জলে পড়িয়া গেল। টকি বাইস্কোপ এখানে আছে বটে কিন্তু বাইস্কোপ দেখার শখ কখনও তাহার হয় নাই। কিন্তু টেঁপি আধুনিকা, এঁড়োশোলায় থাকিলে কি হয়, বাংলার কোন্ পাড়াগাঁয়ে আধুনিকতার ঢেউ যায় নাই?…বিশেষত অতসী তার বন্ধু…অতসীর কাছে অনেক জিনিস সে শুনিয়াছে বা শিখিয়াছে যাহা তাহার বাবা (মা তো নয়ই) জানেও না।

টেঁপির মা বলিল–টকি কি গা?

হাজারি আধুনিক হইবার চেষ্টায় গম্ভীর ভাবে বলিল–ছবিতে কথা কয়, এই। দেখেছি অনেকবার। দেখবো না আর কেন? হুঁ–

বলিয়া তাচ্ছিল্যের ভাবে সবটা উড়াইয়া দিবার চেষ্টা করিতে গেল–কিন্তু টেঁপি পরক্ষণেই জিজ্ঞাসা করিল–কি পালা দেখেছিলে বাবা?

–পালা! তা কি আর মনে আছে। লক্ষণের শক্তিশেল বোধহয়, হাঁ–লক্ষণের শক্তিশেল।

মনের মধ্যে বহু কষ্টে হাতড়াইয়া ছেলেবেলায় দেখা এক যাত্রার পালার নামটা হাজারি করিয়া দিল। টেঁপি বলিল–লপের শক্তিশেল আবার কি পালার নাম? ওর নাম তো টকি, পালার থাকে না? তাদের নাম আমি শুনেছি অতসীদির কাছে, সে তো

–হাঁ হাঁ–তুই আর অতসীদি ভারি সব জানিস আর কি! যা–সর দিকি–ওই কয়লার ঝুড়িটা–

–ও মামাবাবু, খাওয়া-দাওয়া হোল–বলিয়া বংশীর ভাগ্নে সেই সুন্দর ছেলেটি বাড়ীর মধ্যে ঢুকিতেই টেঁপির মা, পাড়াগেঁয়ে বউ, তাড়াতাড়ি মাথায় ঘোমটা টানিয়া দিতে গেল। টেঁপি কিন্তু নবাগত লোকটির দিকে কৌতূহলের দৃষ্টিতে চাহিয়া রহিল।

হাজারি বলিল–এসো বাবা এসো–ঘোমটা দিচ্ছ কাকে দেখে? ও হোল বংশীর ভাগ্নে। আমার হোটেলে খাতাপত্র রাখে। ছেলেমানুষ–ওকে দেখে আবার ঘোমটা–

বংশীর ভাগিনেয় আসিয়া টেঁপির মার পায়ের ধূলা লইয়া প্রণাম করিল।

হাজারি মেয়েকে বলিল–তোর নরেন দাদাকে প্রণাম কর টেঁপি। এইটি আমার মেয়ে, বাবা নরেন। ও বেশ লেখাপড়া জানে–সেলাইয়ের কাজটাজ ভাল শিখেছে আমাদের গাঁয়ের বাবুর মেয়ের কাছে।

টেঁপির হঠাৎ কেমন লজ্জা করিতে লাগিল। ছেলেটি দেখিতে যেমন, এমন চেহারার ছেলে সে কখনো দেখে নাই–কেবল ইহার সঙ্গে খানিকটা তুলনা করা যায় অতসীদি’র বরের। অনেকটা মুখের আদল যেন সেই রকম।

বংশীর ভাগ্নেও তাহার স্বচ্ছন্দ হৃদ্যতার ভাব হারাইয়া ফেলিয়াছে। চোখ তুলিয়া ভাল করিয়া চাওয়া যেন একটু কষ্টকর হইয়া উঠিতেছে। টেঁপির দিকে তো তেমন চাহিতেই পারিল না।

হাজারি বলিল–মুর্শিদাবাদের গাড়ী থেকে ক’জন নামলো আজ?

–নেমেছিল জনদশেক, তার মধ্যে তিনজনকে বেচু চক্কত্তির চাকর একরকম হাত ধরে জোর করেই টেনে নিয়ে গেল। বাকি সাতজন আমরা পেয়েছি–আর বনগাঁর ট্রেন থেকে এসেছিল পাঁচজন।

–ইস্টিশানে গিয়েছিল কে।

–ব্রজ ছিল, রাখালও ছিল বনগাঁর গাড়ীর সময়। ব্ৰজ বল্লে বেচু চক্কত্তির চাকরের সঙ্গে খদ্দের নিয়ে তার হাতাহাতি হয়ে যেতো আজ।

–না না, দরকার নেই বাবা ওসব। হাজার হোক, আমার পুরোনো মনিব। ওদের খেয়েই এতকাল মানুষ–হোটেলের কাজ শিখেছিও ওদের কাছে। শুধু রাঁধতে জানলে তো হোটেল চালানো যায় না বাবা, এ একটা ব্যবসা। কি করে হাট-বাজার করতে হয়, কি করে খদ্দের তুষ্ট করতে হয়, কি করে হিসেবপত্র রাখতে হয়–এও তো জানতে হবে। আমি দু’বছর ওদের ওখানে থেকে কেবল দেখতাম ওরা কি করে চালাচ্ছে। দেখে দেখে শেখা। এখন সব পারি।

বংশীর ভাগ্নে বলি–আচ্ছা মামীমা, খাওয়া দাওয়া করুন, আমি আসবো এখন ওবেলা।

হাজারি বালল–তুমি কাল দুপুরে হোটেলে খেও না–বাসাতে খাবে এখানে। বুঝলে?

বংশীর ভাগ্নে চলিয়া গেলে টেঁপির অনুপস্থিতিতে হাজারি বলিল–কেমন ছেলেটি দেখলে?

–বেশ ভাল। চমৎকার দেখতে।

–ওর সঙ্গে টেঁপির বেশ মানায় না?

–চমৎকার মানায়। তা কি আর হবে। আমাদের অদৃষ্টে কি অমন ছেলে জুটবে?

–জুটবে না কেন, জুটে আছে। ওকে আনিয়ে রেখেচি হোটেলে তবে কি জন্যে? তোমাদের রাণাঘাটের বাসায় আনলাম তবে কি জন্যে?…টেঁপিকে যেন এখন কিছু–বোঝ তো? কাল ওকে একটু যত্ন-আত্যি করো। আমার অনেক দিনের ইচ্ছে ওর সঙ্গে টেঁপির–তা এখন অনেকটা ভরসা পাচ্ছি। ওর বাপের অবস্থা বেশ ভাল, ছেলেটাও ম্যাট্রিক পাস। বিয়ে দিয়ে হোটেলেই বসিয়ে দেবো–থাক আমার অংশীদার হয়ে। কাজ শিখে নিক–টেঁপিও কাছেই রইল আমাদের–বুঝলে না, অনেক মতলব আছে।

টেঁপির মা বোকাসোকা মানুষ–অবাক হইয়া স্বামীর মুখের দিকে চাহিয়া তাহার কথা শুনিতে লাগিল।

.

সন্ধ্যার পরে খবর আসিল স্টেশনে বেচু চক্কত্তির হোটেলের লোকের সঙ্গে হাজারির চাকরে খরিদ্দার লইয়া মারামারি হইয়া গিয়াছে। হাজারির চাকর নাথনি বলিল–বাবু, ওদের হোটেলের চাকর খদ্দেরের হাত ধরে টানাটানি করে– আমাদের খদ্দের, আমাদের হোটেলে আসচে–তার হাত ধরে টানবে আর আমাদের হোটেলের নিন্দে করবে। তাই আমার সঙ্গে হাতাহাতি হয়ে গিয়েছে।

–খদ্দের কোথায় গেল?

–খদ্দের সেচে আমাদের এখানে। ওদের হোটেলের লোকের আমাদের ওপর আকচ আছে, আমরাই সব খদ্দের পাই, ওরা পায় না–এই নিয়েই ঝগড়া বাবু। ওদের হোটেলের হয়ে এল বাবু। একটা গাড়ীতেও খদ্দের পায় না।

রাত আটটার সময়ে হাজারি সবে মাছের ঝোল উনুনে চাপাইয়াছে, এমন সময় বংশী বলিল–হাজারি-দা, জবর খবর আছে। তোমার আগের কর্তা তোমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন কেন দেখে এসো গে। বোধ হয় মারামারি নিয়ে–

–ঝোলটা তুমি দেখো। আমি এসে মাংস চাপাবো–দেখি কি খবর।

অনেকদিন পরে হাজারি বেচু চক্কত্তির হোটেলের সেই গদির ঘরটিতে গিয়া দাঁড়াইল। সেই পুরোনো দিনের মনের ভাব সেই মুহূর্তেই তাহাকে পাইয়া বসিল যেন ঢুকিবার সঙ্গে সঙ্গেই। যেন সে রাঁধুনী বামুন, বেচু চক্কত্তি আজও মনিব।

বেচু চক্কত্তি তাহাকে দেখিয়া খাতির করিবার সুরে বলিলেন–আরে এস এস হাজারি এস–এখানে বসো।

বলিয়া গদির এক পাশে হাত দিয়া ঝাড়িয়া দিলেন, যদিও ঝড়িবার কোন আবশ্যক ছিল না। হাজারি দাঁড়াইয়াই রহিল। বলিল–না বাবু, আমি বসবো না। আমায় ডেকেচেন কেন?

–এসো, বসোই এসে আগে। বলচি।

হাজারি জিভ কাটিয়া বলিল–না বাবু, আপনি আমার মনিব ছিলেন এতদিন। আপনার সামনে কি বসতে পারি? বলুন, কি বলবেন–আমি ঠিক আছি।

হাজারির চোখ আপনা-আপনি খাওয়ার ঘরের দিকে গেল। হোটেলের অবস্থা সত্যই খুব খারাপ হইয়া গিয়াছে। রাত ন’টা বাজে, আগে আগে এসময় খরিদ্দারের ভিড়ে ঘরে জায়গা থাকিত না। আর এখন লোক কই? হোটেলের জলুসও আগের চেয়ে অনেক কমিয়া গিয়াছে।

বেচু চক্কত্তি বলিলেন–না, বোসো হাজারি। চা খাও, ওরে কাঙালী, চা নিয়ে আয় আমাদের।

হাজারি তবুও বসিতে চাহিল না। চাকর চা দিয়া গেল, হাজারি আড়ালে গিয়া চা খাইয়া আসিল।

বেচু চক্কত্তি দেখিয়া শুনিয়া খুব খুশি হইলেন। হাজারির মাথা ঘুরিয়া যায় নাই হঠাৎ অবস্থাপন্ন হইয়া। কারণ অবস্থাপন্ন যে হাজারি হইয়া উঠিয়াছে, তাহা তিনি এতদিন হোটেল চালানোর অভিজ্ঞতা হইতে বেশ বুঝিতে পারেন।

হাজারি বলিল–বাবু, আমায় কিছু বলচিলেন?

–হ্যাঁ-বলচিলাম কি জানো, এক জায়গায় ব্যবসা যখন আমাদের তখন তোমার সঙ্গে আমার কোন শত্রুতা নেই তো–তোমার চাকর আজ আমার চাকরকে মেরেছে ইস্টিশনে। এ কেমন কথা?

এই সময় পদ্মঝি দোরের কাছে আসিয়া দাঁড়াইল। হোটেলের চাকরও আসিল।

হাজারি বলিল–আমি তো শুনলাম বাবু আপনার চাকরটা আগে আমার চাকরকে মারে। নাথনি খদ্দের নিয়ে আসছিল এমন সময়–

পদ্মঝি বলিল–হ্যাঁ তাই বৈকি! তোমাদের নাথনি আমাদের খদ্দের ভাগাবার চেষ্টা করে–আমাদের হোটেলে আসছিল খদ্দের, তোমাদের হোটেলে যেতে চায় নি–

একথা বিশ্বাস করা যেন বেচু চক্কত্তির পক্ষেও শক্ত হইয়া উঠিল। তিনি বলিলেন–যাক, ও নিয়ে আর ঝগড়া করে কি হবে হাজারির সঙ্গে। হাজারি তো সেখানে ছিল না, দেখেও নি, তবে তোমায় বল্লাম হাজারি, যাতে আর এমন না হয়–

হাজারি বলিল–বাবু, বেশ আমি রাজী আছি। আপনার হোটেলের সঙ্গে আমার কোনো বিবাদ করলে চলবে না। আপনি আমার পুরোনো মনিব। আসুন, আমরা গাড়ী ভাগ করে নিই। আপনি যে গাড়ীর সময় ইস্টিশানে চাকর পাঠাবেন, আমার হোটেলের চাকর সে সময় যাবে না।

বেচু চক্কত্তি বিস্মিত হইলেন। ব্যবসা জিনিসটাই রেষারেষির উপর, আড়াআড়ির উপর চলে–তিনি বেশ ভালই জানেন। মাথার চুল পাকাইয়া ফেলিলেন তিনি এই ব্যবসা করিয়া। এস্থলে হাজারির প্রস্তাব যে কতদূর উদার, তাহা বুঝিতে বেচুর বিলম্ব হইল না। তিনি আমতা আমতা করিয়া বলিলেন–না তা কেন, ইস্টিশান তো আমার একলার নয়–

–না বাবু, এখন থেকে তাই রইল। মুর্শিদাবাদ আর বনগাঁর গাড়ীর মধ্যে আপনি কি নেবেন বলুন মুর্শিদাবাদ চান, না বনগাঁ চান? আমি সে সময় চাকর পাঠাবো না ইস্টিশানে।

পদ্মঝি দোর হইতে সরিয়া গেল।

বেচু চক্কত্তি বলিলেন–তা তুমি যেমন বলো। মুর্শিদাবাদখানাই তবে রাখো আমার। তা আর একটু চা খেয়ে যাবে না?–আচ্ছা, এসো তবে।

হাজারি মনিবকে প্রণাম করিয়া চলিয়া আসিল।

পদ্মঝি পুনরায় দোরের কাছে আসিয়া জিজ্ঞাসা করিল—হাঁ বাবু, কি বলে গেল?

–গাড়ী ভাগ করে নিয়ে গেল। মুর্শিদাবাদখানা আমি রেখেছি। যা কিছু লোক আসে, মুর্শিদাবাদ থেকেই আসে–বনগাঁর গাড়ীতে কটা লোক আসে? লোকটা বোকা, লোক মন্দ নয়। দুষ্টু নয়।

–আমি আজ সাত বছর দেখে আসছি আমি জানিনে? গাঁজা খেয়ে বুঁদ হয়ে থাকে, হোটেলের ছাই দেখাশুনো করে। রেঁধেই মরে, মজা লুটচে বংশী আর বংশীর ভাগ্নে। ক্যাশ তার হাতে। আমি সব খবর নিইচি তলায় তলায়। বংশীকে আবার এখানে আনুন বাবু, ও হোটেল এক দিনে ভুস্যিনাশ হয়ে বসে রয়েচে। বংশীকে ভাঙাবার লোক লাগান আপনি–আর ওর ভাগ্নেটাকেও—

.

পরদিন দুপুরে বংশীর ভাগ্নে সসঙ্কোচে হাজারির বাসায় নিমন্ত্রণ রক্ষা করিতে আসিল। হাজারি হোটেল হইতে তাহাকে পাঠাইয়া দিল বটে, কিন্তু নিজে তখন আসিতে পারিল না, অত্যন্ত ভিড় লাগিয়াছে খরিদ্দারের, কারণ সেদিন হাটবার।

মায়ের আদেশে টেঁপিকে অতিথির সামনে অনেকবার বাহির হইতে হইল। কখনও বা আসন পাতা, কখনও জলের গ্লাসে জল দেওয়া ইত্যাদি। টেঁপি খুব চটপটে চালাকচতুর মেয়ে, অতসীর শিষ্যা–কিন্তু হঠাৎ তাও কেমন যেন একটু লজ্জা করিতে লাগিল এই সুন্দর ছেলেটির সামনে বার বার বাহির হইতে।

বংশীর ভাগ্নেটিও একটু বিস্মিত হইল। হাজারি-মামারা পাড়াগাঁয়ের লোক সে জানে– অবস্থাও এতদিন বিশেষ ভাল ছিল না। আজই না হয় হোটেলের ব্যবসায়ে দু-পয়সার মুখ দেখিতেছে। কিন্তু হাজারি-মামার মেয়ে তো বেশ দেখিতে, তাহার উপর তার চালচলন ধরন-ধারণ যেন স্কুলে পড়া আধুনিক মেয়েছেলের মত। সে কাপড় গুছাইয়া পরিতে জানে, সাজিতে গুজিতে জানে, তার কথাবার্তার ভঙ্গিটাও বড় চমৎকার।

তাহার খাওয়া প্রায় শেষ হইয়াছে এমন সময় হাজারি আসিল। বলিল–খাওয়া হয়েছে বাবা, আমি আসতে পারলাম না–আজ আবার ভিড় বড্ড বেশী।

–ও টেঁপি আমায় একটু তেল দে মা, নেয়ে নিই, আর তোর ঐ দাদার শোওয়ার জায়গা করে দে দিকি–-পাশের ঘরটাতে একটু গড়িয়ে নাও বাবা।

বংশীর ভাগ্নে গিয়া শুইয়াছে–এমন সময় টেঁপি পান দিতে আসিল। পানের ডিবা নাই, একখানা ছোট রেকাবিতে পান আনিয়াছে। ছেলেটি দেখিল চুন নাই রেকাবিতে। লাজুক মুখে বলিল–একটু চুন দিয়ে যাবেন?

টেঁপির সারা দেহ লজ্জার আনন্দে কেমন যেন শিহরিয়া উঠিল। তাহার প্রথম কারণ তাহার প্রতি সম্ভ্রমসূচক ক্রিয়াপদের ব্যবহার এই হইল প্রথম। জীবনে ইতিপূর্বে তাহাকে কেহ ‘আপনি’ ‘আজ্ঞে’ করিয়া কথা বলে নাই। দ্বিতীয়ত: কোনও অনাত্মীয় তরুণ যুবকও তাহার সহিত ইতিপূৰ্ব্বে কথা বলে নাই। বলে নাই কি একেবারে! গাঁয়ের রামু-দা, গোপাল-দা, জহর-দা-ইহারাও তাহার সঙ্গে তো কথা বলিত! কিন্তু তাহাতে এমন আনন্দ তাহার হয় নাই তো কোনোদিন? চুন আনিয়া রেকাবিতে রাখিয়া বলিল–এতে হবে?

–খুব হবে। থাক ওখানেই–ইয়ে, এক গেলাস জল দিয়ে যাবেন?

টেঁপির বেশ লাগিল ছেলেটিকে। কথাবার্তার ধরন যেমন ভাল, গলার সুরটিও তেমনি মিষ্ট। যখন জলের গ্লাস আনিল, তখন ইচ্ছা হইতেছিল ছেলেটি তাহার সঙ্গে আর একবার কিছু বলে। কিন্তু ছেলেটি এবার আর কিছু বলল না। টেঁপি জলের গ্লাস নামাইয়া রাখিয়া চলিয়া গেল।

বেলা যখন প্রায় পাঁচটা, বৈকাল অনেক দূর গড়াইয়া গিয়াছে –টেঁপি তখন একবার উঁকি মারিয়া দেখিল, ছেলেটি অঘোরে ঘুমাইতেছে।

হঠাৎ টেঁপির কেমন একটা অহেতুক স্নেহ আসিল ছেলেটির প্রতি।

আহা, হোটেলে কত রাত পর্যন্ত জাগে। ভাল ঘুম হয় না রাত্রে!

টেঁপি আসিয়া মাকে বলিল–মা সেই লোকটা এখনও ঘুমুচ্ছে। ডেকে দেবো, না ঘুমুবে।

টেঁপির মা বলিল–ঘুমুচ্ছে ঘুমুক না। ডাকবার দরকার কি? চাকরটা কোথায় গেল? ঘুম থেকে উঠলে ওকে কিছু খেতে দিতে হবে। খাবার আনতে দিতাম। উনিও তো বাড়ী নেই।

টেঁপি বলিল–লোকটা চা খায় কিনা জানিনে, তাহলে ঘুম থেকে উঠলে একটু চা করে দিতে পারলে ভাল হোত।

টেঁপির মা চা নিজে কখনো খায় নাই, করিতেও জানে না। আধুনিকা মেয়ের এ প্রস্তাব তাহার মন্দ লাগিল না।

মেয়েকে বলিল–তুই করে দিতে পারবি তো?

মেয়ে খিল খিল করিয়া হাসিয়া বলিল–তুমি যে কি বল মা, হেসে প্রাণ বেরিয়ে যায়– পরে কেমন একটি অপূৰ্ব ভঙ্গিতে হাত নাড়িয়া নাড়িয়া হাসিভরা মুখের চিবুকখানি বার বার উঠাইয়া-নামাইয়া বলিতে লাগিল–চা কই? চিনি কই? কেটলি কই? চায়ের জল ফুটবে কিসে? ডিস-পেয়ালা কই? সে সব আছে কিছু?

টেঁপির মায়ের বড় ভাল লাগিল টেঁপির এই ভঙ্গি। সে সস্নেহে মুগ্ধদৃষ্টিতে মেয়ের দিকে হাঁ করিয়া চাহিয়া রহিল। এমন ভাবে এমন সুন্দর ভঙ্গিতে কথা টেঁপি আর কখনও বলে নাই।

এই সময় হাজারি বাড়ীর মধ্যে ঢুকিল, হোটেলেই ছিল। বলিল–নরেন কোথায়? ঘুমুচ্ছে নাকি?

টেঁপির মা বলিল–তুমি এতক্ষণ ছিলে কোথায়? ওকে একটু খাবার আনিয়ে দিতে হবে। আর টেঁপি বলছে চা করে দিলে হোত।

হাজারির বড় স্নেহ হইল টেঁপির উপর। সে না জানিয়া যাহাকে আজ যত্ন করিয়া চা খাওয়াইতে চাহিতেছে, তাহারই সঙ্গে তার বাবা-মা যে বিবাহের ষড়যন্ত্র করিতেছে–বেচারী কি জানে?

বলিল–আমি সব এনে দিচ্ছি। হোটেলেই আছে। হোটেলে বড় ব্যস্ত আছি, কলকাতা থেকে দশ-বারো জন বাবু এসেছে শিকার করতে। ওর। অনেকদিন আগে একবার এসে আমার রান্না মাংস খেয়ে খুব খুশি হয়েছিল। সেই আগের হোটেলে গিয়েছিল, সেখানে নেই শুনে খুঁজে খুঁজে এখানে এসেছে। ওরা রাত্রে মাংস আর পোলাও খাবে। তোমরা এবেলা রান্না কোরো না–আমি হোটেল থেকে আলাদা করে পাঠিয়ে দেবো এখন। নরেনকে যে একবার দরকার, বাবুদের সঙ্গে ইংরিজিতে কথাবার্তা কইতে হবে, সে তো আমি পারবো না, নরেনকে ওঠাই দাঁড়াও–

টেঁপির মা বলিল–ঘুম থেকে উঠিয়ে কিছু না খাইয়ে ছাড়া ভাল দেখায় না। টেঁপি চায়ের কথা বলচিল–তা হোলে সেগুলো আগে পাঠিয়ে দেওগে, এখন জাগিও না।

.

বৈকালের দিকে নরেন ঘুম ভাঙিয়া উঠিল। অত্যন্ত বেলা গিয়াছে, পাঁচিলের ধারে সজনে গাছটার গায়ে রোদ হলদে হইয়া আসিয়াছে। নরেনের লজ্জা হইল– পরের বাড়ী কি ঘুমটাই ঘুমাইয়াছে। কে কি–বিশেষ করিয়া হাজারি-মামার মেয়েটি কি মনে করিল। বেশ মেয়েটি। হাজারি-মামার মেয়ে যে এমন চালাক-চতুর, চটপটে, এমন দেখিতে, এমন কাপড়-চোপড় পরিতে জানে তাহা কে ভাবিয়া ছিল?

অপ্রতিভ মুখে সে গায়ে জামা পরিয়া বাহির হইবার উদ্যোগ করিতেছে, এমন সময় টেঁপি আসিয়া বলিল–আপনি উঠেছেন? মুখ ধোবার জল দেবো?

নরেন থতমত খাইয়া বলিল–না, না, থাক আমি হোটেলেই–

–মা বললে আপনি চা খেয়ে যাবেন, আমি মাকে বলে আসি—

ইতিমধ্যে হাজারি চায়ের আসবাব হোটেলের চাকর দিয়া পাঠাইয়া দিয়াছিল, টেঁপি নিজেই চা করিতে বসিয়া গেল। তাহার মা জলখাবারের জন্য ফল কাটিতে লাগিল।

টেঁপি বলিল–মা চায়ের সঙ্গে শসা-টসা দেয় না। তুমি বরং ঐ নিমকি আর রসগোল্লা দাও রেকাবিতে–

–শসা দেয় না? একটা ডাব কাটবো? বাড়ীর ভাব আছে—

টেঁপি হাসিতে হাসিতে গড়াইয়া পড়ে আর কি। মুখে আঁচল চাপা দিয়া বলিল–হি হি, তুমি মা যে কি!…চায়ের সঙ্গে বুঝি ডাব খায়?

টেঁপির মা অপ্রসন্ন মুখে বলিল–কি জানি তোদের একেলে ঢং কিছু বুঝিনে বাপু। যা বোঝো তাই করো। ঘুম থেকে উঠলে তো নতুন জামাইদের ডাব দিতে দেখেছি চিরকাল দেশেঘরে-

কথাটা বলিয়া ফেলিয়াই টেঁপির মা মনে মনে জিভ কাটিয়া চুপ করিয়া গেল। মানুষটা একটু বোকা ধরনের, কি ভাবিয়া কি বলে, সব সময় তলাইয়া দেখিতে জানে না।

টেঁপি আশ্চর্য্য হইয়া বলিল–নতুন জামাই? কে নতুন জামাই?

–ও কিছু না; দেশে দেখেছি তাই বলচি। তুই নে, চা করা হোল?

টেঁপির মনে কেমন যেন খটকা লাগিল। সে খুব বুদ্ধিমতী, তাহার উপর নিতান্ত ছেলে মানুষটিও নয়, যখন চা ও খাবার লইয়া পুনরায় ছেলেটির সামনে গেল তখন তাহার কি জানি কেন যে লজ্জা করিতেছে তাহা সে নিজেই ভাল ধরিতে পারিল না।

ছেলেটি তাহাকে দেখিয়া বলিল–ও কি! এই এত খাবার কেন এখন, চা একটু হোলেই–

টেঁপি কোনো রকমে খাবারের রেকাবি লোকটার সামনে রাখিয়া পলাইয়া আসিলে যেন বাঁচে।

ছেলেটি ডাকিয়া বলিল–পান একটা যদি দিয়ে যান—

পান সাজিতে বসিয়া টেঁপি ভাবিল–বাবা খাটিয়ে মারলে আমায়! চা দেও–পান সাজো–আমার যেন যত গরজ পড়েছে, বাবার হোটেলের লোক তা আমার কি?

টেঁপি একটা চায়ের পিরিচে পান রাখিয়া দিতে গেল। ছেলেটি দেখিতে বেশ কিন্তু। কথাবার্তা বেশ, হাসি-হাসি মুখ। কি কাজ করে হোটেলে কে জানে?

পান লইয়া ছেলেটি চলিয়া গেল। যাইবার সময় বলিয়া গেল–মামীমা আমি যাচ্ছি, কষ্ট দিয়ে গেলাম অনেক, কিছু মনে করবেন না। এত ঘুমিয়েছি, বেলা আর নেই আজ।

বেশ ছেলেটি।

নতুন জামাই? কে নতুন জামাই? কাহাদের নতুন জামাই?

মা এক-একটা কথা বলে কি যে, তার মানে হয় না।

.

টেঁপির মা কখনও এত বড় শহর দেখে নাই।

এখানকার কাণ্ডকারখানা দেখিয়া সে অবাক হইয়া গিয়াছে। মোটর গাড়ী, ঘোড়ার গাড়ী, ইস্টিশানে বিদ্যুতের আলো, লোকজনই বা কত! আর তাদের এঁড়োশোলায় দিনমানেই শেয়াল তাকে বাড়ীর পিছনকার ঘন বাঁশবনে। সেদিন তো দিনদুপুরে জেলেপাড়ার কেষ্ট জেলের তিন মাসের ছেলেকে শেয়ালে লইয়া গেল।

ইতিমধ্যে কুসুম আসিয়া একদিন উহাদের বেড়াইতে লইয়া গেল। কুসুমের সঙ্গে তাহার রাধাবল্পভতলা, সিদ্ধেশ্বরীতলা, চূর্ণীর ঘাট, পালচৌধুরীদের বাড়ী–সব ঘুরিয়া ঘুরিয়া দেখিল। পালচৌধুরীদের প্রকাণ্ড বাড়ী দেখিয়া টেঁপির মা ও টেঁপি দু-জনেই অবাক। এত বড় বাড়ী জীবনে তাহারা দেখে নাই। অতসীদের বাড়ীটাই এতদিন বড়লোকের বাড়ীর চরম নিদর্শন বলিয়া ভাবিয়া আসিয়াছে যাহারা, তাহাদের পক্ষে অবাক হইবার কথা বটে।

টেঁপির মা বলিল–না, শহর জায়গা বটে কুসুম! গায়ে গায়ে বাড়ী আর সব কোঠাবাড়ী এদেশে। সবাই বড়লোক। ছেলেমেয়েদের কি চেহারা, দেখে চোখ জুড়ায়। হাঁরে, এদের বাড়ী ঠাকুর হয় না? পুজোর সময় একদিন আমাদের এনো মা, ঠাকুর দেখে যাবো।

সে আর ইহার বেশী কিছুই বোঝে না।

একটা বাড়ীর সামনে কত কি বড় বড় ছবি টাঙানো, লোকজন ঢুকিতেছে, রাস্তার ধারে কি কাগজ বিলি করিতেছে। টেঁপির মনে হইল এই বোধ হয় সেই টকি যাকে বলে, তাহাই। কুসুমকে বলিল–কুসুম দি, এই টকি না?

–হ্যাঁ দিদি। একদিন দেখবে?

-–এক দিন এনো না আমাদের। মা-ও কখনো দেখে নি–সবাই আসবো।

একখানা ধাবমান মোটর গাড়ীর দিকে টেঁপির মা হাঁ করিয়া চাহিয়া দেখিতে লাগিল, যতক্ষণ সেখানা রাস্তার মোড় ঘুরিয়া অদৃশ্য না হইয়া গেল।

কুসুম বলিল–আমার বাড়ী একটু পায়ের ধূলো দিন এবার জ্যাঠাইমা

কুসুমের বাড়ী যাইতে পথের ধারে রেলের লাইন পড়ে। টেঁপির মা বলিল–কুসুম, দাঁড়া মা একখানা রেলের গাড়ী দেখে যাই–

বলিতে বলিতে একখানা প্রকাণ্ড-মালগাড়ী আসিয়া হাজির। টেঁপি ও টেঁপির মা দুজনেই একদৃষ্টে দেখিতে লাগিল। গাড়ী চলিয়াছে তো চলিয়াছে–তাহার আর শেষ নাই।

উঃ, কি বড় গাড়ীটা!

কুসুম বলিল–জ্যাঠাইমা, রাণাঘাট ভাল লাগছে?

-লাগচে বৈকি, বেশ জায়গা মা।

আসলে কিন্তু এঁড়োশোলার জন্য টেঁপির মায়ের মন কেমন করে। শহরে নিজেকে সে এখনও খাপ খাওয়াইতে পারে নাই। সেখানকার তালপুকুরের ঘাট, সদা বোষ্টমের বাড়ীর পাশ দিয়া যে ছোট নিভৃত পথটি বাঁশবনের মধ্য দিয়া বাঁড়ুয্যে-পাড়ার দিকে গিয়াছে, দুপুর বেলা তাহাদের বাড়ীর কাছে বড় শিরীষ গাছটায় এই সময় শিরীষের সুঁটি শুকাইয়া ঝুন ঝুন শব্দ করে, তাহাদের উঠানের বড় লাউমাচায় এতদিন কত লাউ ফলিয়াছে, পেঁপে গাছটায় কত পেঁপের ফুল ও জালি দেখিয়া আসিয়াছিল–সে সবের জন্য মন কেমন করে বৈকি।

তবে এখানে যাহা সে পাইয়াছে টেঁপির মা জীবনে সে রকম সুখের মুখ দেখে নাই। চাকরের ওপর হুকুম চালাইয়া কাজ করাইয়া লওয়া, সকলে মানে, খাতির করে–অমন সুন্দর ছেলেটি তাহাদের হোটেলের মূহুরী– এ ধরনের ব্যাপারে কল্পনাও কখনও সে করিয়াছিল?

কুমের বাড়ী সকলে গিয়া পৌঁছিল। কুসুম ভারি খুশি হইয়া উঠিয়াছে–তাহার বাপের বাড়ী দেশের ব্রাহ্মণ-পরিবারকে এখানে পাইয়া। কুসুমের শাশুড়ী আসিয়া টেঁপির মায়ের পায়ের ধূলা লইয়া প্রণাম করিয়া বলিল–আমাদের বড্ড ভাগ্যি মা, আপনাদের চরণ-ধূলো পড়লো এ বাড়ীতে।

টেঁপির মাকে এত খাতির কবিয়া কেহ কখনো কথা বলে নাই–এত সুখও তাহার কপালে লেখা ছিল! হায় মা ঝিটকিপোতার বনবিবি, কি জাগ্রত দেবতাই তুমি! সেবার ঝিটকিপোতায় চৈত্র মাসে মেলায় গিয়া টেঁপির মা বনবিবিতলায় স-পাঁচ আনার সিন্নি দিয়া স্বামীপুত্রের মঙ্গলকামনা করিয়াছিল, এখনও যে বছর পার হয় নাই! তবুও লোকে ঠাকুর দেবতা মানিতে চায় না।

কুসুম সকলকে জলযোগ করাইল। পান সাজিয়া দিল। কুসুমের শাশুড়ী আসিয়া কতক্ষণ গল্পগুজব করিল। কুসুম গ্রামের কথাই কেবল শুনিতে চায়। কতদিন বাপের বাড়ী যায় নাই, বাবা-মা মরিয়া গিয়াছে, জ্যাঠামশায় আছে, কাকারা আছে–তাহারা কোনো দিন খোঁজও নেয় না। খোঁজ করিত অবশ্যই, যদি তাহার নিজের অবস্থা ভাল হইত। গরীব লোকের আদর কে করে?…এই সব অনেক দুঃখ কৰিল। আরও কিছুক্ষণ বসিবার পরে কুসুম উহাদের বাসায় পৌঁছিয়া দিয়া গেল।

১০

হাজারি এদিকের সব কাজ মিটাইয়া কুসুমের বাড়ী যাইবার জন্য রওনা হইল, পথে হঠাৎ পদ্মঝিয়ের সঙ্গে দেখা। পদ্মঝিয়ের পরনে মলিন বস্ত্র। কখনও হাজারি জীবনে যাহা দেখে নাই।

হাজারি বলিল–হাতে কি পদ্মদিদি? যাচ্ছ কোথায়?

পদ্ম হাজারিকে দেখিয়া দাঁড়াইল, বলিল–ঠাকুরমশায়, কবে ফিরলে? হাতে তেঁতুল, একটু নিয়ে এলাম হোটেল থেকে।

হাজারি মনে মনে হাসিল। হোটেল হইতে লুকাইয়া জিনিস সরাইবার অভ্যাস এখনও যায় নাই পদ্মদিদির!

হাজারি পাশ কাটাইয়া চলিয়া যাইবার চেষ্টা করিল, কিন্তু পদ্ম বলিল–শোনো, দাঁড়াও না ঠাকুরমশায়! কাল তোমাদের বাসায় গিয়েছিলাম যে! বলে নি বৌদিদি?

–হ্যাঁ হ্যাঁ বলচিল বটে।

–বৌদিদি লোক বড় ভাল, আমার সঙ্গে কত গল্প করলে। আর একদিন যাব।

–বা, যাবে বৈ কি পদ্মদিদি, তোমাদেরই বাড়ী। যখন ইচ্ছে হয় যাবে। হোটেল কেমন চলছে?

–তা মন্দ চলছে না। এককরম চলছে।

–বেশ বেশ। তাহলে এখন আসি পদ্মদিদি—

হাজারি চলিয়া গেল। ভাবিল–একরকম চলছে বললে অথচ কাল বাড়ীতে বসে গল্প করে এসেছে হোটেল আর চলে না, উঠে যাবে। পদ্মদিদি ভাঙে তো মচকায় না!

কুসুমের বাড়ীতে হাজারি অনেকক্ষণ কথাবার্তা বলিল। কথায়-কথায় নতুন গাঁয়ের বধুটির কথা মনে পড়াতে হাজারি বলিল–ভাল কথা কুসুম মা চেনো? এঁড়োশোলার বনমালীর স্ত্রীর ভাইঝি–তোমাকে দিদি বলে ডাকে একটি মেয়ে, বিয়ে হয়েছে নতুন গাঁ?

কুসুম বলিল–খুব চিনি। ওর নাম তো সুবাসিনী। ওকে কি করে জানলেন জ্যাঠা মশায়?

হাজারি বধুটির সম্বন্ধে সব কথা খুলিয়া বলিল, তাহার টাকা লইয়া আসা, হোটেলে তাহাকে অংশীদার করার সঙ্কল্প।

কুসুম বলিল–এ তো বড় খুশির কথা। আপনার হোটেলে টাকা খাটলে ওর ভবিষতে একটা হিল্লে হয়ে রইল।

–কিন্তু যদি আজ মরে যাই মা? তখন কোথায় থাকবে হোটেল?

–ও কথা বলতে নেই যাঠামশায়–ছিঃ

কুসুমের অবস্থা আজকাল ফিরিয়াছে। হাজারি তাহাকে শুধু মহাজন হিসাবে দেখে না, হোটেলের অংশীদার হিসাবে প্রতি মাসে ত্রিশ-বত্রিশ টাকা দেয়, মাসিক লাভের অংশরূপ।

কুসুম বলিল–অমন সব কথা বলেন কেন, ওতে আমার কষ্ট হয়। আপনি ছিলেন তাই আজ রাণাঘাট শহরে মাথা তুলে বেড়াতে পারছি, ছেলেপিলে দু-বেলা দু-মুঠো খেতে পাচ্ছে। এই বাড়ী বাঁধা রেখে গিয়েছিলেন শশুর, আপনাকে বলি নি সে-কথা, এতদিন বাড়ী বিক্রি হয়ে যেতো দেনার দায়ে যদি হোটেল থেকে টাকা না পেতাম মাস মাস। ওই টাকা দিয়ে দেনা সব শোধ করে ফেলেছি–এখন বাড়ী আমার নামে। আপনার দৌলতেই সব জ্যাঠামশায়– আমার চোখে আপনি দেবতা।

হাজারি বলিল–উঠি আজ মা। একবার ইষ্টিশানের হোটেলটাতে যাব। একদল বড় লোক টেলিগ্রাম করেছে কলকাতা থেকে, দার্জিলিং মেলের সময় এখানে খানা পাবে। তাদের জন্যে মাংসটা নিজে রাঁধবো। তারে তাই লেখা আছে।

দার্জিলিং মেলে চার-পাঁচটি বাবু নামিয়া হাজারির রেলওয়ে হোটেলে খাইতে আসিল। হাজারি নিজের হাতে মাংস রান্না করিয়াছিল। উহারা খাইয়া অত্যন্ত খুশী হইয়া গেল–হাজারিকে ডাকিয়া আলাপ করিল। উহাদের মধ্যে একজন বলিল–হাজারিবাবু, আপনার নাম কলকাতায় পৌঁচেছে জানেন তো? বড়ঘরে যারা পঞ্চাশ টাকা মাইনের ঠাকুর রাখে, তারা জানে রাণাঘাটের হিন্দু-হোটেলের হাজারি ঠাকুর খুব বড় রাঁধুনী। আমাদের সেইটে পরীক্ষা করে দেখবার জন্যে আজ আপনার এখানে আসা। তারে বলাও ছিল যাতে আপনি নিজে রাঁধেন। বড় খুশি হয়েছি খেয়ে।

.

ইহার কয়েক দিন পরে একখানা চিঠি আসিল কলিকাতা হইতে। সেদিন যাহারা রেলওয়ে হোটেলে খাইয়া গিয়াছিল তাহারা পুনরায় দেখা করিতে আসিতেছে আজ ওবেলা, বিশেষ জরুরী দরকার আছে। সাড়ে তিনটার কৃষ্ণনগর লোকালে দুইজন ভদ্রলোক নামিল। তাহাদের একজন সেদিনকার সেই লোকটি –যে হাজারির রান্নার অত সুখ্যাতি করিয়া গিয়াছিল। অন্য একজন বাঙালী নয়–কি জাত, হাজারি চিনিতে পারিল না।

পূর্বের ভদ্রলোকটি হাজারির সঙ্গে অবাঙালী ভদ্রলোকটির পরিচয় করাইয়া দিয়া হিন্দীতে বলিল–এর কথাই আপনাকে বলেছিলাম। এই সে হাজারি ঠাকুর।

অবাঙালী ভদ্রলোকটি হাসিমুখে হিন্দীতে কি বলিলেন, হাজারি ভাল বুঝিল না। বিনীত ভাবে বাঙালী বাবুটিকে বলিল যে সে হিন্দী বুঝিতে পারে না।

বাঙালী বাবুটি বলিলেন–শুনুন হাজারিবাবু, কথাটা বলি। আমার বন্ধু ইনি গুজরাটি। বড় ব্যবসাদা, ধুরন্ধর খাড্ডে কোম্পানীর বড় অংশীদার। জি. আই. পি. রেলের সব হিন্দু রেস্টোরান্টের কন্ট্রাক্ট হোল খাড্ডে কোম্পানি। ওরা আপনাকে বলতে এসেছে ওদের সব হোটেলের রান্না দেখাশুনা তদারক করবার জন্যে দেড়শো টাকা মাইনেতে আপনাকে রাখতে চায়। তিন বছরের এগ্রিমেন্ট। আপনার সব খরচ, রেলের যে কোনো জায়গায় যাওয়া-আসা, একজন চাকর ওরা দেবে। বম্বেতে ফ্রি কোয়ার্টার দেবে। যদি ওদের নাম দাঁড়িয়ে যায় আপনার রান্নার গুণে আপনাকে একটা অংশও ওরা দেবে। আপনি রাজী?

হাজারি নরেনকে ডাকিয়া আলোচনা করিল আড়ালে। মন্দ কি? কাজকর্ম এদিকে যাহা রহিল নরেন দেখাশুনা করিতে পারে। খরচ বাদে মাসে তিনি দেড় শত টাকা কম নয়–তা ছাড়া হোটেলের ব্যবসা সম্বন্ধে খুব একটা অভিজ্ঞতা লাভের সুযোগ এটি। এ হাতছাড়া করা উচিত হয় না–নরেনের ইহাই মত।

হাজারি আসিয়া বলিল–আমি রাজী আছি। কবে যেতে হবে বলুন। কি একটা কথা আছে-হিন্দী তো আমি তত জানিনে! কাজ চালাব কি করে?

বাঙালী বাবু বলিলেন–সেজন্যে ভাবনা নেই। দুদিন থাকলেই হিন্দী শিখে নেবেন। সই করুন এ কাগজে। এই আপনার কন্ট্রাক্ট ফর্ম, এই এ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার। দুজন সাক্ষী ডাকুন।

যদু বাঁড়ুয্যেকে ডাকিয়া আনা হইল তাহার হোটেল হইতে, অন্য সাক্ষী নরেন। কাগজ পরে হাঙ্গামা চুকিয়া গেলে উহারা চা-পানে আপ্যায়িত হইয়া ট্রেনে উঠিল। বাঙালী ভদ্রলোক বলিয়া গেল–মে মাসের পয়লা জয়েন করতে হবে আপনাকে বম্বেতে। আপনার ইন্টার ক্লাস রেলওয়ে পাস আসছে আর আমাদের লোকে আপনাকে সঙ্গে করে বম্বে পৌঁছে দেবে। তৈরী থাকবেন–আর পনেরো দিন বাকী।

.

হাজারি স্টেশন হইতে বাহির হইয়াই কুসুমের সঙ্গে একবার দেখা করিবে ভাবিল। এত বড় কথাটা কুসুমকে বলিতেই হইবে আগে। বোম্বাই! সে বোম্বাই যাইতেছে। দেড়শো টাকা মাহিনায়! বিশ্বাস হয় না। সব যেন স্বপ্নের মত ঘটিয়া গেল। টাকার জন্য নয়। টাকা এখানে সে মাসে দেড়শো টাকার বেশী ছাড়া কম রোজগার করে না। কিন্তু মানুষের জীবনে টাকাটাই কি সব? পাঁচটা দেশ দেখিয়া বেড়ানো, পাঁচজনের কাছে মান-খাতির পাওয়া, নূতনতর জীবনযাত্রার আস্বাদ–এ সবই তো আসল।

পিছন হইতে যদু বাঁড়ুয্যে ডাকিল–ও হাজারি-ভায়া, হাজারি-ভায়া শোন, হাজারি-ভায়া–

হাজারি কাছে যাইতেই যদু বাঁড়ুয্যে–রাণাঘাটের হোটেলের মালিকদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি যে–সেই যদু বাঁড়ুয্যে স্বয়ং নীচু হইয়া হাজারির পায়ের ধূলো লইতে গেল। বলিল–ধন্যি, খুব দেখালে ভায়া, হোটেল করে তোমার মত ভাগ্যি কারো ফেরে নি। পায়ের ধূলো দাও, তুমি সাধারণ লোক নও দেখছি–

হাজারি হা-হা করিয়া উঠিল।

–কি করেন বাঁড়ুয্যেমশায়–আমার দাদার সমান আপনি—ওকি—ওকি–আপনাদের বাপমায়ের আশীর্বাদে, আপনাদের আশীর্বাদে–একরকম করে খাচ্ছি–

যদু বাঁড়ুয্যে বলিল—এসো না ভায়া গরীবের হোটেলে একবার এক ছিলি তামাক খেয়ে যাও–এসো।

যদু বাঁড়ুয্যের অনুরোধ হাজারি এড়াইতে পারিল না। যদু চা খাওয়াইল, ছানার জিলাপি খাওয়াইল, নিজের হাতে তামাক সাজিয়া খাইতে দিল। স্বপ্ন না সত্য? এই যদু বাঁড়ুয্যে একদিন নিজের হোটেলে কাজ করিবার জন্য না ভাঙাইতে গিয়াছিল! তাহার মনিবের দরের মানুষ ছিল তিন বছর আগেও!

না, যথেষ্ট হইল তাহার জীবনে। ইহার বেশী আর সে কিছু চায় না। রাধাবল্লভ ঠাকুর তাহাকে অনেক দিয়াছেন। আশার অতিরিক্ত দিয়াছেন।

.

কুসুম শুনিয়া প্রথমে ঘোর আপত্তি তুলিয়া বলিল–জ্যাঠামশায় কি ভাবেন, এই বয়সে তাঁহাকে সে অত দূরে যাইতে কখনই দিবে না। জেঠিমাকে দিয়াও বারণ করাইবে। আর টাকার দরকার নাই। সে সাত সমুদ্র তেরো নদী পারের দেশে যাইতে হইবে এমন গরজ কিসের?

হাৰি বলিল–মা বেশীদিন থাকব না সেখানে। চুক্তি সই হয়ে গিয়েছে সাক্ষীদের সামনে। না গেলে ওরা খেসারতের দাবি করে নালিশ করতে পারে। আর একটা উদ্দেশ্য আছে কি জান মা, বড় বড় হোটেল কি করে চালায়, একবার নিজের চোখে দেখে আসি। আমার তো ঐ বাতিক, ব্যবসাতে যখন নেমেছি, তখন এর মধ্যে যা কিছু আছে শিখে নিয়ে তবে ছাড়ব। বাধা দিও না মা, তুমি বাধা দিলে তো ঠেলবার সাধ্যি নেই আমার।

টেঁপির মা ও টেঁপি কান্নাকাটি করিতে লাগিল। ইহাদের দুজনকে বুঝাইল নরেন। মামাবাবু কি নিরুদ্দেশ যাত্রা করিতেছেন? অত কান্নাকাটি করিবার কি আছে ইহার মধ্যে। বম্বে তো বাড়ীর কাছে, লোকে কত দূর-দূরান্ত যাইতেছে না চাকুরির জন্য?

সেই দিন রাত্রে হাজারি নরেনের মামা বংশীধর ঠাকুরকে ডাকিয়া বলিল–একটা কথা আছে। আমি তো আর দিন পনেরোর মধ্যে বোম্বাই যাচ্ছি। আমার ইচ্ছে যাবার আগে টেঁপির সঙ্গে নরেনের বিয়েটা দিয়ে যাব। নরেন এখানকার কারবার দেখাশুনা করবে–রেলের হোটেলটা ওকে নিজে দেখতে হবে–ওটাতেই মোটা লাভ। এতে তোমার কি মত?

বংশীধর অনেকদিন হইতেই এইরূপ কিছু ঘটিবে আঁচ করিয়া রাখিয়াছিল। বলিল হাজারিদা, আমি কি বলব, বল। তোমার সঙ্গে পাশাপাশি হোটেলে কাজ করেছি। আমরা সুখের সুখী দুঃখের দুঃখী হয়ে কাটিয়েছি বহুকাল। নরেনও তোমারই আপনার ছেলে। যা বলবে তুমি, তাতে আমার অমত কি? আর ওরও তো কেউ নেই–সবই জান তুমি। যা ভাল বোঝ কর।

দেনাপাওনার মীমাংসা অতি সহজেই মিটিল। হাজারি রেলওয়ে হোটেলটির স্বত্ব টেঁপির নামে লেখাপড়া করিয়া দিবে। তাহার অনুপস্থিতিতে নরেন ম্যানেজার হইয়া উভয় হোটেল চালাইবে–তবে বাজারের হোটেলের আয় হিসাবমত কুসুমকে ও টেঁপির মাকে ভাগ করিয়া দিতে থাকিবে।

বিবাহের দিন ধার্য্য হইয়া গেল।

টেঁপির মা বলিল–ওগো, তোমার মেয়ে বলছে অতসীকে নেমন্তন্ন করে পাঠাতে। ওর বড় বন্ধু ছিল–তাকে বিয়ের দিন আসতে লেখ না?

হাজারিও সে-কথা ভাবিয়াছে। অতসীর সঙ্গে আজ বহুদিন দেখা হয় নাই। সেই মেয়েটির অযাচিত করুণা আজ তাহাকে ও তার পরিবারবর্গকে লোকের চোখে সম্ভ্রান্ত করিয়া তুলিয়াছে। অতসীর শ্বশুরবাড়ীর ঠিকানা হাজারি জানিত না, কেবলমাত্র এইটুকু জানিত অতসীর শ্বশুর বর্ধমান জেলার মূলঘরের জমিদার। হাজারি চিঠিখানা তাহাদের গ্রামে অতসীর বাবার ঠিকানায় পাঠাইয়া দিল, কারণ সময় অত্যন্ত সংক্ষেপ। লিখিয়া ঠিকানা আনাইয়া পুনরায় পত্র লিখিবার সময় নাই।

.

বিবাহের কয়েকদিন পূর্বে হাজারি শ্ৰীমন্ত কাঁসারির দোকানে দানের বাসন কিনিতে গিয়াছে, শ্ৰীমন্ত বলিল–আসুন আসুন হাজারিবাবু, বসুন। ওরে বাবুকে তামাক দে রে–

হাজারি নিজের বাসনপত্র কিনিয়া উঠিবার সময় কতকগুলি পুরনো বাসনপত্র, পিতলের বালতি ইত্যাদি নূতন বাসনের দোকানে দেখিয়া বলিল–এগুলো কি হে শ্ৰীমন্ত? এগুলো তো পুরোনো মাল–ঢালাই করবে নাকি?

শ্ৰীমন্ত বলিল–ও-কথা আপনাকে বলব ভেবেছিলাম বাবু। ও আপনাদের পুরোনো হোটেলের পদ্মঝি রেখে গেছে–হয় বন্ধক নয় বিক্ৰী। আপনি জানেন না কিছু? চক্কত্তি মশায়ের হোটেল যে সীল হবে আজই। মহাজন ও বাড়ীওয়ালার দেনা একরাশ, তারা নালিশ করেছিল। তা বাবু পুরোনো মালগুলো নিন না কেন? আপনাদের হোটেলের কাজে লাগবে–বড় ডেকচি, পেতলের বালতি, বড় গামলা। সস্তা দরে বিক্রী হবে–ও বন্ধকী মালের হ্যাংনামা কে পোয়াবে বাবু, তার চেয়ে বিক্রীই করে দেবো–

হাজারি এত কথা জানিত না। বলিল–পদ্ম নিজে এসেছিল?

শ্রীমন্ত বলিল–হ্যাঁ, ওদের হোটেলের একটা চাকর সঙ্গে নিয়ে। হোটেল সীল হলে কাল একটা জিনিসও বার করা যাবে না ঘর থেকে, তাই রেখে গেল আমার এখানে। বলে গেল এগুলো বন্ধক রেখে কিছু টাকা দিতেই হবে; চক্কত্তি মশায়ের একেবারে নাকি অচল।

বাসনের দোকান হইতে বাহির হইয়া অন্য পাঁচটা কাজ মিটাইয়া হোটেলে ফিরিতে অনেক বেলা হইয়া গেল। একবার বেচু চক্কত্তির হোটেলে যাইবে ভাবিয়াছিল, কিন্তু তাহা আর ঘটিয়া উঠিল না।

কুসুম এ কয়দিন এ বাসাতেই বিবাহের আয়োজনের নানারকম বড়, ছোট, খুচরা কাজে সারাদিন লাগিয়া থাকে। হাজারি তাহাকে বাড়ী যাইতে দেয় না, বলে–মা, তুমি তো আমার ঘরের লোক, তুমি থাকলে আমার কত ভরসা। এখানেই থাক এ কটা দিন।

বিবাহের পূর্বদিন হাজারি অতসীর চিঠি পাইল। সে কৃষ্ণনগর লোকালে আসিতেছে, স্টেশনে যেন লোক থাকে।

আর কেহ অতসীকে চেনে না, কে তাহাকে স্টেশন হইতে চিনিয়া আনিবে, হাজারি নিজেই বৈকাল পাঁচটার সময় স্টেশনে গেল।

ইন্টার ক্লাস কামরা হইতে অতসী আর তাহার সঙ্গে একটি যুবক নামিল। কিন্তু তাহাদের অভ্যর্থনা করিতে কাছে গিয়া হাজারি যাহা দেখিল, তাহাতে তাহার মনে হইল পৃথিবীর সমস্ত আলো যেন এক মুহূর্তে মুছিয়া লেপিয়া অন্ধকারে একাকার হইয়া গিয়াছে তাহার চক্ষুর সন্মুখে।

অতসীর বিধবা বেশ।

অতসী হাজারির পায়ের ধূলা লইয়া প্রণাম করিয়া বলিল–কাকাবাবু, ভাল আছেন? ইনি কাকাবাবু–সুরেন। এ আমার ভাসুরপো। কলকাতায় পড়ে। অমন করে দাঁড়িয়ে রইলেন কেন?

–না—মা–ইয়ে, চলো–এস।

–ভাবছেন বুঝি এ আবার ঘাড়ে পড়ল দেখছি। দিয়েছিলাম একরকম বিদেয় করে আবার এসে পড়েছে সাত বোঝা নিয়ে–এই না? বাবা-কাকারা এমন নিষ্ঠুর বটে!

হাজারি হঠাৎ কাঁদিয়া উঠিল। এক প্ল্যাটফর্ম বিস্মিত জনতার মাঝখানে কি যে তাহার মনে হইতেছে তাহা সে কাহাকেও বুঝাইয়া বলিতে পারিবে না। মনের কোন স্থান যেন হঠাৎ বেদনায় টন টন করিয়া ভাঙিয়া পড়িতেছে। অতসীই তাহাকে শান্ত করিয়া নিজের আঁচলে তাহার চক্ষু মুছাইয়া প্ল্যাটফর্ম হইতে বাহির করিয়া আনিল। রেলওয়ে হোটেলের কাছে নরেন উহাদের অপেক্ষায় দাঁড়াইয়া ছিল। সে হাজারির দিকে চাহিয়া দেখিল হাজারি চোখ রাঙা, কেমন এক ভাব মুখে! অতসীর বিধবা বেশ দেখিয়াও সে বিস্মিত না হইয়া পারিল না, কারণ টেঁপির কাছে অতসীর সব কথাই সে শুনিয়াছিল ইতিমধ্যে–সবে আজ বছর তিন বিবাহ হইয়াছে তাহাও শুনিয়াছিল। অতসীদি বিধবা হইয়াছে এ কথা তো কেহ বলে নাই।

বাড়ী পৌঁছিয়া অতসী টেঁপিকে লইয়া বাড়ীর ছাদে অনেকক্ষণ কাটাইল। দুজনে বহুকাল পরে দেখা–সেই এঁডোশোলায় আজ প্রায় তিন বছর হইল তাহাদের ছাড়াছাড়ি, কত কথা যে জমা হইয়া আছে।

টেঁপি চোখের জল ফেলিল বাল্যসখীর এ অবস্থা দেখিয়া। অতসী বলিল–তোরা যদি সবাই মিলে কান্নাকাটি করবি, তা হলে কিন্তু চলে যাব ঠিক বলচি। এলাম বাপ-মায়ের কাছে বোনের কাছে একটু জুড়ুতে, না কেবল কান্না আর কেবল কান্না–সরে আয়, তোর এই দুল জোড়াটা পর তো দেখি কেমন হয়েছে–আর এই ব্রেসলেটটা, দেখি হাত–

টেঁপি হাত ছিনাইয়া লইয়া বলিল–এ তোমার ব্রেসলেট অতসী-দি, এ আমায় দিতে পারবে না–ককখনো না–

–তা হলে আমি মাথা কুটবো এই ছাদে, যদি না পরিস–সত্যি বলচি। আমার সাধ কেন মেটাতে দিবি নে?

টেঁপি আর প্রতিবাদ করি না। তাহার দুই চক্ষু জলে ভাসিয়া গেল, ওদিকে অতসী তাহার ডান হাত ধরিয়া তখন ঘুরাইয়া ঘুরাইয়া ব্রেসলেট পরাইতেছে।

হাজারি অনেক রাত্রে তামাক খাইতেছে, অতসী আসিয়া নিঃশব্দে পাশে দাঁড়াইয়া বলিল—কাকাবাবু!

হাজারি চমকিয়া উঠিয়া বলিল–অতসী মা? এখনও শোও নি?

–না কাকাবাবু। আজ তো সারাদিন আপনার সঙ্গে একটা কথাও হয় নি, তাই এলাম।

হাজারি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বলিল–এমন জানলে তোমায় আনতাম না মা। আমি কিছুই শুনি নি। কতদিন গাঁয়ে যাই নি তো! তোমার এ বেশ চোখে দেখতে কি নিয়ে এলাম মা তোমায়?

অতশী চুপ করিয়া রহিল। হাজারির স্নেহশীল পিতৃহৃদয়ের সান্নিধ্যের নিবিড়তায় সে যেন তাহার দুঃখের সান্ত্বনা পাইতে চায়।

হাজারি সস্নেহে তাহাকে কাছে বসাইল। কিছুক্ষণ কেহই কথা বলিল না। পরে অতসী বলিল–কাকাবাবু, আমি একদিন বলেছিলাম আপনার হোটেলের কাজেই উন্নতি হবে–মনে আছে?

–সব মনে আছে অতসী মা। তুলি নি কিছুই। আর না কিন্তু এখানকার ইষ্টাটপত্র–সব তো তোমার দয়াতেই মা–তুমি দয়া না করলে–

অতসী তিরস্কারের সুরে বলিল–ওকথা বলবেন না কাকাবাবু ছিঃ–আমি টাকা দিলেও আপনার ক্ষমতা না থাকলে কি সে টাকা বাড়তো? তিন বছরের মধ্যে এত বড় জিনিস করে ফেলতে পারত অন্য কেউ আনাড়ি লোক? আমি কিছুই জানতুম না কাকাবাবু, এখানে এসে সব দেখে শুনে অবাক হয়ে গিয়েছি। আপনি ক্ষমতাবান পুরুষমানুষ কাকাবাবু।

–এখন তুমি এঁড়োশোলায় যাবে মা, না আবার শ্বশুরবাড়ী যাবে?

–এঁড়োশোলাতেই যাবো। বাবা-মা দুঃখে সারা হয়ে আছেন। তাদের কাছে গিয়ে কিছুদিন থাকব। জানেন কাকাবাবু, আমার ইচ্ছে দেশে এমন একটা কিছু করব, যাতে সাধারণের উপকার হয়। বাবার টাকা সব এখন আমিই পাব, শ্বশুরবাড়ী থেকেও টাকা পাব। কিন্তু এ টাকার আমার কোন দরকার নেই কাকাবাবু। পাঁচজনের উপকারের জন্যে খরচ করেই সুখ।

–যা ভাল বোঝ মা কয়ে। আমি তোমায় কি বলব?

–কাকাবাবু, আপনি বম্বে যাচ্ছেন নাকি?

–হ্যাঁ মা।

অতসী ছেলেমানুষের মত আবদারের সুরে বলিল–আমায় নিয়ে যাবেন সঙ্গে করে? বেশ বাপেঝিয়ে থাকবো, আপনাকে রেঁধে দেব–আমার খুব ভালো লাগে দেশ বেড়াতে।

–যেও মা, এবারটা নয়। আমি তিন বছর থাকব সেখানে। দেখি কি রকম সুবিধে অসুবিধে হয়। এর পরে যেও।

–ঠিক কাকাবাবু? কেমন মনে থাকবে তো?

–ঠিক মনে থাকবে। যাও এখন শোও গিয়ে মা, অনেক কষ্ট হয়েছে গাড়িতে, সকাল সকাল বিশ্রাম কর গিয়ে।

.

পরদিন বিবাহ। টেঁপির নরম হাতখানি নরেনের বলিষ্ঠ পেশীবদ্ধ হাতে স্থাপন করিবার সময় হাজারির চোখে জল আসিল।

কতদিনের সাধ–এতদিনে ঠাকুর রাধাবল্লভ পূর্ণ করিলেন।

বংশীধর ঠাকুর বরকর্তা সাজিয়া বিবাহ-মজলিসে বসিয়া ছিল। সেও সে সময়টা আবেগপূর্ণ কণ্ঠে বলিয়া উঠিল–হাজারি-দা!

কাছাকাছি সব হোটেলের রাঁধুনী বামুনেরা তাহাদের আত্মীয়-স্বজন লইয়া যাত্রী সাজিয়া আসিয়াছে। এ বিবাহ হোটেলের জগতের, ভিন্ন জগতের কোনো লোকের নিমন্ত্রণ হয় নাই ইহাতে। ইহাদের উচ্চ কলরব, হাসি, ঠাট্টা ও হাঁকডাকে বাড়ী সরগরম হইয়া উঠিল।

বিবাহের পরদিন বর-কনে বিদায় হইয়া গেল। বেশীদূর উহারা যাইবে না। এই রাণাঘাটেই চূর্ণীর ধারে বংশীধর একখানা বাড়ী ভাড়া করিয়াছে পাঁচ দিনের জন্য। সেখানে দেশ হইতে বংশীধরের এক দূর-সম্পর্কের বিধবা পিসি (বংশীধরের স্ত্রী মারা গিয়াছে বহুদিন) আসিয়াছেন বিবাহের ব্যাপারে। বৌভাত সেখানেই হইবে।

.

হাজারি একবার রেলওয়ে হোটেলে কাজ দেখিতে যাইতেছে, বেলা আন্দাজ দশটা, বেচু চক্কত্তির হোটেলের সামনে ভিড় দেখিয়া থামিয়া গেল। কোর্টের পিওন, বেলিফ, ভিড়ের মধ্যে দাঁড়াইয়া আছে আর আছে রামরতন পালচৌধুৰী জমাদার। ব্যাপার কি জিজ্ঞাসা করিয়া জানিল মহাজনের দেনার দায়ে বেচু চক্কত্তির হোটেল শীল হইতেছে।

হাজারি কিছুক্ষণ থমকিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। তাহার পুরোনো মনিবের হোটেল, এইখানে সে দীর্ঘ সাত বৎসর সুখে-দুঃখে কাটাইয়াছে। এত দিনের হোটেলটা আজ উঠিয়া গেল! একটু পরে পদ্মঝি দু হাতে দুটি বড় বালতি লইয়া হোটেলের পিছনের দরজা দিয়া বাহির হইতেই একজন আদালতের পেয়াদা বেলিফের দৃষ্টি সেদিকে আকৃষ্ট করিল। বেলিফ সাক্ষী দুজনকে ডাকিয়া বলিল–এই দেখুন মশায়, ওই মেয়েলোকটা হোটেল থেকে জিনিস নিয়ে যাচ্ছে, এটা বে-আইনী। আমি পেয়াদাদের দিয়ে আটকে দিচ্ছি আপনাদের সামনে।

পেয়াদারা গিয়া বাধা দিয়া বলিল–বালতি রেখে যাও—

পরে আরও কাছে গিয়া হাঁক দিয়া বলিল–শুধু বালতি নয় বাবু, বালতির মধ্যে পেতল কাঁসার বাসন রয়েছে।

পদ্মঝি ততক্ষণে বালতি দুটা প্রাণপণে জোর করিয়া আঁটিয়া ধরিয়াছে। সে বলিল–এ বাসন আমার নিজের–হোটেল চক্কত্তি মশায়ের, আমার জিনিস উনি নিয়ে এসেছিলেন, এখন আমি নিয়ে যাচ্ছি।

পেয়াদারা ছাড়িবার পাত্র নয়। অবশ্য পদ্মঝিও নয়। উভয় পক্ষে বাকবিতণ্ডা, অবশেষে টানাহেঁচড়া হইবার উপক্রম হইল। মজা দেখিবার লোক জুটিয়া গেল বিস্তর।

একজন মহাজন পাওনাদার বলিল–আমি এই সকলের সামনে বলচি, বাসন নামিয়ে যদি না রাখো তবে আদালতের আইন অমান্য করবার জন্যে আমি তোমাকে পুলিশে দেবো।

একজন সাক্ষী বলিল –তা দেবেন কেমন করে বাপু? ওর নামে তো ডিক্রি নেই আদালতের। ও আদালতের ডিক্রি মানতে যাবে কেন?

বেলিফ বলিল–তা নয়, ওকে চুরির চার্জে ফেলে পুলিশে দেওয়া চলবে। এ হোটেল এখন মহাজন পাওনাদারের। তার ঘর থেকে অপরের জিনিস নিয়ে যাবার রাইট কি? ওকে জিজ্ঞেস করো ও ভালোয় ভালোয় দেবে কিনা–

পদ্মঝি তা দিতে রাজী নয়। সে আরও জোর করিয়া আঁকড়াইয়া আছে বাতি দুটি। বেলিফ বলিল–কেড়ে নাও মাল ওর কাছ থেকে–বদমাইশ মাগী কোথাকার–ভাল কথায় কেউ নয়।

পেয়াদারা এবার বীরদর্পে আসিয়া গেল। পুনরায় একচোট ধস্তাধস্তির সূত্রপাত হইবার উপক্রম হইতেই হাজারি সেখানে গিয়া দাঁড়াইয়া বলিল–পদ্মদিদি, বাসন ওদের দিয়ে দাও।

লজ্জায় ও অপমানে পদ্মঝিয়ের চোখে তখন জল আসিয়াছে। জনতার সামনে দাঁড়াইয়া এমন অপমানিত সে কখনো হয় নাই। এই সময় হাজারিকে দেখিয়া সে হাউ হাউ করিয়া কাঁদিয়া ফেলিল।

–এই দেখোনা ঠাকুর মশায়, তুমি তো কতদিন আমাদের হোটেলে ছিলে–এ আমার জিনিস না? বলো না তুমি, এ বালতি কার?

হাজারি সান্ত্বনার সুরে বলিল–কেঁদো না এমন করে পদ্মদিদি। এ হোল আইন-আদালতের ব্যাপার। বাসন রেখে এসো ঘরের মধ্যে, আমি দেখছি তারপর কি ব্যবস্থা করা যায়–

অবশ্য তখন কিন্তু করিবার উপায় ছিল না। সে আদালতের বেলিফকে জিজ্ঞাসা করিল–কি করলে এদের হোটেল আবার বজায় থাকে?

–টাকা চুকিয়ে দিলে। এ অতি সোজা কথা মশাই। সাড়ে সাতশো টাকার দাবীতে নালিশ–এখনও ডিক্রী হয় নি। বিচারের আগে সম্পত্তি সীল না করলে দেনাদার ইতিমধ্যে মাল হস্তান্তর করতে পারে, তাই সীল করা।

আদালতের পেয়াদারা কাজ শেষ করিয়া চলিয়া গেল। বেচু চক্কত্তিকে একবারে ডাকিয়া হাজারি বলিল–আমার সঙ্গে চলুন না কর্তা মশায় একবার ইষ্টিশনের দিকে–আসুন, কথা আছে।

রেলের হোটেলে নিজের ঘরটিতে বেচু চক্কত্তিকে বসাইয়া হাজারি বলিল–কর্তা একটু চা খাবেন?

বেচু চক্কত্তির মন খারাপ খুবই। চা খাইতে প্রথমটা চাহে নাই, হাজারি কিছুতেই ছাড়িল না। চা পান ও জলযোগান্তে বেচু বলিল–হাজারি, তুমি তো সাত-আট বছর আমার সঙ্গে ছিলে, জানো তো সবই, হোটেলটা ছিল আমার প্রাণ। আজ বাইশ বছর হোটেল চালাচ্ছি –এখন কোথায় যাই আর কি করি। পৈতৃক জোতজমা ঘরদোর যা ছিল ফুলে-নবলায়, সে এখন আর কিছু নেই, ওই হোটেলই ছিল বাড়ী। এমন কষ্ট হয়েছে, এই বুড়ো বয়সে এখন দাঁড়াই কোথায়? চালাই কী করে?

–এমন অবস্থা হোল কি করে কর্তা? দেনা বাধালেন কী করে?

–খরচে আয়ে এদানীং কুলোতো না হাজারি। দু-বার বাসন চুরি হয়ে গেল। ছোট হোটেল, আর কত ধাক্কা সইবার জান ছিল ওর! কাবু হয়ে পড়লো। খদ্দের কমে গেল। বাড়ীভাড়া জমতে লাগলো–এসব নানা উৎপাত–

হাজারি বেচু চক্কত্তিকে তামাক সাজিয়া দিয়া বলিল–কর্তা, একটা কথা আছে বলি। আপনি আমার পুরনো মনিব, আমার যদি টাকা এখন থাকতো, আপনার হোটেলের সীল আমি খুলিয়ে দিতাম। কিন্তু কাল মেয়ের বিয়ে দিয়ে এখন অত টাকা আমার হাতে নেই। তাই বলচি, যতদিন বম্বে থেকে না ফিরি, আপনি আমার বাজারের হোটেলের ম্যানেজার হয়ে হোটেল চালান। পঁচিশ টাকা করে আপনার খরচ দেবো। (হাজারি মাহিনার কথাটা মনিবকে বলিতে পারিল না।) খাবেন দাবেন হোটেলে, আর পদ্মাদিদিও ওখানে থাকবে, মাইনে পাবে, খাবে। কি বলেন আপনি?

বেচু চক্কত্তির পক্ষে ইহা অস্বপনের স্বপন। এ আশা সে কখনো করে নাই। রেলবাজারের অত বড় কারবারী হোটেলের সে ম্যানেজার হইবে। পদ্মঝিও খবরটা পাইয়াছিল বোধ হয় বেচুর কাছেই, সেদিন সন্ধ্যাবেলা সে কুসুমের বাড়ী গেল। কুসুম উহাকে দেখিয়া কিছু আশ্চৰ্য্য না হইয়া পারিল না, কারণ জীবনে কোনোদিন পদ্মঝি কুসুমের দোর মাড়ায় নাই।

–এসো পদ্মপিসি বসো। আমার কি ভাগ্যি। এই পিঁড়িখানতে বোসো পিসি। পান-দোক্তা খাও? বসো পিসি, সেজে পানি–

পদ্মঝি বসিয়া পান খাইয়া অনেকক্ষণ ধরিয়া কুসুমের সঙ্গে এ-গল্প ও-গল্প করিল। পদ্ম বুঝিতে পারিয়াছে কুসুমও তাহার এক মনিব। ইহাদের সকলকে সন্তুষ্ট রাখিয়া তবে চাকুরি বজায় রাখা। যদিও সে মনে মনে জানে, চাকুরি বেশী দিন তাহাকে করিতে হইবে না। আবার একটা হোটেল নিজেরাই খুলিবে, তবে বিপদের দিনগুলিতে একটা কোনো আশ্রয়ে কিছুদিন মাথা গুঁজিয়া থাকা।

১১

হাজারি এদিকের সব কাজ মিটাইয়া কুসুমের বাড়ী যাইবার জন্য রওনা হইল, পথে হঠাৎ পদ্মঝিয়ের সঙ্গে দেখা। পদ্মঝিয়ের পরনে মলিন বস্ত্র। কখনও হাজারি জীবনে যাহা দেখে নাই।

হাজারি বলিল–হাতে কি পদ্মদিদি? যাচ্ছ কোথায়?

পদ্ম হাজারিকে দেখিয়া দাঁড়াইল, বলিল–ঠাকুরমশায়, কবে ফিরলে? হাতে তেঁতুল, একটু নিয়ে এলাম হোটেল থেকে।

হাজারি মনে মনে হাসিল। হোটেল হইতে লুকাইয়া জিনিস সরাইবার অভ্যাস এখনও যায় নাই পদ্মদিদির!

হাজারি পাশ কাটাইয়া চলিয়া যাইবার চেষ্টা করিল, কিন্তু পদ্ম বলিল–শোনো, দাঁড়াও না ঠাকুরমশায়! কাল তোমাদের বাসায় গিয়েছিলাম যে! বলে নি বৌদিদি?

–হ্যাঁ হ্যাঁ বলচিল বটে।

–বৌদিদি লোক বড় ভাল, আমার সঙ্গে কত গল্প করলে। আর একদিন যাব।

–বা, যাবে বৈ কি পদ্মদিদি, তোমাদেরই বাড়ী। যখন ইচ্ছে হয় যাবে। হোটেল কেমন চলছে?

–তা মন্দ চলছে না। এককরম চলছে।

–বেশ বেশ। তাহলে এখন আসি পদ্মদিদি—

হাজারি চলিয়া গেল। ভাবিল–একরকম চলছে বললে অথচ কাল বাড়ীতে বসে গল্প করে এসেছে হোটেল আর চলে না, উঠে যাবে। পদ্মদিদি ভাঙে তো মচকায় না!

কুসুমের বাড়ীতে হাজারি অনেকক্ষণ কথাবার্তা বলিল। কথায়-কথায় নতুন গাঁয়ের বধুটির কথা মনে পড়াতে হাজারি বলিল–ভাল কথা কুসুম মা চেনো? এঁড়োশোলার বনমালীর স্ত্রীর ভাইঝি–তোমাকে দিদি বলে ডাকে একটি মেয়ে, বিয়ে হয়েছে নতুন গাঁ?

কুসুম বলিল–খুব চিনি। ওর নাম তো সুবাসিনী। ওকে কি করে জানলেন জ্যাঠা মশায়?

হাজারি বধুটির সম্বন্ধে সব কথা খুলিয়া বলিল, তাহার টাকা লইয়া আসা, হোটেলে তাহাকে অংশীদার করার সঙ্কল্প।

কুসুম বলিল–এ তো বড় খুশির কথা। আপনার হোটেলে টাকা খাটলে ওর ভবিষতে একটা হিল্লে হয়ে রইল।

–কিন্তু যদি আজ মরে যাই মা? তখন কোথায় থাকবে হোটেল?

–ও কথা বলতে নেই যাঠামশায়–ছিঃ

কুসুমের অবস্থা আজকাল ফিরিয়াছে। হাজারি তাহাকে শুধু মহাজন হিসাবে দেখে না, হোটেলের অংশীদার হিসাবে প্রতি মাসে ত্রিশ-বত্রিশ টাকা দেয়, মাসিক লাভের অংশরূপ।

কুসুম বলিল–অমন সব কথা বলেন কেন, ওতে আমার কষ্ট হয়। আপনি ছিলেন তাই আজ রাণাঘাট শহরে মাথা তুলে বেড়াতে পারছি, ছেলেপিলে দু-বেলা দু-মুঠো খেতে পাচ্ছে। এই বাড়ী বাঁধা রেখে গিয়েছিলেন শশুর, আপনাকে বলি নি সে-কথা, এতদিন বাড়ী বিক্রি হয়ে যেতো দেনার দায়ে যদি হোটেল থেকে টাকা না পেতাম মাস মাস। ওই টাকা দিয়ে দেনা সব শোধ করে ফেলেছি–এখন বাড়ী আমার নামে। আপনার দৌলতেই সব জ্যাঠামশায়– আমার চোখে আপনি দেবতা।

হাজারি বলিল–উঠি আজ মা। একবার ইষ্টিশানের হোটেলটাতে যাব। একদল বড় লোক টেলিগ্রাম করেছে কলকাতা থেকে, দার্জিলিং মেলের সময় এখানে খানা পাবে। তাদের জন্যে মাংসটা নিজে রাঁধবো। তারে তাই লেখা আছে।

দার্জিলিং মেলে চার-পাঁচটি বাবু নামিয়া হাজারির রেলওয়ে হোটেলে খাইতে আসিল। হাজারি নিজের হাতে মাংস রান্না করিয়াছিল। উহারা খাইয়া অত্যন্ত খুশী হইয়া গেল–হাজারিকে ডাকিয়া আলাপ করিল। উহাদের মধ্যে একজন বলিল–হাজারিবাবু, আপনার নাম কলকাতায় পৌঁচেছে জানেন তো? বড়ঘরে যারা পঞ্চাশ টাকা মাইনের ঠাকুর রাখে, তারা জানে রাণাঘাটের হিন্দু-হোটেলের হাজারি ঠাকুর খুব বড় রাঁধুনী। আমাদের সেইটে পরীক্ষা করে দেখবার জন্যে আজ আপনার এখানে আসা। তারে বলাও ছিল যাতে আপনি নিজে রাঁধেন। বড় খুশি হয়েছি খেয়ে।

.

ইহার কয়েক দিন পরে একখানা চিঠি আসিল কলিকাতা হইতে। সেদিন যাহারা রেলওয়ে হোটেলে খাইয়া গিয়াছিল তাহারা পুনরায় দেখা করিতে আসিতেছে আজ ওবেলা, বিশেষ জরুরী দরকার আছে। সাড়ে তিনটার কৃষ্ণনগর লোকালে দুইজন ভদ্রলোক নামিল। তাহাদের একজন সেদিনকার সেই লোকটি –যে হাজারির রান্নার অত সুখ্যাতি করিয়া গিয়াছিল। অন্য একজন বাঙালী নয়–কি জাত, হাজারি চিনিতে পারিল না।

পূর্বের ভদ্রলোকটি হাজারির সঙ্গে অবাঙালী ভদ্রলোকটির পরিচয় করাইয়া দিয়া হিন্দীতে বলিল–এর কথাই আপনাকে বলেছিলাম। এই সে হাজারি ঠাকুর।

অবাঙালী ভদ্রলোকটি হাসিমুখে হিন্দীতে কি বলিলেন, হাজারি ভাল বুঝিল না। বিনীত ভাবে বাঙালী বাবুটিকে বলিল যে সে হিন্দী বুঝিতে পারে না।

বাঙালী বাবুটি বলিলেন–শুনুন হাজারিবাবু, কথাটা বলি। আমার বন্ধু ইনি গুজরাটি। বড় ব্যবসাদা, ধুরন্ধর খাড্ডে কোম্পানীর বড় অংশীদার। জি. আই. পি. রেলের সব হিন্দু রেস্টোরান্টের কন্ট্রাক্ট হোল খাড্ডে কোম্পানি। ওরা আপনাকে বলতে এসেছে ওদের সব হোটেলের রান্না দেখাশুনা তদারক করবার জন্যে দেড়শো টাকা মাইনেতে আপনাকে রাখতে চায়। তিন বছরের এগ্রিমেন্ট। আপনার সব খরচ, রেলের যে কোনো জায়গায় যাওয়া-আসা, একজন চাকর ওরা দেবে। বম্বেতে ফ্রি কোয়ার্টার দেবে। যদি ওদের নাম দাঁড়িয়ে যায় আপনার রান্নার গুণে আপনাকে একটা অংশও ওরা দেবে। আপনি রাজী?

হাজারি নরেনকে ডাকিয়া আলোচনা করিল আড়ালে। মন্দ কি? কাজকর্ম এদিকে যাহা রহিল নরেন দেখাশুনা করিতে পারে। খরচ বাদে মাসে তিনি দেড় শত টাকা কম নয়–তা ছাড়া হোটেলের ব্যবসা সম্বন্ধে খুব একটা অভিজ্ঞতা লাভের সুযোগ এটি। এ হাতছাড়া করা উচিত হয় না–নরেনের ইহাই মত।

হাজারি আসিয়া বলিল–আমি রাজী আছি। কবে যেতে হবে বলুন। কি একটা কথা আছে-হিন্দী তো আমি তত জানিনে! কাজ চালাব কি করে?

বাঙালী বাবু বলিলেন–সেজন্যে ভাবনা নেই। দুদিন থাকলেই হিন্দী শিখে নেবেন। সই করুন এ কাগজে। এই আপনার কন্ট্রাক্ট ফর্ম, এই এ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার। দুজন সাক্ষী ডাকুন।

যদু বাঁড়ুয্যেকে ডাকিয়া আনা হইল তাহার হোটেল হইতে, অন্য সাক্ষী নরেন। কাগজ পরে হাঙ্গামা চুকিয়া গেলে উহারা চা-পানে আপ্যায়িত হইয়া ট্রেনে উঠিল। বাঙালী ভদ্রলোক বলিয়া গেল–মে মাসের পয়লা জয়েন করতে হবে আপনাকে বম্বেতে। আপনার ইন্টার ক্লাস রেলওয়ে পাস আসছে আর আমাদের লোকে আপনাকে সঙ্গে করে বম্বে পৌঁছে দেবে। তৈরী থাকবেন–আর পনেরো দিন বাকী।

.

হাজারি স্টেশন হইতে বাহির হইয়াই কুসুমের সঙ্গে একবার দেখা করিবে ভাবিল। এত বড় কথাটা কুসুমকে বলিতেই হইবে আগে। বোম্বাই! সে বোম্বাই যাইতেছে। দেড়শো টাকা মাহিনায়! বিশ্বাস হয় না। সব যেন স্বপ্নের মত ঘটিয়া গেল। টাকার জন্য নয়। টাকা এখানে সে মাসে দেড়শো টাকার বেশী ছাড়া কম রোজগার করে না। কিন্তু মানুষের জীবনে টাকাটাই কি সব? পাঁচটা দেশ দেখিয়া বেড়ানো, পাঁচজনের কাছে মান-খাতির পাওয়া, নূতনতর জীবনযাত্রার আস্বাদ–এ সবই তো আসল।

পিছন হইতে যদু বাঁড়ুয্যে ডাকিল–ও হাজারি-ভায়া, হাজারি-ভায়া শোন, হাজারি-ভায়া–

হাজারি কাছে যাইতেই যদু বাঁড়ুয্যে–রাণাঘাটের হোটেলের মালিকদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি যে–সেই যদু বাঁড়ুয্যে স্বয়ং নীচু হইয়া হাজারির পায়ের ধূলো লইতে গেল। বলিল–ধন্যি, খুব দেখালে ভায়া, হোটেল করে তোমার মত ভাগ্যি কারো ফেরে নি। পায়ের ধূলো দাও, তুমি সাধারণ লোক নও দেখছি–

হাজারি হা-হা করিয়া উঠিল।

–কি করেন বাঁড়ুয্যেমশায়–আমার দাদার সমান আপনি—ওকি—ওকি–আপনাদের বাপমায়ের আশীর্বাদে, আপনাদের আশীর্বাদে–একরকম করে খাচ্ছি–

যদু বাঁড়ুয্যে বলিল—এসো না ভায়া গরীবের হোটেলে একবার এক ছিলি তামাক খেয়ে যাও–এসো।

যদু বাঁড়ুয্যের অনুরোধ হাজারি এড়াইতে পারিল না। যদু চা খাওয়াইল, ছানার জিলাপি খাওয়াইল, নিজের হাতে তামাক সাজিয়া খাইতে দিল। স্বপ্ন না সত্য? এই যদু বাঁড়ুয্যে একদিন নিজের হোটেলে কাজ করিবার জন্য না ভাঙাইতে গিয়াছিল! তাহার মনিবের দরের মানুষ ছিল তিন বছর আগেও!

না, যথেষ্ট হইল তাহার জীবনে। ইহার বেশী আর সে কিছু চায় না। রাধাবল্লভ ঠাকুর তাহাকে অনেক দিয়াছেন। আশার অতিরিক্ত দিয়াছেন।

.

কুসুম শুনিয়া প্রথমে ঘোর আপত্তি তুলিয়া বলিল–জ্যাঠামশায় কি ভাবেন, এই বয়সে তাঁহাকে সে অত দূরে যাইতে কখনই দিবে না। জেঠিমাকে দিয়াও বারণ করাইবে। আর টাকার দরকার নাই। সে সাত সমুদ্র তেরো নদী পারের দেশে যাইতে হইবে এমন গরজ কিসের?

হাৰি বলিল–মা বেশীদিন থাকব না সেখানে। চুক্তি সই হয়ে গিয়েছে সাক্ষীদের সামনে। না গেলে ওরা খেসারতের দাবি করে নালিশ করতে পারে। আর একটা উদ্দেশ্য আছে কি জান মা, বড় বড় হোটেল কি করে চালায়, একবার নিজের চোখে দেখে আসি। আমার তো ঐ বাতিক, ব্যবসাতে যখন নেমেছি, তখন এর মধ্যে যা কিছু আছে শিখে নিয়ে তবে ছাড়ব। বাধা দিও না মা, তুমি বাধা দিলে তো ঠেলবার সাধ্যি নেই আমার।

টেঁপির মা ও টেঁপি কান্নাকাটি করিতে লাগিল। ইহাদের দুজনকে বুঝাইল নরেন। মামাবাবু কি নিরুদ্দেশ যাত্রা করিতেছেন? অত কান্নাকাটি করিবার কি আছে ইহার মধ্যে। বম্বে তো বাড়ীর কাছে, লোকে কত দূর-দূরান্ত যাইতেছে না চাকুরির জন্য?

সেই দিন রাত্রে হাজারি নরেনের মামা বংশীধর ঠাকুরকে ডাকিয়া বলিল–একটা কথা আছে। আমি তো আর দিন পনেরোর মধ্যে বোম্বাই যাচ্ছি। আমার ইচ্ছে যাবার আগে টেঁপির সঙ্গে নরেনের বিয়েটা দিয়ে যাব। নরেন এখানকার কারবার দেখাশুনা করবে–রেলের হোটেলটা ওকে নিজে দেখতে হবে–ওটাতেই মোটা লাভ। এতে তোমার কি মত?

বংশীধর অনেকদিন হইতেই এইরূপ কিছু ঘটিবে আঁচ করিয়া রাখিয়াছিল। বলিল হাজারিদা, আমি কি বলব, বল। তোমার সঙ্গে পাশাপাশি হোটেলে কাজ করেছি। আমরা সুখের সুখী দুঃখের দুঃখী হয়ে কাটিয়েছি বহুকাল। নরেনও তোমারই আপনার ছেলে। যা বলবে তুমি, তাতে আমার অমত কি? আর ওরও তো কেউ নেই–সবই জান তুমি। যা ভাল বোঝ কর।

দেনাপাওনার মীমাংসা অতি সহজেই মিটিল। হাজারি রেলওয়ে হোটেলটির স্বত্ব টেঁপির নামে লেখাপড়া করিয়া দিবে। তাহার অনুপস্থিতিতে নরেন ম্যানেজার হইয়া উভয় হোটেল চালাইবে–তবে বাজারের হোটেলের আয় হিসাবমত কুসুমকে ও টেঁপির মাকে ভাগ করিয়া দিতে থাকিবে।

বিবাহের দিন ধার্য্য হইয়া গেল।

টেঁপির মা বলিল–ওগো, তোমার মেয়ে বলছে অতসীকে নেমন্তন্ন করে পাঠাতে। ওর বড় বন্ধু ছিল–তাকে বিয়ের দিন আসতে লেখ না?

হাজারিও সে-কথা ভাবিয়াছে। অতসীর সঙ্গে আজ বহুদিন দেখা হয় নাই। সেই মেয়েটির অযাচিত করুণা আজ তাহাকে ও তার পরিবারবর্গকে লোকের চোখে সম্ভ্রান্ত করিয়া তুলিয়াছে। অতসীর শ্বশুরবাড়ীর ঠিকানা হাজারি জানিত না, কেবলমাত্র এইটুকু জানিত অতসীর শ্বশুর বর্ধমান জেলার মূলঘরের জমিদার। হাজারি চিঠিখানা তাহাদের গ্রামে অতসীর বাবার ঠিকানায় পাঠাইয়া দিল, কারণ সময় অত্যন্ত সংক্ষেপ। লিখিয়া ঠিকানা আনাইয়া পুনরায় পত্র লিখিবার সময় নাই।

.

বিবাহের কয়েকদিন পূর্বে হাজারি শ্ৰীমন্ত কাঁসারির দোকানে দানের বাসন কিনিতে গিয়াছে, শ্ৰীমন্ত বলিল–আসুন আসুন হাজারিবাবু, বসুন। ওরে বাবুকে তামাক দে রে–

হাজারি নিজের বাসনপত্র কিনিয়া উঠিবার সময় কতকগুলি পুরনো বাসনপত্র, পিতলের বালতি ইত্যাদি নূতন বাসনের দোকানে দেখিয়া বলিল–এগুলো কি হে শ্ৰীমন্ত? এগুলো তো পুরোনো মাল–ঢালাই করবে নাকি?

শ্ৰীমন্ত বলিল–ও-কথা আপনাকে বলব ভেবেছিলাম বাবু। ও আপনাদের পুরোনো হোটেলের পদ্মঝি রেখে গেছে–হয় বন্ধক নয় বিক্ৰী। আপনি জানেন না কিছু? চক্কত্তি মশায়ের হোটেল যে সীল হবে আজই। মহাজন ও বাড়ীওয়ালার দেনা একরাশ, তারা নালিশ করেছিল। তা বাবু পুরোনো মালগুলো নিন না কেন? আপনাদের হোটেলের কাজে লাগবে–বড় ডেকচি, পেতলের বালতি, বড় গামলা। সস্তা দরে বিক্রী হবে–ও বন্ধকী মালের হ্যাংনামা কে পোয়াবে বাবু, তার চেয়ে বিক্রীই করে দেবো–

হাজারি এত কথা জানিত না। বলিল–পদ্ম নিজে এসেছিল?

শ্রীমন্ত বলিল–হ্যাঁ, ওদের হোটেলের একটা চাকর সঙ্গে নিয়ে। হোটেল সীল হলে কাল একটা জিনিসও বার করা যাবে না ঘর থেকে, তাই রেখে গেল আমার এখানে। বলে গেল এগুলো বন্ধক রেখে কিছু টাকা দিতেই হবে; চক্কত্তি মশায়ের একেবারে নাকি অচল।

বাসনের দোকান হইতে বাহির হইয়া অন্য পাঁচটা কাজ মিটাইয়া হোটেলে ফিরিতে অনেক বেলা হইয়া গেল। একবার বেচু চক্কত্তির হোটেলে যাইবে ভাবিয়াছিল, কিন্তু তাহা আর ঘটিয়া উঠিল না।

কুসুম এ কয়দিন এ বাসাতেই বিবাহের আয়োজনের নানারকম বড়, ছোট, খুচরা কাজে সারাদিন লাগিয়া থাকে। হাজারি তাহাকে বাড়ী যাইতে দেয় না, বলে–মা, তুমি তো আমার ঘরের লোক, তুমি থাকলে আমার কত ভরসা। এখানেই থাক এ কটা দিন।

বিবাহের পূর্বদিন হাজারি অতসীর চিঠি পাইল। সে কৃষ্ণনগর লোকালে আসিতেছে, স্টেশনে যেন লোক থাকে।

আর কেহ অতসীকে চেনে না, কে তাহাকে স্টেশন হইতে চিনিয়া আনিবে, হাজারি নিজেই বৈকাল পাঁচটার সময় স্টেশনে গেল।

ইন্টার ক্লাস কামরা হইতে অতসী আর তাহার সঙ্গে একটি যুবক নামিল। কিন্তু তাহাদের অভ্যর্থনা করিতে কাছে গিয়া হাজারি যাহা দেখিল, তাহাতে তাহার মনে হইল পৃথিবীর সমস্ত আলো যেন এক মুহূর্তে মুছিয়া লেপিয়া অন্ধকারে একাকার হইয়া গিয়াছে তাহার চক্ষুর সন্মুখে।

অতসীর বিধবা বেশ।

অতসী হাজারির পায়ের ধূলা লইয়া প্রণাম করিয়া বলিল–কাকাবাবু, ভাল আছেন? ইনি কাকাবাবু–সুরেন। এ আমার ভাসুরপো। কলকাতায় পড়ে। অমন করে দাঁড়িয়ে রইলেন কেন?

–না—মা–ইয়ে, চলো–এস।

–ভাবছেন বুঝি এ আবার ঘাড়ে পড়ল দেখছি। দিয়েছিলাম একরকম বিদেয় করে আবার এসে পড়েছে সাত বোঝা নিয়ে–এই না? বাবা-কাকারা এমন নিষ্ঠুর বটে!

হাজারি হঠাৎ কাঁদিয়া উঠিল। এক প্ল্যাটফর্ম বিস্মিত জনতার মাঝখানে কি যে তাহার মনে হইতেছে তাহা সে কাহাকেও বুঝাইয়া বলিতে পারিবে না। মনের কোন স্থান যেন হঠাৎ বেদনায় টন টন করিয়া ভাঙিয়া পড়িতেছে। অতসীই তাহাকে শান্ত করিয়া নিজের আঁচলে তাহার চক্ষু মুছাইয়া প্ল্যাটফর্ম হইতে বাহির করিয়া আনিল। রেলওয়ে হোটেলের কাছে নরেন উহাদের অপেক্ষায় দাঁড়াইয়া ছিল। সে হাজারির দিকে চাহিয়া দেখিল হাজারি চোখ রাঙা, কেমন এক ভাব মুখে! অতসীর বিধবা বেশ দেখিয়াও সে বিস্মিত না হইয়া পারিল না, কারণ টেঁপির কাছে অতসীর সব কথাই সে শুনিয়াছিল ইতিমধ্যে–সবে আজ বছর তিন বিবাহ হইয়াছে তাহাও শুনিয়াছিল। অতসীদি বিধবা হইয়াছে এ কথা তো কেহ বলে নাই।

বাড়ী পৌঁছিয়া অতসী টেঁপিকে লইয়া বাড়ীর ছাদে অনেকক্ষণ কাটাইল। দুজনে বহুকাল পরে দেখা–সেই এঁডোশোলায় আজ প্রায় তিন বছর হইল তাহাদের ছাড়াছাড়ি, কত কথা যে জমা হইয়া আছে।

টেঁপি চোখের জল ফেলিল বাল্যসখীর এ অবস্থা দেখিয়া। অতসী বলিল–তোরা যদি সবাই মিলে কান্নাকাটি করবি, তা হলে কিন্তু চলে যাব ঠিক বলচি। এলাম বাপ-মায়ের কাছে বোনের কাছে একটু জুড়ুতে, না কেবল কান্না আর কেবল কান্না–সরে আয়, তোর এই দুল জোড়াটা পর তো দেখি কেমন হয়েছে–আর এই ব্রেসলেটটা, দেখি হাত–

টেঁপি হাত ছিনাইয়া লইয়া বলিল–এ তোমার ব্রেসলেট অতসী-দি, এ আমায় দিতে পারবে না–ককখনো না–

–তা হলে আমি মাথা কুটবো এই ছাদে, যদি না পরিস–সত্যি বলচি। আমার সাধ কেন মেটাতে দিবি নে?

টেঁপি আর প্রতিবাদ করি না। তাহার দুই চক্ষু জলে ভাসিয়া গেল, ওদিকে অতসী তাহার ডান হাত ধরিয়া তখন ঘুরাইয়া ঘুরাইয়া ব্রেসলেট পরাইতেছে।

হাজারি অনেক রাত্রে তামাক খাইতেছে, অতসী আসিয়া নিঃশব্দে পাশে দাঁড়াইয়া বলিল—কাকাবাবু!

হাজারি চমকিয়া উঠিয়া বলিল–অতসী মা? এখনও শোও নি?

–না কাকাবাবু। আজ তো সারাদিন আপনার সঙ্গে একটা কথাও হয় নি, তাই এলাম।

হাজারি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বলিল–এমন জানলে তোমায় আনতাম না মা। আমি কিছুই শুনি নি। কতদিন গাঁয়ে যাই নি তো! তোমার এ বেশ চোখে দেখতে কি নিয়ে এলাম মা তোমায়?

অতশী চুপ করিয়া রহিল। হাজারির স্নেহশীল পিতৃহৃদয়ের সান্নিধ্যের নিবিড়তায় সে যেন তাহার দুঃখের সান্ত্বনা পাইতে চায়।

হাজারি সস্নেহে তাহাকে কাছে বসাইল। কিছুক্ষণ কেহই কথা বলিল না। পরে অতসী বলিল–কাকাবাবু, আমি একদিন বলেছিলাম আপনার হোটেলের কাজেই উন্নতি হবে–মনে আছে?

–সব মনে আছে অতসী মা। তুলি নি কিছুই। আর না কিন্তু এখানকার ইষ্টাটপত্র–সব তো তোমার দয়াতেই মা–তুমি দয়া না করলে–

অতসী তিরস্কারের সুরে বলিল–ওকথা বলবেন না কাকাবাবু ছিঃ–আমি টাকা দিলেও আপনার ক্ষমতা না থাকলে কি সে টাকা বাড়তো? তিন বছরের মধ্যে এত বড় জিনিস করে ফেলতে পারত অন্য কেউ আনাড়ি লোক? আমি কিছুই জানতুম না কাকাবাবু, এখানে এসে সব দেখে শুনে অবাক হয়ে গিয়েছি। আপনি ক্ষমতাবান পুরুষমানুষ কাকাবাবু।

–এখন তুমি এঁড়োশোলায় যাবে মা, না আবার শ্বশুরবাড়ী যাবে?

–এঁড়োশোলাতেই যাবো। বাবা-মা দুঃখে সারা হয়ে আছেন। তাদের কাছে গিয়ে কিছুদিন থাকব। জানেন কাকাবাবু, আমার ইচ্ছে দেশে এমন একটা কিছু করব, যাতে সাধারণের উপকার হয়। বাবার টাকা সব এখন আমিই পাব, শ্বশুরবাড়ী থেকেও টাকা পাব। কিন্তু এ টাকার আমার কোন দরকার নেই কাকাবাবু। পাঁচজনের উপকারের জন্যে খরচ করেই সুখ।

–যা ভাল বোঝ মা কয়ে। আমি তোমায় কি বলব?

–কাকাবাবু, আপনি বম্বে যাচ্ছেন নাকি?

–হ্যাঁ মা।

অতসী ছেলেমানুষের মত আবদারের সুরে বলিল–আমায় নিয়ে যাবেন সঙ্গে করে? বেশ বাপেঝিয়ে থাকবো, আপনাকে রেঁধে দেব–আমার খুব ভালো লাগে দেশ বেড়াতে।

–যেও মা, এবারটা নয়। আমি তিন বছর থাকব সেখানে। দেখি কি রকম সুবিধে অসুবিধে হয়। এর পরে যেও।

–ঠিক কাকাবাবু? কেমন মনে থাকবে তো?

–ঠিক মনে থাকবে। যাও এখন শোও গিয়ে মা, অনেক কষ্ট হয়েছে গাড়িতে, সকাল সকাল বিশ্রাম কর গিয়ে।

.

পরদিন বিবাহ। টেঁপির নরম হাতখানি নরেনের বলিষ্ঠ পেশীবদ্ধ হাতে স্থাপন করিবার সময় হাজারির চোখে জল আসিল।

কতদিনের সাধ–এতদিনে ঠাকুর রাধাবল্লভ পূর্ণ করিলেন।

বংশীধর ঠাকুর বরকর্তা সাজিয়া বিবাহ-মজলিসে বসিয়া ছিল। সেও সে সময়টা আবেগপূর্ণ কণ্ঠে বলিয়া উঠিল–হাজারি-দা!

কাছাকাছি সব হোটেলের রাঁধুনী বামুনেরা তাহাদের আত্মীয়-স্বজন লইয়া যাত্রী সাজিয়া আসিয়াছে। এ বিবাহ হোটেলের জগতের, ভিন্ন জগতের কোনো লোকের নিমন্ত্রণ হয় নাই ইহাতে। ইহাদের উচ্চ কলরব, হাসি, ঠাট্টা ও হাঁকডাকে বাড়ী সরগরম হইয়া উঠিল।

বিবাহের পরদিন বর-কনে বিদায় হইয়া গেল। বেশীদূর উহারা যাইবে না। এই রাণাঘাটেই চূর্ণীর ধারে বংশীধর একখানা বাড়ী ভাড়া করিয়াছে পাঁচ দিনের জন্য। সেখানে দেশ হইতে বংশীধরের এক দূর-সম্পর্কের বিধবা পিসি (বংশীধরের স্ত্রী মারা গিয়াছে বহুদিন) আসিয়াছেন বিবাহের ব্যাপারে। বৌভাত সেখানেই হইবে।

.

হাজারি একবার রেলওয়ে হোটেলে কাজ দেখিতে যাইতেছে, বেলা আন্দাজ দশটা, বেচু চক্কত্তির হোটেলের সামনে ভিড় দেখিয়া থামিয়া গেল। কোর্টের পিওন, বেলিফ, ভিড়ের মধ্যে দাঁড়াইয়া আছে আর আছে রামরতন পালচৌধুৰী জমাদার। ব্যাপার কি জিজ্ঞাসা করিয়া জানিল মহাজনের দেনার দায়ে বেচু চক্কত্তির হোটেল শীল হইতেছে।

হাজারি কিছুক্ষণ থমকিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। তাহার পুরোনো মনিবের হোটেল, এইখানে সে দীর্ঘ সাত বৎসর সুখে-দুঃখে কাটাইয়াছে। এত দিনের হোটেলটা আজ উঠিয়া গেল! একটু পরে পদ্মঝি দু হাতে দুটি বড় বালতি লইয়া হোটেলের পিছনের দরজা দিয়া বাহির হইতেই একজন আদালতের পেয়াদা বেলিফের দৃষ্টি সেদিকে আকৃষ্ট করিল। বেলিফ সাক্ষী দুজনকে ডাকিয়া বলিল–এই দেখুন মশায়, ওই মেয়েলোকটা হোটেল থেকে জিনিস নিয়ে যাচ্ছে, এটা বে-আইনী। আমি পেয়াদাদের দিয়ে আটকে দিচ্ছি আপনাদের সামনে।

পেয়াদারা গিয়া বাধা দিয়া বলিল–বালতি রেখে যাও—

পরে আরও কাছে গিয়া হাঁক দিয়া বলিল–শুধু বালতি নয় বাবু, বালতির মধ্যে পেতল কাঁসার বাসন রয়েছে।

পদ্মঝি ততক্ষণে বালতি দুটা প্রাণপণে জোর করিয়া আঁটিয়া ধরিয়াছে। সে বলিল–এ বাসন আমার নিজের–হোটেল চক্কত্তি মশায়ের, আমার জিনিস উনি নিয়ে এসেছিলেন, এখন আমি নিয়ে যাচ্ছি।

পেয়াদারা ছাড়িবার পাত্র নয়। অবশ্য পদ্মঝিও নয়। উভয় পক্ষে বাকবিতণ্ডা, অবশেষে টানাহেঁচড়া হইবার উপক্রম হইল। মজা দেখিবার লোক জুটিয়া গেল বিস্তর।

একজন মহাজন পাওনাদার বলিল–আমি এই সকলের সামনে বলচি, বাসন নামিয়ে যদি না রাখো তবে আদালতের আইন অমান্য করবার জন্যে আমি তোমাকে পুলিশে দেবো।

একজন সাক্ষী বলিল –তা দেবেন কেমন করে বাপু? ওর নামে তো ডিক্রি নেই আদালতের। ও আদালতের ডিক্রি মানতে যাবে কেন?

বেলিফ বলিল–তা নয়, ওকে চুরির চার্জে ফেলে পুলিশে দেওয়া চলবে। এ হোটেল এখন মহাজন পাওনাদারের। তার ঘর থেকে অপরের জিনিস নিয়ে যাবার রাইট কি? ওকে জিজ্ঞেস করো ও ভালোয় ভালোয় দেবে কিনা–

পদ্মঝি তা দিতে রাজী নয়। সে আরও জোর করিয়া আঁকড়াইয়া আছে বাতি দুটি। বেলিফ বলিল–কেড়ে নাও মাল ওর কাছ থেকে–বদমাইশ মাগী কোথাকার–ভাল কথায় কেউ নয়।

পেয়াদারা এবার বীরদর্পে আসিয়া গেল। পুনরায় একচোট ধস্তাধস্তির সূত্রপাত হইবার উপক্রম হইতেই হাজারি সেখানে গিয়া দাঁড়াইয়া বলিল–পদ্মদিদি, বাসন ওদের দিয়ে দাও।

লজ্জায় ও অপমানে পদ্মঝিয়ের চোখে তখন জল আসিয়াছে। জনতার সামনে দাঁড়াইয়া এমন অপমানিত সে কখনো হয় নাই। এই সময় হাজারিকে দেখিয়া সে হাউ হাউ করিয়া কাঁদিয়া ফেলিল।

–এই দেখোনা ঠাকুর মশায়, তুমি তো কতদিন আমাদের হোটেলে ছিলে–এ আমার জিনিস না? বলো না তুমি, এ বালতি কার?

হাজারি সান্ত্বনার সুরে বলিল–কেঁদো না এমন করে পদ্মদিদি। এ হোল আইন-আদালতের ব্যাপার। বাসন রেখে এসো ঘরের মধ্যে, আমি দেখছি তারপর কি ব্যবস্থা করা যায়–

অবশ্য তখন কিন্তু করিবার উপায় ছিল না। সে আদালতের বেলিফকে জিজ্ঞাসা করিল–কি করলে এদের হোটেল আবার বজায় থাকে?

–টাকা চুকিয়ে দিলে। এ অতি সোজা কথা মশাই। সাড়ে সাতশো টাকার দাবীতে নালিশ–এখনও ডিক্রী হয় নি। বিচারের আগে সম্পত্তি সীল না করলে দেনাদার ইতিমধ্যে মাল হস্তান্তর করতে পারে, তাই সীল করা।

আদালতের পেয়াদারা কাজ শেষ করিয়া চলিয়া গেল। বেচু চক্কত্তিকে একবারে ডাকিয়া হাজারি বলিল–আমার সঙ্গে চলুন না কর্তা মশায় একবার ইষ্টিশনের দিকে–আসুন, কথা আছে।

রেলের হোটেলে নিজের ঘরটিতে বেচু চক্কত্তিকে বসাইয়া হাজারি বলিল–কর্তা একটু চা খাবেন?

বেচু চক্কত্তির মন খারাপ খুবই। চা খাইতে প্রথমটা চাহে নাই, হাজারি কিছুতেই ছাড়িল না। চা পান ও জলযোগান্তে বেচু বলিল–হাজারি, তুমি তো সাত-আট বছর আমার সঙ্গে ছিলে, জানো তো সবই, হোটেলটা ছিল আমার প্রাণ। আজ বাইশ বছর হোটেল চালাচ্ছি –এখন কোথায় যাই আর কি করি। পৈতৃক জোতজমা ঘরদোর যা ছিল ফুলে-নবলায়, সে এখন আর কিছু নেই, ওই হোটেলই ছিল বাড়ী। এমন কষ্ট হয়েছে, এই বুড়ো বয়সে এখন দাঁড়াই কোথায়? চালাই কী করে?

–এমন অবস্থা হোল কি করে কর্তা? দেনা বাধালেন কী করে?

–খরচে আয়ে এদানীং কুলোতো না হাজারি। দু-বার বাসন চুরি হয়ে গেল। ছোট হোটেল, আর কত ধাক্কা সইবার জান ছিল ওর! কাবু হয়ে পড়লো। খদ্দের কমে গেল। বাড়ীভাড়া জমতে লাগলো–এসব নানা উৎপাত–

হাজারি বেচু চক্কত্তিকে তামাক সাজিয়া দিয়া বলিল–কর্তা, একটা কথা আছে বলি। আপনি আমার পুরনো মনিব, আমার যদি টাকা এখন থাকতো, আপনার হোটেলের সীল আমি খুলিয়ে দিতাম। কিন্তু কাল মেয়ের বিয়ে দিয়ে এখন অত টাকা আমার হাতে নেই। তাই বলচি, যতদিন বম্বে থেকে না ফিরি, আপনি আমার বাজারের হোটেলের ম্যানেজার হয়ে হোটেল চালান। পঁচিশ টাকা করে আপনার খরচ দেবো। (হাজারি মাহিনার কথাটা মনিবকে বলিতে পারিল না।) খাবেন দাবেন হোটেলে, আর পদ্মাদিদিও ওখানে থাকবে, মাইনে পাবে, খাবে। কি বলেন আপনি?

বেচু চক্কত্তির পক্ষে ইহা অস্বপনের স্বপন। এ আশা সে কখনো করে নাই। রেলবাজারের অত বড় কারবারী হোটেলের সে ম্যানেজার হইবে। পদ্মঝিও খবরটা পাইয়াছিল বোধ হয় বেচুর কাছেই, সেদিন সন্ধ্যাবেলা সে কুসুমের বাড়ী গেল। কুসুম উহাকে দেখিয়া কিছু আশ্চৰ্য্য না হইয়া পারিল না, কারণ জীবনে কোনোদিন পদ্মঝি কুসুমের দোর মাড়ায় নাই।

–এসো পদ্মপিসি বসো। আমার কি ভাগ্যি। এই পিঁড়িখানতে বোসো পিসি। পান-দোক্তা খাও? বসো পিসি, সেজে পানি–

পদ্মঝি বসিয়া পান খাইয়া অনেকক্ষণ ধরিয়া কুসুমের সঙ্গে এ-গল্প ও-গল্প করিল। পদ্ম বুঝিতে পারিয়াছে কুসুমও তাহার এক মনিব। ইহাদের সকলকে সন্তুষ্ট রাখিয়া তবে চাকুরি বজায় রাখা। যদিও সে মনে মনে জানে, চাকুরি বেশী দিন তাহাকে করিতে হইবে না। আবার একটা হোটেল নিজেরাই খুলিবে, তবে বিপদের দিনগুলিতে একটা কোনো আশ্রয়ে কিছুদিন মাথা গুঁজিয়া থাকা।